চালের টিনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথাটা গরম হয়ে গেলো নীহারিকা দেবীর,চালের কৌটো হাফ কৌটো মাত্র চাল,মানে আজকেও আধ পেটে দিন কাটাতে হবে, কি জানি আজও বুড়োর কিছু আয় হবে কিনা ,না হলে কাল উনুনে হাঁড়িই চড়বে না | কি আর করা যাবে ওই চাল হাড়িতে বসলেন ,নেই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভালো, উপোষ করার চেয়ে আধ পেটে থাকা ভালো| উঠোনে অনেক শাক হয়েছে,তাই শাক আর ফ্যান ভাত করবেন বলেই মনস্থির করলেন | ভাত ফুটছে, বাড়ির দাওয়াই পা ছড়িয়ে বসে আছে নীহারিকা দেবী,ভাদ্র মাসের দিন,সূর্য্য তখন মধ্য গগনে ,তখনো নীহারিকা দেবীর স্বামী তপন বাবু বাড়ি ফেরেনি” সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো কেন যে বুড়োটা বাড়ি এলো না কি জানি ” নিজের মনে বলে উঠলেন উনি |
তপন বাবু আর নীহারিকা দেবী নিঃসন্তান ,তবে ওই নিয়ে দুজনের মধ্যে তেমন অভিযোগ নেই,ওনারা দুজন একে ওপরের সাথী..তবে এখন অভাবের জন্য খিটমিট লেগেই থাকে দুজনের মধ্যে,খড়ের ছাওনি দেওয়া মাটির ঘর ওনাদের,এবার বর্ষায় ঘরে জল পড়েছে ,কিন্তু নতুন খড় দেওয়াও মতো পয়সা নেই..অথচ এক সময় ওনাদের কত ভালো সময় ছিল ,দুবেলা পেট ভরে ভাত,মাঝে মাঝে মাছ,মাংসও জুটত | তখন রায় বাড়িতে পাকা পাকি মালির কাজ করতো তপন বাবু ,সবাই বলতো ওনার
হাতে নাকি জাদু ফলত ,তাই ওনার হাতের লাগলো গোলাপ রায় বাড়ির শোভাবর্ধন করতো | কখনো একটা লাল গোলাপ তুলে এনে নীহারিকা দেবীর খোঁপায় লাগিয়ে কানে কানে ফিশ ফিশ করে বলতেন ” তোমাকে আমি সারাজীবন আমার ঘরের রানী করে রাখবো ” স্বামীর মুখে ওই কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যেতেন অষ্টাদশীর নীহারিকা দেবী | এখন সেই রায় বাড়ি থাকলেও বাড়ির সদস্যরা সব বাইরে থাকে,আর গোলাপ বাগানও অনাদরে শুকিয়ে খাক হয়ে গেছে |আর তপন বাবুও কপর্দকহীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ,তাও এর বাড়ি মাটি কেটে ওর বাড়ি গাছ কেটে কিছু উপার্জন করতো | কিন্তু এখন আর সেই জোয়ান বয়েসও নেই ,রক্তের জোর ও কমেছে ,এখন তাই কেও আর তেমন ডাকেনা,ডাকলেও শুধু গাছের মাটি তৈরী করতে আর সার দেওয়ার জন্য | কি জানি কখনো আর সু দিন আসবে কিনা,না এমন করেই দিন গুজরান হবে এই সব আকাশ পাতাল ভাবছিলেন নীহারিকা দেবী|
“ও গিন্নিইই ” তপন বাবুর ডাকে ওনার ভাবনায় ছেদ পড়ে…
“বলি ভাত হয়েছে ,দুটো খেতে দাও “বলে আবার হাঁক দিলেন তপন বাবু | তপন বাবুর হাতে একটা আম গাছ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন
” আজ কিছু উপার্জন হলো ? এই আম গাছ টাকে কোথায় পেলে ?”
নীহারিকা দেবীর প্রশ্ন শুনে মুখ চুল হয়ে গেল,,মুখে বললো ” না কিছু হয় নি দেখো গিন্নি এটা আম্রপালি গাছ,সেন কর্তা দিলো মাটি সমেত
তুলে আনলাম ,দেখো পরের গ্রীষ্মে আম ধরবে ”
” হায়রে ! ওরে মুখ পোড়া মিনসে ঘরে যে চাল নেই ,কাল থেকে যে হাঁড়ি চড়বে না সেই খেয়াল আছে ?? আর উনি আম খাবেন ”
“আমি এই গাছের আম না খেয়ে মরবো না”
“তো মরো, তুমি আম খেয়েই মরো ”
“আমি মরবো ?দাঁড়া বুড়ি তোর দেখাচ্ছি মজা ” ধুন্ধুমার লেগে গেলো দুজনের…
শরৎ পেরিয়ে শীত এলো গাছ টা বেশ বড়ো হয়েছে,ছেলের মতো পরিচর্যা করেন তপন বাবু নীহারিকা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন ” দেখো এবার মুকুল আসবে,কলমের গাছ তো অনেক ফল দেবে ,আম আমরা বাজারে বিক্রি করবো, দেখবে আমাদের অভাব থাকবে না ”
এই ছোট গাছে কতই বা ফল হবে, কয়েক দিন ধরে বুড়োর শরীর ভালো যাচ্ছেনা,তাই মুখ ঝাম্পটা না দিয়ে বললেন তাই হবে| বসন্তের হাওয়া লাগতেই আম গাছে কচি কচি পাতা সমেত মুকুল এলো,তা দেখে তপন বাবুর খুশি দেখার মতো” কে গাছ লাগিয়েছে দেখতে হবেনা ? আমার হাতে লাগানো গাছে ফল না হয়ে পারে ?আদরের ধন আমার “বলে শীর্ণকার দেহ টা কে নিয়ে হাততালি দিয়ে নেচে উঠলেন |
না আম খাওয়া আর হয়নি তপন বাবুর ,তার দিন সাত পর হটাৎ স্বাসকষ্ট শুরু হয় পাড়ারলোক ডাক্তার ডেকে আনলে ডাক্তার পরীক্ষা করে,মৃত বলে ঘোষণা করে ওনাকে|
শোকে পাথর হয়ে যান নীহারিকা দেবী,চোখ থেকে এক ফোঁটা জল ও বের হয়না| তারপর থেকে বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেয়,নিজেকে ঘর আর উঠোনের উপর আবদ্ধ রাখে,কারুর সাথে কথাও বলতো না| যেই আম গাছের উপর গুপ্ত রাগ ছিল ওনার ,নাওয়া খাওয়া ভুলে ওটাকেই আঁকড়ে ধরে, সন্তানের মতো লালন পালন করেন| কখনো পাড়া পড়শীরা খাবার দিয়ে যায়,আবার কখনো পেটে টান পড়লে মন্দিরে গিয়ে ভিক্ষা করে দিন কাটায় নীহারিকা দেবী,তবে বেশির ভাগ দিন উপোষ করেই করে কাটে ওনার | বৈশাখ মাস আম গুলো দিন দিন বড়ো হচ্ছে ,সেই দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীহারিকা দেবী,” পরের মাসে আম পাকুক আমি খাবো,বুড়ো খাবে ” বিড়বিড় করে নিজের মনেই বকেন উনি | একদিন জল আনতে গেছেন,সেই সুযোগে একটা গরু বাঁশের বেড়া দিঙ্গিয়ে ঢুকে দু হাত লম্বা আমগাছের আম সমেত পাতা মুড়িয়ে খেয়ে যাচ্ছে ..ওটা দেখেই চিৎকার করে উঠলেন নিহারিকা দেবী ” এই হট্ হট্ ” ওনার চিৎকার কর্ণপাত না করে গরুটি তখনও পাতা খাচ্ছে ,রাগে মাথা গরম হয়ে যায় ওনার হাতের সামনে একটা লাঠি পেয়ে ছুঁড়ে মারে,গরুটির পায়ে লাগাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার বেড়া টপকে পালাই হাওমাও করে কাঁদতে থাকে নীহারিকা দেবী,ওনার কান্নার শব্দে আসে পাশের সবাই ছুঁটে আসে,এমনি কাঁদতে কখনো দেখেনি কেও,
তপন বাবু মারা যাওয়ার সময়ে ও না | সেদিন দিন পর আরো ঘর কুনো হয়ে গেলেন উনি,রাত শেষ হতে না হতেই উঠে,দাওয়াই বসে থেকে পাহারা দিতেন কোথাও বেরোতেন না,পাড়ার সবাই পালা করে ওনার দু বেলা খাবার দায়িত্ব নিলো | বর্ষা কাল এলো,গাছে আবার কচি কচি পাতা গজালো যতই বৃষ্টি হোক উনি কুঁয়ো থেকে দু বালতি জল ঢালতেন..বর্ষাকাল গেলো, শরৎ শীত কাল পেরিয়ে বসন্ত কাল এলো গাছে আবার মুকুল এলো নীহারিকা দেবী পাহারা আরো বেড়ে গেলো,হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন গাছের দিকে,কুঁড়ি খানার মত আমি ধরেছে ওই ছোট্ট গাছে গাছটার এক একটা পাতা কে হাত বোলান উনি| জৈষ্ট্যের শেষ আমে পাক ধরছে,আর কয়েক দিনের
অপেক্ষা অপেক্ষার অবসান হলো,গাছ থেকে মাত্র একটা আম তুলে ঘরে এনে ,ট্রাঙ্ক থেকে পুরোনো একটা তপন বাবু ও ওনার ছবি বার করে বললেন ” ও গো নাও আম খাও ”
পরের দিন সকালে নীহারিকা দেবীকে বাইরে বেরোতে না দেখে ,কৌতূহল বশত ওনার ঘরে ঢুকে গ্রামবাসীরা ওনার দেহ উদ্ধার করে,হাতের মুঠোয় তখনো শক্ত করে ধরা আমটি …