ডক্টর রবার্ট প্যান একদিন একটা টাইম-মেশিন বানালেন। তাতে অনেকরকম যন্ত্র ছিল। রবার্ট তাঁর বন্ধুদের মানে জ্যাকসন টেফ আর জ্যাক জনারিকে ডেকে নিলেন। তাঁরা সবাই টাইম-মেশিনে উঠে পড়লেন। ১০,০০,০০,০০০ বছর আগে চলে গেলেন সবাই। টাইম-মেশিনের ভেতর থেকে সব ঝাপসা দেখাচ্ছিল। তাই ওঁরা বাইরে নেমে এলেন। বাইরে এসে হাঁটতে হাঁটতে ওঁদের খুব জল তেষ্টা পেল। ওঁরা নদীর ধারে জল খেতে এসে দেখলেন যে নদীর দু’পাশে ঘন জঙ্গল। আর এ-জঙ্গল থেকে ও-জঙ্গল পারাপার করছে এক বিশাল স্ট্যাগোসরাসের দল। ডঃ রবার্ট ছবি তুলে রাখলেন। দুটো বাচ্চা স্ট্যাগোসরাসও ছিল। ওঁরা জল খেয়ে ওখান থেকে চলে গেলেন। সঙ্গে মাত্র একদিনের খাবারই ছিল। তা-ই খাওয়া হল।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। তাঁবু খাটিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন সবাই। হঠাৎ মাঝরাতে কীরকম একটা ধুপ ধুপ আওয়াজ শুনে জ্যাক জনারি মশাল জ্বেলে বাইরে গেলেন। বাইরে গিয়ে দেখা গেল একটা স্ট্যাগোসরাস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে। খুব একটা ক্ষতি করেনি সে। সুতরাং তাঁবুতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া গেল আবার।
পরেরদিন শিকারে গিয়ে জঙ্গলের মাঝখানে পৌঁছে গেলেন তিনজনে। সেখান থেকে ফলটল নিয়ে খাওয়া হল।
ওঁরা যখন জীপে উঠলেন যাবেন বলে তখন ওঁদের জীপটা একটি বড়ো কিছুতে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গেল। ওপরে তাকিয়ে দেখা গেল একটা টি-রেক্স। ওঁরা পেছনদিকে দৌড়তে লাগলেন। দৌড়তে দৌড়তে একটা ছোটো গুহা দেখতে পেয়ে ওঁরা তার ভেতরে ঢুকে পড়লেন। সেখানেই রাত কাটালেন। রাত্রে ওঁরা শুনতে পেলেন কীরকম একটা চিঁ চিঁ আওয়াজ। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন, দুটো ডিম ফুটে বাচ্চা টেরানোডন বেরিয়েছে। রবার্ট বুঝলেন যে এঁদের বাইরে থাকা ঠিক হবে না। তাই ওই বাচ্চাদের গুহার ভেতরে নিয়ে এলেন। ওদের জন্য ঘাসপাতা জোগাড় করে নিয়ে এসে গুহার ভেতর জড়ো করলেন। জায়গাটা নরম হয়ে গেল। তার ওপরেই বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ল।
সেই বাচ্চাগুলো ধীরে ধীরে বড়ো হল। তারা যখন বড়ো হয়ে উড়তে শিখল, তাদের ছেড়ে দেওয়া হল। ওরা উড়ে চলে গেল। রবার্ট বললেন, “এরকম এক জায়গায় বসে থাকলে চলবে না। আমাদের আগেকার দিনের পুরো পৃথিবীটাকে দেখতে হবে।”
পরেরদিন সকলে ওঁরা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। চারদিকে আরও কত ডাইনোসর ঘুরে বেড়াচ্ছে। করিথোসরাস, ব্র্যাকিওসরাস, ডিপ্লোডকাস, মেগার্যাপ্টর ও আকাশে টেরানোডন। যারা মাটিতে ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাংসভোজী।
হঠাৎ ঘটল এক অঘটন। দূরের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল টিরানোসরাস রেক্স। ওকে দেখেই সবাই খাওয়া ছেড়ে পালিয়ে গেল। ভাগ্য ভালো মানুষদের দেখার আগেই ওঁরা পালিয়েছেন। একটা ট্রাইসেরাটপস শুয়ে ছিল। ওঁরা ওটাকে পাথর মনে করে ওর পেছনে লুকিয়ে পড়লেন। যখন সেটা একটু নড়াচড়া করল, তখন ওঁরা সতর্ক হয়ে গেলেন। তাঁরা বুঝলেন ওটা একটা বড়ো ডাইনোসর।
ভালো করে দেখে বোঝা গেল, ওটা একটা ট্রাইসেরাটপস। ট্রাইসেরাটপসের ঘুম ভেঙে গেল। ‘য়াঁ য়াঁ’ করতে করতে কোনদিকে চলে গেল। ও যে ঝোপে ঢুকল সেটা বেশি ঘন ছিল না। ও ব্বাবা, সে ঝোপের ওপাশে আরেকটা ট্রাইসেরাটপস ঘাস খাচ্ছিল! সে তার কাছে চলে গেল। ওটা ওর মা। খেয়েদেয়ে ওরা চলে গেল।
জ্যাক জনারি বললেন, “চল, আমরাও চলে যাই। সন্ধে হচ্ছে তো, নাকি?”
