শিমুল এই শিমুল উঠ,বাড়িতে বিয়ে আর ওকে দেখ, এতো বেলা হয়ে গেছে পরে পরে ঘুমাচ্ছে।একশোবার করে সবাই ডেকেই যাচ্ছে উঠার নাম নেই।
সত্যিতো শিমুল ভুলেই গেছিল যে আজ ওর চাচাতো বোন নিধির বিয়ে।কাল রাত জেগে কাজ করছে,আড্ডা দিছে আর এখন ঘুমই ভাংছে না।ও এক লাফে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল।ওদের বাড়ি থেকে ওর চাচার বাড়ি দুই মিনিটের রাস্তা।ওর মা ওকে ডেকে রেখেই চলে গেছে,ওর বাবা কি যেন করছিল উঠোনের এক কোণে বসে। ও কথা না বলে রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখে ২৭ টা মিসড কল।”আরেহ বাবা, এইটুকু সময়ের মধ্যে আবার এতোবার কল দিলো কে”মনে মনে ভাবতে থাকে শিমুল।নামটা দেখেই চমকে যায় ও, “আরে পুতুল(ওর আসল নাম জবা,শুধু শিমুল ওকে এই নামে ডাকে),এতো সকালে ফোন করছে,তাও আবার এখান থেকে এখানে”।ভাবতে ভাবতেই ও পৌছে যায় জবাদের বাড়ি।আসলে জবা ওর চাচাতো বোন,ওর বোনেরই বিয়ে।আর এই বিয়েটা হয়ে গেলে জবা আর শিমুলের বিয়ে।ওর চাচা অবশ্য দুই মেয়ের বিয়ে একদিনেই দিতে চেয়েছিলেন।কিন্তু সামনে জবার ইন্টার পরীক্ষা তাই নিধির বিয়েটা আগে দিচ্ছেন।
শিমুলের সাথে জবার বিয়েটা ছোট থাকতেই ঠিক করে রাখা।এর অবশ্য একটা মজার কারণও আছে।জবা হওয়ার পর শিমুল সারাক্ষণ ওর কাছেই থাকতে চাইত,আর ওকে আদর করতে চাইত।আর ওর মাকে বলত,”মা,এই পুতুলটাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে চলনা,আমি ওর সাথে খেলব।”।ওর কথা শুনে সবাই খুব হাসত। তারপর জবা যখন একটু বড় হলো সেও শিমুল ছাড়া কিছু বুঝত না।প্রথম যখন ও কথা বলতে শেখে তখন শিমুলকে”ছিউম”বলে ডাকত।শিমুলের অবশ্য ভালই লাগত নামটা।আর সে কারনেই ওদের দুই পরিবারেরই সবার ইচ্ছা ছিল শিমুল আর জবার বিয়ে।ওরা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে,ওরাও কোন আপত্তি করেনি।দুইজন যে দুইজনকে খুব ভালবাসে ওদের দেখলেই বোঝা যায়।
এতো লোকের ভীড়েও শিমুল যেন কোন এক সুখের স্মৃতিতে ভাসছে,জবা যে ওকে কখন থেকে ডাকছে শুনতেই পায়নি।জোরে একটা ধাক্কা খেতেই বলে উঠল,”অ্যা”বলেই থেমে গেল।”কানে কি তুলা দিয়ে এসেছেন বাড়ি থেকে,সেই তখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছেন না”একটু রাগী সুরেই কথাটা বলল জবা।”আরে আজকের মত একটা সুন্দর দিনে তুমি এইভাবে কথা বলছ কেনো?”কথাটা বলতেই শিমুলের হাত ধরে ওর রুমে নিয়ে গেল জবা। শিমুল খেয়াল করল যে,জবার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে।বোনের বিয়েতে কেউ এইভাবে কাদে নাকি।শিমুল কিছু বুঝতে পারছে না।জবাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই জবা কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলতে থাকে যে,” জানেন,আপু না চলে গেছে”।”চলে গেছে মানে!!!”চেঁচিয়ে ওঠে শিমুল।জবা কান্না করতে করতেই বলতে থাকে,”হ্যা।ও একটা ছেলেকে পছন্দ করত ওদের ভার্সিটিরই,আমাকে কাল রাতে বলেছিল কথাটা,আমি বলেছিলাম বাবা-মাকে বলতে, ও বলেনি,তাই আমিও ভেবেছি হয়ত পছন্দ করত ওইটুকুই, বিয়ে করলে হয়ত ভুলে যাবে।কিন্তু আপু যে এতোবড় একটা কাজ করবে”।
রাগে শিমুলের মাথায় আগুন উঠে গেছে।ভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে এমন ভুল করবে ও কল্পনাও করতে পারেনি।বাড়িতে একবার জানাতে পারত,সবাইতো ওকে এত ভালবাসে আর ও কিনা একবার বলেও দেখল না।জবা শিমুলের চুপ থাকা দেখে বলতে থাকে,”ওই বাড়িতেও সবাই জেনে গেছে যে বিয়ের কণে অন্য একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে,ওনারা চাচ্ছেন যে”এইটুকু বলেই থেমে যায় জবা।এই অসম্পুর্ন কথাটা শুনেই শিমুলের বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা ব্যাথা অনুভব করতে থাকে।হয়ত ও যেটা ভাবছে সেটাই বলবে জবা।কিন্তু ও যে তেমন কিছু শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়।তাই ও অনেক অস্থির হয়ে বলতে থাকে,”কি…কি…বলেছে ওনারা?
