বাবাকে নিয়ে কীভাবে যে লেখাটা শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সত্যি বলতে কি, আমার বাবা রাগী একটা মানুষ। আমি বাবাকে ভয় পাই আবার অনেক ভালোবাসি।
বাবা কথা বলেন কম। খুব হিসেব করে কথা বলেন। চুপচাপ নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন। অবসরে পড়েন-লিখেন। তিনি যতণ বাসায় থাকেন ততণ আমরা সবাই সাবধানে চলাফেরা করি, আস্তে কথা বলি। জোরে হাসি না। আমাদের যা কিছু লাগে সবই চাই মার কাছে। মা বলার পর বাবা এগুলো এনে দেন। কিন্তু সমস্যা হলো বাবা আমাদের কতোটা ভালোবাসেন ঠিক বুঝতে পারি না। মাকে বলি, ‘বাবা কি আমাদের সত্যি সত্যি ভালোবাসেন?’ মা বলেন, ‘আসলে তোমাদের বাবা তোমাদের অনেক অনেক ভালোবাসেন। তিনি মুখে আদর দেখান না, তাঁর আদর-সোহাগ মনে মনে।’
আমার বান্ধবী চৈতির আব্বুটা একদম তার বন্ধুর মতো। রাগ নেই, ধমক নেই। চৈতি যা বলে তাই করে তার আব্বুটা। চৈতি এখনও তার বাবার গলায় ঝুলে পড়ে বায়না ধরে। তার আব্বুটি মোটেও রাগ করে না। এসব দেখে আমার খুব হিংসে হয় এবং আমার বাবার প্রতি খুব রাগ হয়। আমি মনে মনে বলি, ‘ইশ্ চৈতির আব্বুর মতো যদি আমার বাবাটা হতো তাহলে কতো মজা হতো, গলায় ঝুলে পড়ে বায়না ধরতাম!’
মা চাকরি করেন। একটা ট্রেইনিং করার জন্য ছয় মাস থাকবেন বাইরে। আমরা দুই ভাই-বোন খুব টেনশানে পড়ে গেলাম। এখন কী হবে আমাদের! এই কম কথা বলা রাগী বাবাটার সাথে থাকতে হবে ভেবে খুব কষ্ট পেতাম। আমরা দুই ভাই-বোন খালি ফিসফাস করতাম। আর বলতাম কেমনে কাটবে আমাদের এই ছয়টা মাস! কবে শেষ হবে মার ট্রেইনিং।
মা চলে যাওয়ার পর শক্ত বাবাটি একদম তুলোর মতন নরম হয়ে গেল। অফিস টাইম ছাড়া বাকি সময়টা বাবা আমাদের সাথেই কাটান। আমাদের রেখে কিচ্ছু খান না। অফিসের মিটিং এ যে টিফিন পান তাও নিয়ে আসেন আমাদের জন্যে। বাবা আমাদের সঙ্গে বসে রোজ গল্প করেন, দাবা, সাপ-লুডু, ক্যারাম খেলেন। পড়ার ফাঁকে ছড়া ও গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। খুব মজা হয় তখন। ভাইয়ার চেয়ে আমি পুরষ্কার পেতাম বেশি। বাবা আমাদের নিয়ে বেড়াতে যান। পড়ার সময় বাবা আমাদের সঙ্গ দেন এবং আমাদের পড়ান।
বাবা ভেতরে ভেতরে আমাদের যে এত ভালোবাসেন তা আমরা টের পেতাম না। এখন টের পেয়ে অনেক আনন্দ লাগছে আর গর্ব করছি মনে মনে। আমাদের আনন্দ দেখে কে!
