অমল যার মনে কোনো ময়লা নেই।অমল বাবু একজন ব্যাঙ্ক এর ক্লার্ক।সত্যিই ভদ্রলোকের মনে কোনো অসৎ ভাব নেই।স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে সংসার।কল্যাণী তে একটা মাঝারি মাপের ফ্লাট আছে যেটা 20 বছরের লোন এ নেয়া।
স্ত্রীর সাথে খুব একটা বনিবনা হয় না স্ত্রীর হাই ক্লাস মেন্টালিটি আর তার মধ্যবিত্ত মানসিকতা একদমই বেমানান।যাই হোক ব্যাঙ্কের কর্মী অমল বাবুর নাম ডাক আছে কল্যাণী শহরে।
স্ত্রী যাই বলুক ছেলে মেয়েদের সল্প আয়ের মধ্যে মানুষ করতে ভদ্রলোক তৎপর।
ছেলে অর্ক ক্লাস 8 এ পড়ে মেয়ে ত্রিধা ক্লাস 3 এ পড়ে।
ছেলে অর্কর বন্ধু মহল টা বেশ হাই ক্লাস গোছের সেখানে বড়ো বিসনেস ম্যান এর ছেলে যেমন আছে,তেমন আছে বড়ো কোম্পানির ম্যানেজার এর ছেলে।ক্লাস 8 এ পড়লেও অর্কর মাসে একদিন ভালো হোটেল এ খাওয়া,বন্ধুর বাবার গাড়িতে ঘুরতে যাওয়া এসব আছেই।
অনেক বার অর্ক কে যদি বাবা পকেট খরচ না দেয় তাও চাপ নেই বন্ধুরা খাওয়াতে প্রস্তুত শুধু একটাই কথা বলে “আসলে অর্ক তোর বাপ একটু গাইপু তাই এসব আদব কায়দা পছন্দ করে না”।
অর্ক গিয়ে বাড়িতে বলে তখন যতই হোক একটা গায়ের জ্বালাতে কখনো কখনো আবার টাকা দেয়।অমল বাবুর হয়েছে এই এক বিপদ টাকা দিলে ছেলে উছনে যায় টাকা না দিলে বউ কথা শোনায়।
ছেলে কথা শোনায়।আর জুটেছে অর্কর এক মামা,বাবা টাকা না দিলে মামা জোগাড় করে দেয়।
এভাবেই চলছিল বছর দুই।অর্ক যেবার মাধ্যমিক পাস করলো সেবার জেদ ধরলো বাইক কেনার তাও আবার রয়েল এনফিল্ড যার বাজারের মূল্য 1 লক্ষ 65 হাজার।
অর্কর বাবা অমলবাবু তো একদমই নারাজ এই টুকু ছেলে এতো টাকার বাইক কিনবে।অমলবাবু নিজের ভেস্পা স্কুটার টা এগিয়ে দিয়ে বললেন এটাই চালাও।অর্ক বললো “ওসব পুরোনো গাড়ি তোমার মতো গাইপু রা চালায় আমি না”।
অমল বাবু বললেন “মুখ সামলে কথা বলো নিজে রোজগার করে কেনগে যাও”।
অর্ক বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো বললো “আমি চললাম বাড়ি ছেড়ে গাড়ি কিনে দিলে তবেই বাড়ি ফিরবো”। তখন সকাল 10 টা বাজে অর্ক বেরিয়ে গেলো।অর্কর মা বললো কি গো ছেলে তো বেরিয়ে গেলো।
অমল বললো “যেতে দাও যখন পেটের জ্বালা হবে তখন নিজেই ফিরবে”।
এই বলে অমল বাবু স্কুলে চলে গেলেন।
বেলা 5 টার সময় অমল বাবু বাড়ি ফিরে দেখলেন ছেলে তখন বাড়ি ফেরেনি বউ মুখ ঝামটা দিয়ে বললো “আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল ভালোবেসে তোমার মতো অমানুষ কে বিয়ে করা।নিজে তো শান্তি পেলাম না পেটের ছেলেটাও ঘরছাড়া হলো”।
অমল বাবু বললো “তুমি কি চাও আমি অতো টাকার বাইক কিনে দিই আমার কি এতো রোজগার আছে, মাস গেলে লোন এই সব টাকা চলে যায় তার পর ছেলে মেয়ের পড়াশুনা,সংসার খরচ”।
স্ত্রী বললো “যদি চাহিদা মেটাতে পারবে না তো ছেলের জন্ম দিয়েছিলে কেন? আমি এক্ষুণি দাদা কে বলে পয়সা জোগাড় করছি তুমি ছেলেটাকে ফিরিয়ে নিয়ে এস”।
অগত্যা অমল বাবু বললো “তার দরকার নেই আমি লোন নেবো ছেলে যখন আমার দায় তখন আমার”।
অমল বাবু চোখে জল ফেলতে ফেলতে আর নিজের ভাগ্য কে দোষারোপ করতে করতে ছেলে কে খুঁজতে গেলো।ছেলে বড়ো রাস্তার ধারে কালভার্টের ওপর বসে আছে।ছেলেকে দেখে বললো বাড়ি চল।ছেলে বললো” আমি এখানে বসে থাকবো বাড়ি গিয়ে কি তোমার কিপটামি দেখবো”।লোকের বাবারা কত কিছু দেয় iphone, দামি wristwatch, কার, আর আমার বাবা কিছু বললেই বলে নিজে রোজগার করে কেন।
সবই যদি নিজে রোজগার করে কিনবো তো বাবা কি জন্য দরকার।
অমল বাবু ছেলেকে বললেন চল বাড়ি চল।ছেলে বললো “আগে বলো বাইক দেবে”।অমল বাবু রাগত ভাবে বললেন দেখা যাবে।
অর্ক বললো “আমি বাড়ি যাবো না কি করবে তুমি।এখানেই মরবো তুমি শান্তি পাবে”।অর্ক ছুটে গিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়লো বললো “আমার ডেড বডি নিয়ে যেও”।বাবা ছুটে গিয়ে অর্ক র হাত ধরে বললো “চল ঘরে চল”। অর্ক বললো “বললাম তো যাবো না”।
অগত্যা অমল বাবু ছেলের কাছে হাত জড়ো করে বললেন “চল ঘরে চল আমি ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে তোর বাইক কিনে দেব”।
অর্ক ঘরে ফিরে এলো।
কিছুদিন পরে রয়েল এনফিল্ড অর্কর হাতে।বাড়িতে অর্কর মা,বোন এর উচ্ছাসের শেষ নেই।অর্কর বন্ধু মহলে আরো খাতির বেড়ে গেলো।কিন্তু লোনের বোঝাটা আরো বেড়ে গেলো অমল বাবুর।
এমনি করে দেখতে দেখতে আরো দু বছর কেটে গেলো অর্কর চাহিদা আরো বেড়ে গেলো।অমল বাবু গাড়ির লোন শোধ করে ফেলেছেন।
উচ্চ মাধ্যমিকের পর অর্কর সব বন্ধুরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলো জয়েন্ট এ ভালো রাঙ্ক না হলেও অর্ক বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারি কলেজ এ পড়তে চাইলো।অমল বাবু বললেন “আরো একবার জয়েন্ট দিয়ে দেখ যদি ভালো রাঙ্ক হয় সরকারীতে যাদবপুর বা শিবপুরে পড়তে পারিস”।
অর্ক বললো “যত সব মিডল ক্লাস মেন্টালিটি এক বছর নষ্ট করি”,যদি বেসরকারি কলেজ এ পড়াতে পারো ভালো না হলে আর পড়াশোনার দরকার নেই”।
অগত্যা কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে ছেলেকে কলকাতায় পড়তে পাঠালেন।
পড়তে গিয়ে ছেলের চাহিদার শেষ নেই বাপ কোনোদিন 20 টাকার বেশি দিয়ে চুল কাটেনি কিন্তু ছেলে এঞ্জিনেররিং পড়ে প্রতি মাসে হাবিবস এ চুল ছাটা চাই 500 টাকা দিয়ে।নইলে নাকি কলেজে মান সম্মান থাকেনা। অমল বাবু সব সামলান।
দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেলো ছেলের পড়া শেষ কিন্তু চাকরি জোটাতে পারলো না।
ফিরে এলো কল্যাণী তে।
অমল বাবু চাকরির চেষ্টা করার কথা বললেই ছেলে বলে বন্ধুরাও চাকরি পাইনি ওদের বাবা রা ঠিক চ্যানেল করে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে তুমি কি করেছ আমার জন্য।
অমল বাবু যে চেনা জানা দু একজনকে চাকরির কথা বলেনি তা নয় কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি।
23 বছরের ছেলে সারাদিন বাইক নিয়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় চাকরির নাম চিন্তা নেই,এদিকে মেয়েটিও বিবাহযোগগা হয়ে উঠছে।সব মিলিয়ে অমল বাবুর চিন্তার শেষ নেই।এই সব ভাবলে বুকের বাম দিকটা কেমন চিন চিন করে ওঠে।
এদিকে অমল বাবুর বন্ধু বান্ধব ,আত্মীয় পরিজন দের একই প্রশ্ন ছেলে কবে চাকরি পাবে।
একদিন অমল বাবু অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন এমন সময় এক পরিচিত লোক বললো “কি মশায় কি ছেলে মানুষ করেছেন ছেলে মদ খেয়ে রাস্তার মেয়েদের টোনটিং করছে”।
কথাটা শুনে অমল বাবুর গা জ্বলে উঠলো ছেলেকে খুঁজে পেলেন হাই রোডের ধারে বন্ধুদের সাথে সিগারেট খাচ্ছে।
তিনি গিয়ে ছেলেকে বললেন” কিরে মদ খেয়ে নোগ্রামো করছিস রাস্তার ধারে আমার তো কোনো মান সম্মান রাখলি না”।অর্ক বললো কি করবো বলো “বারে বসে মদ খাবার পয়সা তুমি দিতে পারবেনা তাই রাস্তাতেই খেতে হবে”।
অমল বাবু অর্কর হাত থেকে সিগারেট ফেলে ওর হাত ধরে টানতে থাকে বলে বাড়ি চল।বাপ বেটার টানাটানি চলতে থাকে।
অর্ক এক ঝটকায় বাবার হাত ছাড়িয়ে নেয়।অমল বাবু টাল সামলাতে না পেরে হাই রোডে পড়ে যায় একটা দ্রুত গতিতে আসা লরির সামনে অমল বাবুর চশমাটা ছিটকে পড়ে একদিকে আর শরীরটা লরির নিচে দু মিনিট ছটপট তারপর গাঢ় লাল রক্ত বেয়ে আসে ছটপট করা শরীর টা নিথর হয়ে যায়।অমল শেষ হয়ে গেলো।এক মধ্যবিত্ত বাবা।রক্তের ফোটা গুলো যেন শত অবহেলা আকুঞ্চন এর নিঃশব্দ প্রতিবাদ।হয়তো এই প্রতিবাদ ছেলে বুজবে না,স্ত্রী বুজবে না,সমাজ বুজবে না।বুজলো শুধু অমল আর ওর একাকিত্ব।কিভাবে আগলে রেখেছিল সংসার কে হয়তো কেউ বুজবে না নিজে 100 টাকার জামা পরে ছেলেকে ব্র্যান্ডেড শার্ট জোগাড় করে দিয়েছে।সবাই বলে হয়তো পিতামহ ভীষ্ম প্রতিবাদ করলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হতো না হয়তো দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ হতো না।কিন্তু ভুল হয়তো ভীষ্ম ও ছিল অবহেলা সহ্য করা এক কাপুরুষ।
অর্ক বাবা বলে চিৎকার করে ওঠে।
পরদিন সকালে পোস্টমর্টেম এর পর বডি টাকে দাহ করা হয়।
30 দিন পর…..
অর্ক আর ওর মায়ের চিন্তা কি করে লোন মেটাবে কি করে বোনের বিয়ে দেবে আর অর্কর ভবিষৎ কি হবে। অর্ক বুজতে পারলো বাবা কত বিপদ থেকে আড়াল করে রেখেছিল।এখন বড্ডো অসহায়।
অমল এর ছবির সামনে বসে অর্কের মা কাঁদতে কাঁদতে বলে তুমি তো কিছুই দায়িত্ব পালন করে গেলে না।
হটাৎ করে ব্যাঙ্ক এর লোক বাড়িতে আসে অর্ককে বলে একটা কাগজে সই করতে অর্ক জিগ্যেস করে ওদের কি ফ্লাট ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ব্যাঙ্ক এর লোকটা বলে না ।তোমার বাবা লোন নেবার সময় একটা আসিসিডেন্টাল ডেথ এর ইন্সুরেন্স করেছিল যদি উনি মারা যান তো ওনার পরিবার কে আর লোন শোধ করতে হবে না।ফ্লাট টা পরিবার পাবে।
এর কিছুদিন পর অর্কর একটা চাকরির লেটার এলো অর্ক ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে জানতে পারলো ওর বাবা ওই কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বলে এবং লাখ খানেক টাকা খায়িয়ে অর্কর চাকরির ব্যবস্থা করে গেছে।
আরো কিছুদিন পর প্রভিডেন্টফান্ড এর টাকা এলো এতে করে বোনের বিয়ে হয়ে যাবে।
কদিন পর অর্ক ওর বাবার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে বলছে “বাবা তুমি যে কিভাবে আমাদের আগলে রেখেছিলে আজ বুজতে পারলাম কিন্তু আজ তোমাকে আর কাছে পাবোনা। না জেনে তোমাকে কত খারাপ কথা বলেছি পারলে ক্ষমা করে দিও”।
অর্ক তার নতুন অফিসে যাবার জন্য বাস এ উঠে বসলো।
বাসের fm এ একটা গান বাজছিল “বাড়িয়ে দাও তোমার হাত আমি আবার তোমার আঙ্গুল ধরতে চাই”
হয়তো অর্কের মনেও এটাই হচ্ছিল….
(সমাপ্ত)