আব্বা ঢাকায় আসছে। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর এটাই আব্বার প্রথম আগমন। আমার মেসের জীবন, অগোছালো ঘর, প্যান্ট-শার্ট, গেঞ্জি ঘিঞ্জি লেগে একটার উপর আরেকটা পরে আছে। বিছানার নীচে সিগারেটের এস্ট্রে থাকলেও পুরো ঘরের মেঝেতে সিগারেটের ছড়াছড়ি। আব্বার আসার কথা শুনে ধুয়ে মুছে সব পরিস্কার করে রাখছি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গত তিনবছর থেকে বুয়ার হাতের রান্না খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছি, কিন্তু আব্বার পক্ষে বুয়ার হাতের রান্না খাওয়া সম্ভব না। ঢাকায় এসে আমি মেসে উঠার পর, আম্মার হাতের রান্নার যায়গায় বুয়ার হাতের রান্না খেয়ে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবথেকে নিকৃষ্টতম খাবার খাচ্ছি। প্রথম কয়দিন হোটেলে খেয়ে, গোটা মাসের খরচের টাকা বিসর্জন দিয়ে বুয়ার হাতের রান্না খেতে শিখেছিলাম, ধীরে ধীরে জিহবা অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
আব্বা আমি দুজন মিলে হোটেলে খেয়েছি, বিল দিতে গেছিলাম, আব্বা বলল—
“টাকা কি বেশি হইছে?”
আমি চুপ মেরে গেছিলাম। এর আগেও বহুবার আব্বা ঢাকায় আসছে, তখনও তিনিই বিল দিছেন, এইবারও তিনিই দিলেন।
আব্বা পল্লীবিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয়ে একটা কাজে আসছিলেন। আমাকে সাথে করে নিয়ে আসলেন। তিনি কাজ করছিলেন আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম—
“এই মানুষটি আমার আব্বা, কত সহজ-সরল কোমল দুটি চোখ তাঁর, কথা বলার সময় ঠোঁট দুটোর নড়া চড়া থেকে শুরু করে সেলাই করা বাটার জুতা সবকিছুই আমাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করে। আমি কেবল মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকি”।—অথচ কখনো বলা হয়নি, আব্বা আপনাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি। আব্বাও বলে না, তবে ইন্টারমেডিয়েট শেষ করে যখন ঢাকায় চলে আসলাম সেবার আমাকে মেসে তুলে দিয়ে চলে যাবার সময় জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন, হয়তো বাড়ি ফিরেও কেঁদেছেন, এরপর অসংখ্য দিন আমাকে মনে পরতেই কেঁদেছেন।
আব্বার কাজ শেষ, মাঝার রোড থেকে গাড়িতে উঠবেন। আমি বললাম, আমি সাথে যাই, পৌঁছে দিয়ে আসি। আব্বা বললেন, না লাগবেনা, তুই বরং মেসে ফিরে যা, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, সকালে আবার ক্লাসে যাবি।
আব্বার নিষেধ সত্ত্বেও পিছন পিছন গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। কতদিন পর আব্বার সান্নিধ্য পেলাম! হাত ধরে রিক্সায় টেনে তুলেছি, বাহু ধরে রাস্তা পার করেছি, একসাথে অনেকটা পথ বাপ-বেটা মিলে হেটেছি।
গাড়ি থেকে নেমে নিউমার্কেট গিয়ে আব্বা কিছু কেনাকাটা করলেন, আম্মার জন্য শাড়ী, ছোট ভাই-বোনদের জন্য জামা-কাপড়, আমাকেউ একটা গেঞ্জি কিনে দিলেন। আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছিলো, “আব্বা আপনার জন্যে কিছু নিবেন না”, কিন্তু মুখ থেকে বের হচ্ছিলো না।