জবা যেন একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।শিমুল এইবার জবার কাধে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,”ওই কি বলছে ওনারা?”।জবা এইবার ধীরে ধীরে বলতে থাকে,”আমাকে ওনারা বউ করে নিবে।বাবা অবশ্য আমাকে বলেছিল রাজি না হতে কিন্তু বাবা যে মন থেকে চাচ্ছিল তার সম্মানটুকু থাকুক তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম।তাই হ্যা বলে দিয়েছি।বোনের জন্য, বাবা-মায়ের জন্য নিজের ভালবাসাটাকে না হয় স্যাক্রিফাইস করলাম।”বলতে বলতেই নিরব হয়ে যায় জবা।ছেলে মানুষ নাকি সহজে কান্না করেনা।কিন্তু শিমুলের চোখে যে পানি এসে গেছে সেটা ও ভালো করেই বুঝতে পারে।”এইসব কি বলছো,পাগলের মত,নিজের কথা একবারও ভেবেছো!
আমার কথাটা একবারও ভেবেছো!!এইরকম একটা সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পারলে??”প্লিজ আপনি অন্তত আমাকে দুর্বল করে দিবেন না।আমি আমার বাবা-মায়ের মুখে হাসি দেখতে চাই।আমি জানি খুব কষ্ট হবে আপনার,আমি নিজেও কষ্ট পাব।কিন্তু এখন ওনাদের না করে দিলে বাবার মান-সম্মান যে সব শেষ হয়ে যাবে।আপু একবারও কারো কথা ভাবল না।এমন একটা কাজ…”বলেই থেমে যায় জবা।শিমুল কি বলবে বুঝতে না পেরে রুম থেকে বের হয়ে সোজা ওদের বাড়ি চলে যায়। ওর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।ওর খুব কষ্ট হচ্ছে,আনন্দটা যে মুহুর্তে মাটি হয়ে যাবে ও বুঝতেই পারেনি।ওর মনে হচ্ছে ওর পৃথিবীটাকে কেউ তছনছ করে দিচ্ছে,সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় ছটফট করতে থাকে শিমুল।জবাকে ও হারাবে কথাটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও।হঠাৎ দরজায় খুব জোরে ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় শিমুলের।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে ৩টা বাজে।
তারমানে এতোক্ষণ ও ঘুমাচ্ছিল।এতো টেনশনের মধ্যেও যে মানুষ ঘুমাতে পারে তা ও আজ বুঝতে পারল।দরজা খুলতেই ওর মা হুড়মুড় করে ওর রুমে ঢুকেই চিল্লাচিল্লি শুরু করল,”এইরকম ঘুম পাগল ছেলে জীবনে দেখি নাই।বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হতো।তাতে ওর কি,ওরতো কিছু এসে যায় না।ওদিকে মেয়েটা আমার কান্না করতে করতে শেষ হয়ে গেলো।”শিমুল কিছুই বুঝতে পারছে না।”মা, কি হয়েছে সেটাতো বলবে নাকি শুধু আমাকে বকাই দিবে!!” ওর মা এবার একটু ধীরভাবে বলতে থাকে,”ওনারা বিয়েটা ভেঙে দেওয়ায় আমার মনে হচ্ছে আল্লাহ নিজে ওনাদেরকে বুঝ দিছে।আমার যে কি খুশি লাগছে। আমার ঘরের পুতুল আমার ঘরেই আসবে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
শিমুল ওর মায়ের কথায় চমকে যায়, তার মানে বিয়েটা হবেনা ওইখানে,ওর পুতুল ওর … ও আর চিন্তা করতে পারছে না।সোজা ওর মাকে জিজ্ঞেস করে,”আচ্ছা তুমি কি আমাকে একটু বলবে,কি হয়েছে!”‘আরে বিয়ের সব ঠিক, আমাদেরতো সেই মন খারাপ,এমন সময় ছেলের বাবা বলে উঠল যে, তারা এইরকম পরিবারে ছেলে বিয়ে দেবেনা।যেখানে এক মেয়ে বিয়ের আগের দিন পালায়, সেই পরিবারের আরেক মেয়ে যে বিয়ের পর পালাবেনা তারতো কোনো গ্যারান্টি নেই।তাই ওনারা চলে গেছে।” শিমুল কথাটা শুনে খুব খুশি হয়, যেন হারিয়ে যাওয়া কোন অমুল্য সম্পদ ফেরত পেলো।কিন্তু ওরা জবার নামে এমন কথা বলেছে এটা ভেবে মাথায় রাগ উঠে যায়, “কিহ! জবার সম্পর্কে এমন কথা বলার সাহস পায় কোথা থেকে!” ওর মা ওকে শান্তনা দিয়ে বলতে থাকে যে,”এখন চুপচাপ রেডি হয়ে নে।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।আমার অনেক কাজ আছে।” বলেই ওর মা রুম থেকে বের হয়ে গেলো।আর শিমুল ভাবতে থাকে,সত্যি ওর ছোটবেলার পুতুলটা ওর হতে যাচ্ছে। ভাবতেই অবাক লাগছে।কিছুক্ষণ এর জন্য যে ভয়টুকু ছিল সেটার জন্য যেন আরো আকর্ষন বাড়ছে তার পুতুলের প্রতি।