অচেনা আলো

অচেনা আলো

ট্রেনটা সোদপুর ষ্টেশন ছাড়ার পর একটু ফাঁকা হল। সবাই একটু আরামে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় খড়দাহ থেকে একটা বছর পঁয়ত্রিশের লোক কোলে পাঁচ বছরের বাচ্ছাকে নিয়ে উঠলো, বাচ্ছাটা লোকটার ঘাড়ে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, কোনোরকম নড়াচড়া করছে না। লোকটা ভেতর দিকে ঢুকে এলো আর তারপর বলতে শুরু করল,
– আমার বড় দাদা, কাকু জ্যাঠুরা, আমি শ্যামনগর থাকি, রিক্সা চালাই।

আর এই যে কোলে বাচ্ছাটা, আমার মেয়ে পুষ্পা। ওর এখন পাঁচ বছর বয়েস। দাদারা কাকুরা ওর যখন চার বছর বয়েস ছিল তখন একটা তরকা জ্বরে ওর মাথায় রক্ত জমে যায়, তারপর থেকে আমার মেয়েটা কথা বলতে, চলতে বা বসতেও এমনকি খেতেও পারেনা। শুধু লিকুইড খাওয়াতে হয়। ডাক্টার বলেছে একটা অপারেশন করাতে হবে, তার জন্য ষাট হাজার টাকা খরচ। সারা দিন রিক্সা চালিয়ে যা আয় হয় তা ওর ওষুধেই চলে যায়, তাই বাধ্য হয়েছি আপনাদের কাছে হাত পাততে। যে যা পারবেন আমায় দিয়ে সাহায্য করুন, আমার মেয়েটাকে বাঁচান, এ টাকা আপনার বিফলে যাবে না।

এতক্ষন বলে লোকটা একটু থামলো। কথাগুলো বলতে বলতে লোকটার চোখের কোনটা ভিজে হয়ে এলো। ট্রেনের বেশীরভাগ যাত্রীরা তখন নির্বিকার। সবাই মননিবেশ করেছে তাদের ফোনে, কেউ বিসি ফেসবুকে, কেউবা চ্যাটিং এ, কেউ শুনছে গান বা কেউ দেখছে সিনেমা। কেউ বা পাড়ি দিয়েছে ঘুমের দেশে। কারোর হয়তো ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। কেউ কেউ শুনেও শুনলো না, বরং বিরক্তি প্রকাশ করলো, তিনজনের একটা গ্রুপ আলোচনায় বসল লোকটা সন্ধ্যাবেলা রিক্সা না চালিয়ে কেন ট্রেনে ভিক্ষে করতে এসেছে। ট্রেনটা টিটাগড় ঢুকলো। এরই মধ্যে জনা চারেক দশ টাকা করে দিয়েছে। টিটাগড় থেকে ট্রেনে উঠলো একটা কমলালেবুওয়ালা আর জোড়ে জোড়ে সুর করে বলতে লাগল,

– দাদাভাইরা বাছাই করা কমলা এনেছি। একবার নিয়ে দেখুন। চিনির মতো মিষ্টি। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই কে খাওয়ান মিষ্টি কমলা লেবু। তিনটে না চারটে না আজ দেব পাঁচটা কুঁড়ি টাকায়।

দু একজন লেবুওয়ালার থেকে লেবু কিনলো। ততক্ষনে পুষ্পার বাবা আবার আগের কথাগুলো বলা শুরু করেছে। কিন্তু সেরকম লাভ কিছু হল না। ট্রেনটা ব্যারাকপুর ঢুকছে, লোকটা তার মেয়েকে নিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো মনে মনে ভাবছে এই সমাজে মানবিকতার বড়ই অভাব, এতটুকু মেয়েকে দেখেও সবাই নির্বিকার, ঠিক তখনই পেছন থেকে লেবুওয়ালাটা ডাকলো, “ও ভাই।”

লোকটা পেছন ঘুরে তাকালো। লেবুওয়ালা ঝুড়ি থেকে বেছে একটা বড় দেখে লেবু তুলে বলল, “এটা নাও, কাল মেয়েকে এটার রস করে খাইয়ে দিও।” লোকটা হাত পেতে নিল লেবুটা। সে ভুল ছিল সবাই এখনও অমানবিক হয়ে যায়নি, এভাবেই কিছু মানুষের মধ্যে হয়তো মানবিকতা বেঁচে আছে। ট্রেনটা ব্যারাকপুর থামে, দুজনেই নেমে যায়, হারিয়ে যায় শহরের চেনা ভীড়ে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত