হাতটা বরাবরই ধরতে চেয়েছিল মনীষা।কিন্তু ঐ লোকটাই বারবার হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে সীমানার বাইরে।এই আপ্ত সান্ত্বনা বাক্যগুলো বারবার করে আওড়ে নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে মনীষা,হঠাৎ এরকম কোনো অস্বস্তিকর অনাকাঙ্খিত মুহূর্তে আটকে পড়ে।কিন্তু কতটা আর কাজে দেয় সেসব,মন কি বোঝে কিছু,সে তো দোষারোপের খেলায় মাততে চায় প্রতিমুহূর্তে।
শোকের বাড়ি।অতি পাষাণেরও বুক মুচড়ে ওঠে এমন কান্নার রোল চারদিকে।আগত মানুষজনের শুকনো মুখচোখ,সাজসজ্জা বিহীন রুখা শুখা চারপাশ।মাটি কাঁপিয়ে দেওয়া যন্ত্রণার প্রকাশ।সমস্ত আবেগ,অনুভূতি যেন ধুয়ে মুছে বিশুদ্ধ,নিখাদ,পবিত্র হয়ে ওঠার সাধনায় মগ্ন।মনীষা খেই হারিয়ে ফেলে বারবার এমন পরিবেশে।হয়তো নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে ভেতরকার আগ্নেয়গিরি,পবিত্রতার ধারাস্নানে ধুইয়ে দিতে চায় আগুনে পুড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে।কিন্তু ছারখার হতে ভয় পায় বড় মনীষা।কোনওদিন দুঃখ ছুঁয়ে দেখতে চায়নি।মানুষ ধরাছোঁয়ার বাইশ গজের জীবন পেরোলেই একবার,সমস্ত দোষগুণ অতিক্রম করে দেবত্ব অর্জন করে,এই আঁকড়ে রাখা সংস্কারের বশবর্তী হয়ে ঝটপট ছবির দিকে তাকিয়ে এক আঙুল কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে।তারপর রুনুর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে আশ্বাস দিতে চায়,কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ছুটে বেরিয়ে আসে কোনক্রমে।
রোজ এক টেবিলে বসা সহকর্মীর প্রিয়জন বিয়োগ,না গেলেই কি চলে একবার।কাছের মানুষ,বন্ধু,স্বজন এদের সাহচর্যেই তো শোক সামলে ওঠার নিয়ম।কিন্তু মনীষা যে পারেনা মোটে এই চলে যাওয়ার পর শোক পালনের রেওয়াজে অংশ নিতে।দম আটকে আসে,জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসতে চায়।এমন দিন তো তার জীবনের অভিজ্ঞতায় আসেনি তা নয়,কিভাবে সামলে ছিল সে শোক তবে,সেদিন?
দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে।হ্যাঁ দাঁতে দাঁত চেপে থেকে,না কেঁদে,না ফুঁপিয়ে,না আফশোস করে,না বুক চাপড়ে।সেদিন আরো একটু আগে ফিরলে অফিস থেকে,হয়তো বাঁচানো যেতো মানুষটাকে।হয়তো পাশে গিয়ে একটাবার বসে শোনা যেতো,তার কিসের অতো না ফুরোনো কষ্ট কয়েক ইঞ্চির বুকের নীচে।হয়তো হাতটা শক্ত করে ধরে,জড়িয়ে বললেই চলতো শুধু।পারতো না কি মনীষা,সেদিন আরো একটু আগে ফিরতে।পারতো না?
ঠিক এই প্রশ্নগুলো হুল বিঁধিয়ে বসে বুকে যে কারো চলে যাওয়া দেখলে।তাই তো অমন অস্থির লাগে,অসহায় লাগে মনীষার।বাড়ির সামনে এসে দেখে,দুটো বিড়াল সমানে লড়ছে মুখ ফুলিয়ে মুখোমুখি হয়ে পাঁচিলের কিনারে বসে,কেউ একচিলতে জমি ছাড়তে নারাজ।লড়াই তীব্রতর হচ্ছে ক্রমাগত,কিন্তু কেউ দূরে সরে যাচ্ছে না একে অপরের থেকে এতটুকুও,এক মুহূর্তের জন্যও।বরং আরও আরও অনেক বেশী কাছে এসে দুটিতে লড়ছে,আঁচড়ে কামড়ে।এ দুটোই মনীষার চেনা মেনি আর হুলো,মনীষা জানে,ওরা একটু পরেই পাশের বাড়ির জেঠিমার মেখে দেওয়া দুধভাত এক থালা থেকে ভাগ করে খাবে,কেউ কারো ভাগে থাবা বসাবে না,কেউ কাউকে ফেলে একা একা খেয়ে নেবেনা।
গলার কাছে অনেকক্ষণ আটকে থাকা কষ্টের টুকরো টা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হচ্ছে আস্তে আস্তে।হাল্কা লাগছে এবার।বিকেলের পড়ন্ত রোদের ফাঁকে আবছা ক্ষয়ে আসা চাঁদ টা আকাশের বুকে ভাসছে একলা,মনীষা মাথা উঁচু করে একবার তাকিয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে চলে,
“আমি আগে চলে এলেও সেদিন তুমি আমার হাতটা ধরতে না,সবাই হাত বাড়িয়ে দিলেও ধরতে জানেনা,ধরতে চায় না।ফেলে চলে যাওয়া কিছু লোকের ধাতে রয়েছে,বাঁচার আনন্দে মেতে থাকা তাদের ধাতে সয়না।শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটুকুই যাদের কাছে যথেষ্ট কারণ নয় জীবনের,তাদের ধরে রাখতে হাজার উপাদানও কম পড়ে যায়।সবাই যে বাঁচতে জানেনা,বাঁচার কারণ খুঁজতে জানেনা।মৃত্যুকে সমাধান ভাবা লোকের পলাতক জীবন আর যাই হোক আরও একটা গোটা জীবনের আফশোস ডিজার্ভ করেনা।হাত তোমার কাছেই ছিল,তুমিই ধরতে চাও নি কখনো।তাই দুনিয়া নিষ্ঠুর দাগিয়ে দেওয়ার আগেই,আমি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছি শুধু একফালি রোদ্দুরে বাঁচতে।একটা মৃত্যু কখনো আরও একটা বাঁচার অন্তরায় হতে পারেনা।বাঁচার মূল্য দিতে জানাটা অপরাধ নয়,বরং অধিকার।
আর জানো তো,যারা সাথে থাকতে চায়… তারা থাকে।ব্যস এটুকুই,যতটা বলতে আর শুনতে লাগলো ঠিক ততটাই সহজ।এর মধ্যে আর কোনো জটিলতা নেই কোনোখানে,কোনোদিন ছিল না।”
ততক্ষণে রাস্তার ধারে হুলো আর মেনি প্রাত্যহিক ঝগড়া সেরে গা চাটাচাটি করতে করতে দ্বিপ্রাহরিক আহারে মত্ত।
আহারে কতখানি দামী এ দৃশ্য,এই তো, মাত্র এই তো কটা মুহূর্তের সাথে থাকা।
আহারে ভালোবাসা! আহারে জীবন! আহারে বেঁচে থাকা!