ওঁরা তাঁবু খাটিয়ে তাঁবুর ভেতর শুয়ে পড়লেন।
পরদিন সকালবেলা দেখা গেল তাঁবুর ভেতর একটা কাঁটাওয়ালা লেজ। সবাই দেখে খুব ভয় পেল।
পরে একটু ভয়ে ভয়ে জ্যাক জেনারি বেরিয়ে গিয়ে দেখলেন, ওটা একটা স্ট্যাগোসরাসের লেজ। ওঁরা তাঁবু তুলে ফেললেন।
ঘুরতে ঘুরতে ওঁরা একটা নদী দেখলেন। নদীতে অসংখ্য ডাইনোসর স্নান করছিল। ওরা ছিল বিরাট আকারের। ম্যাক্রুরোসরাস ওরা। ঘাস খাচ্ছিল। ওর ফসিল পাওয়া গেছে আফ্রিকায় ১০০৫ সালে। খেতে খেতে হঠাৎ চলে গেল। কিন্তু কেন? কিছু কি দেখতে পেয়েছে ওরা? নাকি কিছুর গন্ধ পেয়েছে? জলের দিকে ঝুঁকে কিছুই দেখা গেল না। জঙ্গল থেকে তো কেউ আসছে না। তবে কী হল? অবাক হলেন সবাই। পরে সব বোঝা গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল জল থেকে একটা বিশাল কাঁটাওয়ালা ডিমেট্রডন বেরিয়ে এল। অনাহারে তার হাড়গোড় বেরিয়ে অবস্থা খারাপ। হাঁটতে পারছে না ভালো করে। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, ও যাকে পাবে তাকেই খাবে।
একদিন রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় হল। গাছপালা উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। তাঁবু খুলে যায় যায় অবস্থা। যথারীতি তাঁবু খুলে ঝড়ে উড়ে চলে গেল। লোকগুলোর কাছে আলাদা তাঁবুও ছিল না। মাথার ওপর খোলা আকাশ। তার মাঝেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে না পেরে ওঁরা একটা গুহায় আশ্রয় নিলেন। গুহার মুখটা অত বড়োও ছিল না। ছোটো ছিল। কিন্তু খেতে তো হবে। ব্যাগে খাবার ছিল। তা-ই খেতে হল।
একটু বিশ্রাম নিয়ে ওঁরা পরেরদিনের জন্যে শিকার ধরতে বেরোলেন। কিছু পরে জ্যাকসনের জোরে ‘আ-আ-আ’ শব্দ শোনা গেল। রবার্ট তাঁর আরেকটা আবিষ্কার সাথে করে নিয়ে গেছিলেন – ফ্লাইং হেলমেট। ওটা পরে জ্যাকসনকে খুঁজতে বেরোলেন রবার্ট আর জ্যাক। ওঁরা জ্যাকসনকে গুহায় ফিরে যেতে দেখলেন।
যাক, জ্যাকসন ফিরে এসেছেন, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। হঠাৎ দেখা গেল নিচে একটা লোক হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছেন। জ্যাক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
তিনি বললেন, “আমার নাম অলট্রাক্স। আমি এখানে দু’মাস আগে এসেছি। আমিও একজন সায়েন্টিস্ট। আমি টাইম-মেশিনে করে এখানে এসেছি।”
জ্যাক বললেন, “তুমি আমাদের সাথে থাকতে পার।”
তাঁর সাথে বন্ধুত্বও হয়ে গেল। তাঁকে কাঁচি দেওয়া হল। অলট্রাক্স চুলদাড়ি কেটে নিলেন।
একদিন ঘটল এক বিস্ফোরণ। দুনিয়ার সবথেকে উঁচু আগ্নেয় পাহাড় থেকে লাভার স্রোত বেরিয়ে এল।
পরেরদিন আগ্নেয়গিরি ঠিকও হয়ে গেল। বনজঙ্গল সব পুড়ে গেছে। দূরে একটা টি-রেক্স মরে পড়ে আছে দেখা গেল। ওর গায়ে আগুন ধরে গিয়েছিল হয়তো।
নাহ্, কেউ ওকে কামড়েছে। কামড়ানোর দাগ আছে ওর গলায়।
সন্ধেবেলায় খেতে খেতে ওঁরা এক টরোসরাসের গর্জন শুনতে পেলেন। এই টরোসরাস কচ্ছপের মতোই। একটা খোলসের মধ্যে থাকবে। শিকার এলেই বাইরে এসে খপ করে খেয়ে নেয়। সেদিন কেউ গুহা থেকে বেরোননি।
রাত পেরিয়ে ভোর হল। সবাই বললেন, “এবার আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত।”
“কিন্তু কীভাবে?” বলে উঠলেন জ্যাক। তিনি বললেন, “টাইম-মেশিন তো ভেঙে গেছে।”
হুম, একটা বাধা পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে ওঁরা দেখলেন, একটা ডাইনোসরের কঙ্কাল। সেটার দিকে বেশি নজর না দিয়েই চলে গেলেন তাঁরা। বেশি দূর যেতে হয়নি। অ্যাঙ্কিলোসরাসের সঙ্গে ধাক্কা! সে তো এমন তাড়া করল, ছাড়ার নামই নিচ্ছে না! দৌড়তে দৌড়তে তাঁরা একটা গাছে উঠে পড়লেন। যাই হোক, ডাইনোসরটা তলা দিয়ে চলে গেল। তারপর গাছ থেকে নেমে এলেন সবাই।
তাঁরা জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে নিয়ে নৌকো বানালেন। ছোটো নৌকো। তাতে করেই নদী পার হবেন মানুষগুলো।
নৌকো থামিয়ে দিলেন ওঁরা মাঝনদীতেই। একটা ডিপ্লোডোকাস! ও বেশিক্ষণ থাকেনি জলে। চলে গেল কিছু পরে। নৌকোতেই একটা দিন কেটে গেল।
পরেরদিন ভোরবেলা নৌকো ডাঙায় পৌঁছল। সেখানে অলট্রাক্স তাঁর টাইম-মেশিনটা ফেলে গিয়েছিলেন। সেইখানে গিয়েই অশান্তি। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে নদীটা আরও অনেক লম্বা। কিন্তু নৌকো তার ভেতর ঢুকছে না। নেমে হাঁটাপথে এগোতে লাগলেন সবাই।
বন্দুকের গুলি শেষ। লোকগুলো খুব ক্লান্ত। তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বড়ো মেগার্যাপ্টর দেখলেন। একমুঠো বালি নিয়ে রবার্ট বন্দুকের ভেতর দিলেন। তারপর বালির ঝড়। মেগার্যাপ্টর কিছুই দেখতে পেল না। সে পড়ে গেল।
তাঁরা অলট্রাক্সের টাইম-মেশিন দেখতে পেলেন। কিন্তু মাঝখানে একটা ডোবা আছে। হঠাৎ জ্যাক পাথরে হোঁচট খেয়ে ডোবায় পড়ে গেলেন। জ্যাক সাঁতার জানতেন না। হঠাৎ জ্যাকের টুপিটা জলের ওপর ভেসে উঠল। বন্দুকটাও। জ্যাকের জ্যাকেটটাও খুলে ভেসে উঠল।
জলের নিচে পরার পোশাক এনেছিলেন রবার্ট। সেটা পরে জলায় তলায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি টুপি, বুট, বেল্ট, বন্দুক, জ্যাকেট, তালা খুঁজে পেলেন। জলের তলায়। হঠাৎ দেখলেন বড়ো হাঙরের মতো একটা ডাইনোসর তাঁর দিকে তিরবেগে ভেসে আসছে।
হঠাৎ রবার্টের চোখ খুলে গেল। সে দেখল, সে ঘরের মেঝেতে সাঁতার কাটছে। ও বিছানা থেকে পড়ে গিয়েছিল আর হাত লেগে জলের জগ উলটে পড়ে আছে। ঘরময় জল আর তার মধ্যেই জ্যাককে খুঁজে বেড়াচ্ছে।