“কেমন আছো ইনায়া? ”
প্রশ্নকারীর দিকে না তাকিয়েই হালকা করে কফির কাপে চুমুক দিতে লাগল ইনায়া।মনে হলো সে যেন প্রশ্নটি শুনতেই পায় নি। অথচ এহসান সাহেব এখানে আসার আগে বেশ উত্তেজনা নিয়েই প্রবেশ করেছিলেন সেই প্রিয়মুখের বিলাসবর্জিত বিলাসভবনে।ভেবেছিলেন আজ বুঝি এক অদ্ভুতদর্শনে তার হৃদয়ের ঢিপঢিপ শব্দময় রিক্তের বেদন ছিন্ন করবে তার প্রিয় মানুষটি যে ছিল তার জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম নারী। এখনো মনের মধ্যে উকি দেয় সেই ভার্সিটি লাইফের ছিপছিপে বাদামী চোখের কালো ফ্রেমের চশমা পড়া মেয়েটা! কি অদ্ভুতভাবেই পরিচয় হয়েছিল তাদের! পরিচয় ঠিক বলা চলে না, এটাকে সংঘর্ষ অথবা সংঘাতময় ঘটনা বলাটাই বোধ হয় শ্রেয়।
প্রায় সাড়ে সাত মিনিট পর ইনায়া তার কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে এহসান সাহেবের দিকে তাকালেন। এই তাকানোর মাঝে নেই কোনো ভালবাসা, নেই কোনো বিষাদ।এ যেন অদ্ভুত প্রকট এক দৃষ্টি যেখানে পূর্ণ অর্থ বিদ্যমান। কিন্তু সেই অর্থপূর্ণ দৃষ্টির মাঝেও কোথায় যেন চাপা পড়ে আছে মরিচীকার মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে একটি হলুদ গোলাপের লাল অভিমান!!
এতক্ষন ইনায়ার দৃষ্টিতে কিছু খোজার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন এহসান সাহেব।তার চেষ্টাকে থামিয়ে দিয়ে এবার ইনায়া বলে উঠল- ” কিছু কী বলতে চান মিস্টার?” ইনায়ার স্পষ্ট কণ্ঠের বাক্যে নিজের চেষ্টা অভিযান বন্ধ রেখে একটি সিংগেল সোফায় স্থিরভাবে বসলেন তিনি।
এহসান সাহেবের ঠিক সামনের একটি সিংগেল সোফায় বসে রয়েছে ইনায়া, দুজনেই মুখোমুখি , দুজনের চোখেই পূর্ণ অথচ রিক্তদৃষ্টি ।সে তার স্বভাবমতোই অস্থির অথচ শান্ত চোখে দেখছে উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত উদার মনের মানুষটিকে।এই মানুষটাই কত পাগল ছিল শুধুমাত্র তার জন্য! ভাবা যায়! কি অদ্ভুদ সুন্দরভাবেই সে তাকে বেধে ফেলেছিল বন্ধুত্বের বাঁধনে! এটাকে কি শুধুই বন্ধুত্ব বলে এটা আজও ভেবে পায় না ইনায়া। আজকাল অবশ্য সে আর ভাবছেনা সেসব। ভাবছে না বললে ঠিক মিথ্যা বলা হয়, সে আসলে ভাবতে চাইছে না। কিন্তু হায় কি নিষ্ঠুর এই মন , মস্তিষ্ক! এহসানকে বিন্দুমাত্র হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে সরাতে সক্ষম হচ্ছে না সে।
ইনায়ার মনে পড়ে যায় কি পরিমানে দূরন্ত ছিল এহসান। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমাকে চড় মেরে বসেছিল..আর এটাই ছিল আমাদের ঝগড়া এমনকি বন্ধুত্বেরও সূচনাপর্ব। সেইদিন এক অচেনা ছেলের এরকম থাপ্পর খাওয়ার পর আর কিছু বলে উঠার সাহস পাই নি, শুধু বিড়ালছানার মত মিউমিউ করে করে কেঁদে উঠেছিলাম। এরপর থেকেই শুরু হয় তার উৎপাত।যখন তখন হুটহাট করে এসে চুল টানে, কখনো বা আমার শখের ড্রয়িং খাতাখানা সবার সম্মুখে মেলে ধরে বত্রিশটি দঁাত দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আর আমি বরাবরের মতোই শান্ত অথচ অস্থির তাই ডেবডেবিয়ে তাকিয়ে রাগি লুক দেয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই পারতাম না।
এহসান হুট করে একদিন এসে বলে “ইনায়া তোমাকে আর জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না।চলো না বন্ধু হয়ে যাই। ” সেই স্থির অথচ শান্ত আমি তার এমন স্পষ্ট সুন্দর বাক্য শুনে সেদিন প্রথম তার ডান গালে একটা চড় মেরেছিলাম।
সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ” আমি কিন্তু জানি তুমি আমার বন্ধুত্ব চাও, তাই এখন ভাব নিলে পরে আফসোসের সীমা থাকবে না তোমার। আর এ চড় দিয়ে কি তোমাকে দেয়া প্রথম চড়ের শোধ নিলে? বাট ইনায়া
আমি তোমাকে বাম গালে মেরেছিলাম মনে আছে তোমার?” এই বলে সে ভুবন কাঁপিয়ে আকাশ বাতাশ এক করে হাসিতে ফেটে পড়ল।
ইনায়ার বিলাসবর্জিত বিলাসভবনের ড্রয়িংরুমের দেয়ালে একটা পেইন্টিং দেখে চোখ আটকে যায় এহসান সাহেবের। মনে পড়ে যায় ইনায়া তাকে চড় দেয়ার ঠিক ২ দিন পরেই এসে বলেছিল” এহসান তুমি তো দেখছি সত্যিই আমায় জ্বালিয়ে মারবে। তোমার বন্ধুত্ব কে অবজ্ঞা করার মত সাহস পাচ্ছি না যে। ” তার কিছুক্ষন পরেই অস্থির হয়ে বলেছিল “তুমি কি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াবে?” আর সেদিন রাতেই নিজের অাঁকা প্রিয় পেইন্টিং টা গিফট করেছিলাম।
এভাবেই আমাদের বন্ধুত্বের দিনগুলি কাটছিলো অসম্ভব চমৎকারভাবে।ইনায়ার গানের কণ্ঠ ছিল ভীষন অাকর্ষনীয় অন্তত আমার কাছে। বরাবরই ভীষন লাজুক ইনায়া শুধুমাত্র আমাকেই তার গান শোনাতো, মাঝে মাঝে আমার গান শুনে অদ্ভুত এক হাসি দিত আর বলতো, ” দেখ এহসান,তোমার গলা কিন্তু খারাপ না।কিন্তু গানটা যে তুমি কেন এতো খারাপ গেয়ে ফেলো আমি সত্যিই বুঝে পাই না!” এটা বলেই সে দিয়ে দেয় তার চমৎকার অদ্ভুত হাসিটা!আমি শুধু তাকিয়ে থাকি তার বাদামি চোখ দুটোর দিকে যার ভিতরে বিশাল এক সমুদ্র! ভার্সিটি লাইফের শেষ দিনে ইনায়া আমাকে বলেছিল” এহসান, আমি তোমাকে প্রচন্ডভাবে চাই।তোমার বন্ধুত্বটা আমার সারা জীবনের জন্য দরকার। তোমার অই অদ্ভুত গলার কুৎসিত গানগুলো আমি সারাজীবন শুনতে চাই।শোনাবে?
ইনায়ার এরকম কথায় আমি বেশ উচ্চ স্বরে হেসে উঠেছিলাম। বলেছিলাম ” ইনায়া মহিলা কবি হয়েছো কবে থেকে বলতো! তোমার কথাগুলো দিয়ে একটা কাব্য লিখে ফেলতে পারবা বুঝেছো। তুমি আমাকে চাও, আমিও তোমাকে চাইতাম। কিন্তু এখন সামনে ফিউচার.. এসব উটকো আবেগকে কি করে পাত্তা দেই বলতো।”
এহসানের এরকম উত্তর পাবো বলে ভাবি নি কখনোই। তার এমন প্রত্যাখ্যান সেদিন কি করে সহ্য করেছিলাম আমি জানি না।তবে তার সাথে যোগাযোগ একদমই রাখি নি। যাকে সারাজীবনের জন্য পাব না, তার সাথে এই কষ্টকর দূরত্বময় বন্ধুত্ব রাখার কোনো মানেই হয় না। সেই শান’ত আমি আজ আর কারো চোখে নিজের জন্য ভালবাসা রাখি না, নিজের চোখেও নেই ভালবাস।আছে শুধু রিক্ততা!জীবন কেন এমন হতে হয় বলতে পারেন? কেন ভালবাসলে মনকেই কেন
ব্যথা পেতে হয়?
এহসান বেশ কয়েকবার এসেছিল বিলাসভবনে সেই কয়েকবছর আগে । প্রতিবারই ইনায়ার সাথে বিলাসভবনে এসে বাড়ির নাম নিয়ে যে কত্ত বার ইনায়ার পেছনে লেগেছে,ঝগড়া হয়েছে, মান অভিমান হয়েছে, ভেংেগ ও গেছে।আজ ঠিক ৫ বছর পর দেখছে সে তার ইনায়া কে।বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি ইন্যা,শুধু চোখের নিচের কালিটা দীর্ঘ হয়েছে।আর আগের থেকেও শান্ত হয়ে গেছে ইনায়া।ইনায়া এবার বলে উঠলো ” আপনার কি সত্যিই কিছু বলার আছে? আমার মনে হচ্ছে নেই।তাই আপনি আজ আসুন প্লিজ!”
এহসান সাহেব ইনায়ার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন” ইনায়া ভালবাসায় কি শুধু মান -অভিমান আছে? প্লিজ, স্যরি এই শব্দগুলি নেই? ইনায়া মানুষ কি ভুলের ঊর্ধ্বএ? জানো ইনায়া,আমি আমার এই ব্যস্ত জীবনেও তোমার শূণ্যতা অনুভব করি। আমার নীল আকাশে সাদা পাখিটি হয়ে আবার ফিরে আসো প্লিজ ইনায়া আমি ভীষণ স্যরি! ”
ইনায়ার সাধ্য নেই তার এই বন্ধুটির আহ্বান উপেক্ষা করার! আকাশে উড়তে পারার স্বাদ কি করে পাখিটি উপেক্ষা করবে!