গুঞ্জা এখন নয় বছরের |
ফুটফুটে একটা বাচ্চা | ও কথা খুব কম বলে | চোখগুলো সবসময় যেন শ্যাওলা পরা ভিজে ভিজে | বিকেলে যখন সারাপাড়ার কচিগুলোর হাসি মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গুঞ্জা তখন ওর ঘরের পর্দা টেনে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করছে | ঘুম আসেনা অনেক রাত অবধি | হাঁটুঅবধি ফ্রকটা নামানোর চেষ্টা করে পায়ের আঙ্গুলঅবধি যতক্ষন না ঘুম আসে | চোখ বন্ধ করলে স্বপ্নেও হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যায় সেই রাক্ষসটা | খুব ভয় করে গুঞ্জার |
প্রায় একবছর হলো গুঞ্জার শরীর জুড়ে রাক্ষসটা বসত গেড়েছে | কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে দিন , সপ্তাহ , মাস প্রায় বছর | কামড়ে , ছিঁড়ে নিচ্ছে ওকে | ওর দগদগে ক্ষতটা কেউ দেখতে পাচ্ছে না |
ওর মা দীপান্বিতা একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে রয়েছে , বাবা বোম্বেতে কর্মরত বছর দেড়েক | দীপান্বিতা সকাল আটটা সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে ওঠে | মেয়ের স্কুলের জামা , ব্যাগ একজায়গায় জড়ো করে রাখে | ঘুম থেকে গুঞ্জাকে তুলে হাতে বই দিয়ে বসিয়ে দেয় | দীপান্বিতা নিজের , মেয়ের টিফিন রেডি করে স্নান সেরে সেজে খেতে বসে | দশটায় বেরিয়ে যায় | ফেরে রাত আটটা সাড়ে আটটায় | ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম , মোবাইল ঘাটাঘাটি চলে অনেক্ষন | গুঞ্জার সাথে কথার মধ্যে সারাদিন পড়াশোনা করেছে কিনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাস্য | মেয়েটা ওর মাকে প্রচন্ড ভয় পায় | ও বোঝে মা কে সব কথা বলা যায় না , মা বকবে মারবেও |
গুঞ্জার মা অফিস বেড়িয়ে গেলে ওকে রেডি করিয়ে স্কুলে পাঠানোর দায়িত্ব ওর ঠাম্মার | ঠাম্মার খুব কষ্ট হয় এতো কিছু সামলাতে কিন্তু মার চিৎকারের কারণে ঠাম্মা মুখ বুজে আছেন অনেক কাল | দীপান্বিতার অঙ্গুলিহেলনে গোটা সংসার চলছে |
গুঞ্জা স্কুল থেকে ফিরলে ওর বাড়ির ম্যাম আসেন | এর মধ্যেই রথীন এসে পরে যে কোনোদিন সুযোগ মতো | রথীন দূর সম্পর্কে ওর দাদা | রথীন আসলে গুঞ্জা ওর ঠাম্মার কাছে সিঁটিয়ে থাকে | গুঞ্জার পড়াশোনার প্রতি রথীনের খুব আগ্রহ | বলে ” দেখি তোর পড়াশোনা কতদূর ? মেয়েটার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে যায় ওদের ঘরে | এ সি চালিয়ে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে দেয় |
গুঞ্জার চোখের তোলার কালি আরো আরো স্পষ্ট হয় |
এতক্ষন যা বললাম তা মোটেও গল্প নয় | তবে স্থান, কাল , নাম পরিবর্তন করলাম| সত্যি বলতে কি ভয় পেয়েছি ভীষণ| যেদিন কানে এলো সেদিন গুঞ্জার কাছে ভীষণ পৌঁছতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, পারিনি| আমি ন বছরের গুঞ্জাকে দেখেছি| এই ঘটনাগুলো সংবাদ পত্রে উঠে আসেনা| আর সংবাদপত্রে উঠে এসে কোনো কাজের কাজ কতটা হয় আমার সঠিক জানা নেই|
তবে এমনই গুঞ্জা আরো অনেক আছে জানেন? হয়তো আমার আপনার পরিচিত|
প্রশ্নটা তবু অন্য জায়গায় সমস্ত বাচ্ছাগুলোর আশ্রয় কি আমরা সমস্ত মা বাবা আদৌ হতে পেরেছি? কেন গুঞ্জা ওর মাকে বলতে পারেনি মন খুলে ? কেন মনে হয়েছে ন বছরের মেয়েটার সব কিছু মাকে বলা যায়না? কেন তৈরী হচ্ছে কোনঠাসা গুঞ্জারা| দায় কার? ঘটনাটা শুনে মনে হলো বৃদ্ধাশ্রম গড়ে ওঠার এও এক কারণ নয়কি? তা অস্বীকার করা কি খুব অসম্ভব ?