একদিন বান্ধবী চৈতিকে সব খুলে বললাম, ‘চৈতি তুমি এখন আমার বাবাকে দেখলে রীতিমত হিংসা করবে। কারণ আমার বাবার মতো এত ভালো বাবা দুনিয়াতে আর একটিও নেই।’ চৈতি অবাক হয়ে বলল, ‘বলিস কিরে! তোর রাগী বাবাটি এত ভালো বাবা হয়ে গেল কী করে?‘
মা ট্রেইনিং শেষে ফিরে এলেন বাসায়। এসে দেখেন, আমরা বাবার খুব ভক্ত হয়ে বসে আছি। আমরা নাকে-মুখে খালি বাবার প্রশংসা করছি। মা মনে মনে হিংসা করতে লাগলেন।
মা বাবাকে বললেন, ‘আমি এক বছর বাসায় ছিলাম না আর এই সুযোগে ফাঁকি দিয়ে ছেলে-মেয়ে দুটোকে দখল করে বসে আছেন দেখি।’ বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি নেই তাই মা-বাবার আদর আমি একাই দিয়েছি, ভক্ত হবে না তো কি।’
একদিন এ নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে তর্ক হলো। মা বাবাকে বলছেন, ‘যতই আদর-সোহাগ আর চালাকি করেন না কেন, ছেলে-মেয়ে দুটো আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। মা বলতে পাগল ওরা।’ বাবা তখন বললেন, ‘তাহলে একটা ভোটাভুটি হয়ে যাক। দেখি, কার জনপ্রিয়তা কতটুকু।’
মা পট করে রাজি হয়ে গেলেন। রাতে ভোট হবে। ছেলে-মেয়েরা কাকে বেশি ভালোবাসে, কার জনপ্রিয়তা কতটুকুন তা পরীা করা হবে আজ।
সন্ধ্যার পর মা আমাকে আর ভাইয়াকে এটা খাওয়ায়, সেটা খাওয়ায় আর বলে, ‘আজ রাতে কিন্তু ভোট হবে। ভোট দিবা কাকে?’
আমি বললাম, ‘এহ্ এটা গোপন কথা তোমাকে বলতে যাব কেন?’ ভাইয়াও বলল একই কথা।
আমার কেন জানি মনে হলো, ‘ভাইয়া তার ভোটটা ডাইরেক্ট মাকে দিয়ে দিবে। কারণ তার মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না। তাকে আদর করে বললাম, ‘ভাইয়া, তোমার ভোটটা বাবাকে দিও, আচ্ছা? সে বলে, ‘আচ্ছা, দিমুনে যাহ্।’
মা একটা বিস্কিটের ডিব্বা নিয়ে ব্যালট বাক্স বানালেন। আমরা দুজন ভোটার আর মা বাবা দুজন প্রার্থী।
মা কাগজের টুকরো দিয়ে ব্যালট পেপার বানিযে দিলেন। দুজন আলাদা ঘরে গিয়ে যাকে ভোট দেব তার নাম লিখলাম ব্যালট পেপারে। যেমন বাবাকে দিলে ‘বাবা’ আর মাকে ভোট দিলে ‘মা’ লিখতে হবে।
আমরা গোপনে লিখে কাগজটা ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ফেলে দিলাম। এই সময়ে মা আর বাবা ঘরে পায়চারি করতে লাগল। কে পাস করে আর কে ফেল করে এই টেনশানে তাঁরা অস্থির।
ভোট দেওয়ার কাজ শেষ।
মা ব্যালট বাক্সটা নিয়ে খাটের ওপর রাখলেন। বাবাও বসলেন।
আমাদের ডাকলেন। আমরা চারজন গোল হয়ে বসলাম। তারপর মা বাক্সটা খুললেন। ভাঁজ করা দুটি কাগজ ধীরে ধীরে খুললেন মা। সবার সামনে মেলে ধরলেন।
মা পেলেন এক ভোট আর বাবা পেলেন এক ভোট। মা অবাক হয়ে চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালেন। বাবা চোখ বড় করে মাথাটা ঝাকাতে লাগলেন মার দিকে তাকিয়ে। বাবার মনে আনন্দ।
আমি ভাইয়াকে খোঁচা দিয়ে সবার সামনেই বললাম, ‘তুমি না বলেছিলে, ভোটটা বাবাকে দেবে, এখন?’
ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘আসলে বাবাকেই দিতে চেয়েছিলাম, পরে ভোটটা বাবাকে দিতে দিতে কিভাবে যে মাকে দিয়ে ফেললাম, সেইটাই বুঝতে পারলাম না।’ তার কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে ধণুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলাম।