সাবধানে আওয়াজ না করে গেটটা খুলল তিথি।
একটু বেশিই রাত হয়ে গেল আজ বাড়ি ফিরতে।
আসলে নাচ দেখতে দেখতে এতটাই বিভোর হয়ে পড়েছিল যে কখন যে কাঁটায় কাঁটায় দশটা বেজে গেছে সেটা খেয়াল করেনি।
দিশানী বলল,”এই..ঝাড় ত আজ তুই খাবিই। আমি কি একবার বলব কাকুকে কিছু একটা বানিয়ে? তবে যদি”
_” নারে। মিথ্যা বলছি বুঝতে পারলে বাবা আরও রেগে যাবে। তুই সাবধানে বাড়ি চলে যা। আমি ম্যানেজ করে নেব।”
দিশানীকে হাত নেড়ে আস্তে আস্তে কলিং বেলটা টিপল তিথি।
দরজা খুললেন মা।
পিছনে বাবা দাঁড়িয়ে।
তিথির মনে হল যেন অঙ্ক পরীক্ষার দিনেও এত ভয় লাগেনি।
বাবা গমগমে গলায় বলে উঠলেন,” থাক। কোন এক্সকিউজ তোমার থেকে শুনব বলে এত রাত অবধি এখানে দাঁড়িয়ে নেই আমি। আজ যেটা করলে সেটা ভবিষ্যতে কোনদিন করার সাহস দেখিও না। তুমিই পস্তাবে।”
_” মানছি আমার ভুল হয়েছে বাবা। কিন্তু আমি ত মেলাতেই গিয়েছিলাম। অন্যায় ত কিছু করিনি।”
_” তুমি মেলাতে তনুশ্রী শংকরের নাচের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলে।”
_”কক্ কিন্তু…”
_” মিথ্যে বলার চেষ্টা কোরোনা। আজ যে মেলায় তনুশ্রী শংকরের অনুষ্ঠান আছে সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। তোমাকে আর দিশানীকে বসে অনুষ্ঠান দেখতে দেখেছি আমি।”
_” কিন্তু বাবা..নাচ কি খারাপ?”
_” যে জিনিস আমার থেকে আমার প্রথম সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, তাকে আমি কোনদিনও পছন্দ করতে পারবনা তিথি। এইট অবধি তুমি নাচ শিখেছ, কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আর নয়।”
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে তিথি। নাহ্, হাজার ইচ্ছা থাকলেও পনেরো বছরের মেয়েটা বাবার মুখের ওপর বলতে পারেনা যে না.. পারবনা আমি নাচকে ছাড়তে। একমাত্র ঈশ্বরপ্রদত্ত জিনিসটা আমি তোমাদের ভ্রান্ত ধারণার জন্য জলাঞ্জলি দিতে পারবনা।
বাঁচতে দাও আমাকে,আমার নাচকে।
ঘরে দরজা বন্ধ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। সে যে আজ কত স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। একদিন সেও একজন অনেক বড় নৃত্যশিল্পী হবে। এভাবে সেও একদিন পারফর্ম করবে। অনেক মানুষ তার নাচ পছন্দ করবে। কত্ত হাততালি পড়বে।
দেওয়ালে টাঙানো দিদির ছবিটাকে আর সহ্য হয়না তিথির। নিজে গেল, সাথে করে বাবার মনে নাচ সম্পর্কে বিষ ঢুকিয়ে গেল। ছবিটা নিয়ে গায়ের জোরে আছড়ে ফেলে তিথি। চুরমার হয়ে পড়ে থাকে কয়েকটা কাচের টুকরো।
কেটে যায় ন’টা বছর।
আজ তিথির বৌভাত।
সৌরভ ভাতকাপড়ের থালার সাথে সাথে হাতে তুলে দেয় একজোড়া ঘুঙুর।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকায় তিথি।
শ্বশুরমশাই মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,” এখনো সময় আছে। নাচটা আবার শুরু করো।”
_” কিন্তু আংকল…”
_” জানি। তোমার বাবা মানবেননা। তোমার দিদির নাচের অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফেরার পথে ঘটা অ্যাক্সিডেন্টের জন্য ভদ্রলোক নাচকেই অপয়া বলে ধরে বসেছেন। চিন্তা কোরোনা। ওনাকে আমি বোঝাব।”
_” বাবা চিরটা কাল আমাকে নাচের থেকে দূরে রেখেছে আংকল। কোনদিন বুঝতেই চায়নি আমি কি চাই।”
_” পুরোপুরি ওনাকে দোষ দেওয়া যায়না মা। বড়মেয়েকে হারিয়ে উনি তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন। তাই চাননি তুমি নাচ শেখো। বাবাকে কখনও ভুল বুঝোনা মা। ”
_” থ্যাঙ্কিউ আংকল”।
_” বাবা বলে ডাকবি কবে বল?”
তিথি চোখ ভরা জল নিয়ে ফিক করে হেসে বলে,” বাবা!”