কেনাকাটার শেষ পর্যায়ে বলেই ফেললাম, আব্বা আপনার জন্যে কিছু নিবেন না? আব্বা অনাগ্রহে বললেন, আমি আবার কি নিবো, আমারতো সবই আছে।
কেনাকাটা সেড়ে কাউন্টারে গেলাম। টিকিট কেটে আব্বার পাশে বসে আছি। আব্বা জানতে চাইলো খরচের টাকা আছে কিনা। বললাম, আছে। এরপরও কিছু টাকা দিলেন, ভাবিনি এতো টাকা দিবেন, চলে যাবার পর দেখেছি।
আব্বা বার বার তাড়া দিচ্ছেন মেসে ফেরার, মেস এখান থেকে অনেক দূর, রাত অনেক হলো। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। ইচ্ছা হচ্ছিল, আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদি, কিন্তু পারলাম না।
গাড়ি আসার পর, আব্বা কাউন্টার থেকে বের হলেন। সুপারভাইজার যাত্রীদের দ্রুত গাড়িতে উঠার তাড়া দিচ্ছিল, আব্বা গাড়ির দরজার দিকে পা বাড়ালেন। ইচ্ছা হচ্ছিল আমিও উঠে যাই, সারা রাস্তা আব্বার বুকে মাথা গুজে রাখি। আমি ডাক দিলাম আব্বা!—আব্বা থামলেন, আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করতেই, আব্বা আমার মাথায় হাত রাখলেন, কি মমতা, কত স্নেহ-ভালোবাসা যেন এই স্পর্শে রয়েছে। এই স্পর্শটুকুর জন্যই এতোটা পথ এসেছি।
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আমিও হাটতে শুরু করলাম, চোখ দুটো থেকে বৃষ্টির মতন জল ঝরতে শুরু করেছে। টেকনিক্যাল থেকে গাড়িতে উঠে পরলাম, ভেতরটা মোটামুটি ফাঁকা৷ পেছনের দিকে গিয়ে জানালার পাশে বসলাম। জানালা দিয়ে বাতাসের ঝাপ্টা এসে চোখে লাগছে। দ্রুত আব্বার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি।
কিছুদিন থেকে ভীষণ বিষন্নতায় ভুগছিলাম, আব্বা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করার পর এক মুহূর্তেই সকল বিষন্নতা কেটে গেছে, এটা সেই বিশ্বস্ত হাতের স্পর্শ, যেই হাত সেই জন্মলগ্ন থেকে আজ অব্ধি আমাকে আগলে রেখেছে ঠিক ছায়ার মতন। ইচ্ছা হচ্ছে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে আব্বার কাছে চলে যাই।
আব্বাকে খুব মনে পরছে, আমি চোখ বন্ধ করলাম—
আব্বা এসে আমার পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাকলেন—খোকা!
—আমার খুব অভিমান হয়, আমি কোন উত্তর দেই না।
—অভিমান করেছিস খোকা?
—হু,
—কেনরে?
—তুমি এতো ভাল কেন? আমি তোমাক অনেক অনেক ভালোবাসি।
—আমি জানি।
—না জানোনা তুমি। জানলে কখনো বুকে টেনে নাও না কেন?
—এই জন্যে অভিমান করে আছিস! আয় বুকে আয়, সারারাত তোকে আজ সেই ছোট্ট বেলার মতন জড়িয়ে ধরে রাখব।
—ছাড়বে না কিন্তু!
—না ছাড়ব না।
গাড়ি থেকে নেমে মেসের দিকে হাটতে শুরু করলাম। মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করছে, পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম, আব্বা কল করেছে।
—হ্যালো!
—মেসে পৌঁছাসনাই এখনো?
—এই তো চলে আসছি।
—রাস্তায় কোন সমস্যা হয় নাই তো?
—নাহ।
—আচ্ছা, তাইলে গিয়ে কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
—আচ্ছা।
—আপনি কতদূর গেলেন?
—এইতো যমুনার কাছাকাছি। আচ্ছা রাখি তাইলে।
আব্বা ফোন রেখে দিলেন। আমার আর বলা হলো না,
“সাবধানে যেয়ো বাবা। ভালো থেকো”।
“রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সগীরা”।