আপনাদের ডাক্তারদের কাছে কি আশা নিয়ে আমরা ছুটে আসি জানেন? আপনাদের কাছে এলে আপনারা দ্রুত চিকিৎসা করবেন, অথচ আপনি কি করলেন? সকাল দশটায় অপারেশন শুরু করার কথা, অথচ আপনি এলেন দুপুর একটায়। রাত থেকে মেয়েটাকে কিছু খেতে দিতে বারণ করে গেছেন, ক্ষুধা, ব্যথায় মেয়েটা আমার ছটফট করছে। আপনারা রোগীদের ব্যাপারে এতো উদাসীন আগে জানলে এই হাসপাতালে আসতামই না। আপনারা ডাক্তাররা হচ্ছেন সব ডাকাত, রোগী মরল কি বাঁচল, এসব নিয়ে আপনাদের কোন মাথাব্যাথা নাই। আরে ভাই
চিকিৎসা তো আর ফ্রীতে করতেছেন না, টাকা যা লাগবে, ক্যাশ কাউন্টারে অপারেশনের আগেই জমা নিয়ে নিছেন। সরকারি হাসপাতাল হলেও টাকা তো কিছু কম নেন নাই।
ইদ্রিস সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে, ডাক্তার সাহেব বললেন,
—আপনার কি বলা শেষ হয়েছে?
ইদ্রিস সাহেব রাগ চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, কিছু বললেন না।
—যদি বলা শেষ হয়ে থাকে তবে আমি অপারেশন থিয়েটারের দিকে যেতে পারি।
ইদ্রিস সাহেব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, জ্বী, প্লীজ।
ডাক্তার সাহেব অপারেশন থিয়েটারের দিকে হাটতে শুরু করলেন। ইদ্রিস সাহেব চোখ গরম করে ডাক্তারের চলে যাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অপারেশন থিয়েটারের দরজা দিয়ে ডাক্তার সাহেবকে প্রবেশ করতে দেখে নার্সরা হতচকিত হয়ে গেল। সিনিয়র নার্স সুমিতা দেবী বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল—
—স্যার, আপনি!
—কেন সুমিতা অন্য কারও আসার কথা ছিলো কি?
—না স্যার, কিন্তু এই অবস্থায়… আমরা ঠিক করেছিলাম অপারেশনের ডেট পিছিয়ে দেয়ার।
—কেন! এতে কি রোগীকে আরও কিছুদিন কষ্ট বেশি পেতে হতো না?
—তারপরও স্যার, আজ…
সুমিতা দেবী কিছু বলতে যাচ্ছিল, ডাক্তার সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল—
—এইযে, আপনার নাম কি?
হাসি ডাক্তারদের ভীষণ ভয় পায়। শুধুমাত্র ডাক্তার ভীতির কারণেই তাকে কোনভাবেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসা যাচ্ছিল না। ডাক্তারদেরকে ভয় পাবার বিশেষ একটা কারণও অবশ্য আছে—
সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে বঁটিতে পা পরে হাসির পায়ের তালুতে অনেকখানি কেটে হাঁ হয়ে গিয়েছিলো, ডাক্তারের কাছে যাবার পর ডাক্তার কাটা অংশে সেলাই করে দিয়েছিলো। হাসির তখন থেকেই মনে গেঁথে গেছে ডাক্তার রা ভাল না, ডাক্তাররা শুধু ব্যথা দেয়। ডাক্তার আবার জিজ্ঞাস করল,
—আপনার নাম কি?
হাসি ভয়ে ভয়ে বলল, হাসি।
—কি? শুনতে পারিনি, জোরে বলেন।
—হাসি।
—তাহলে আপনি না হেসে মুখটা এমন কাঁদো কাঁদো করে রেখেছেন কেন?
ডাক্তারের কথা শুনে হাসির মুখটা আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছু না বলে রক্তশূণ্য মুখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল হাসি।
ডাক্তার সাহেব হাসির মনের ভাষা পড়ে ফেলেছেন। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ডাক্তাররা পচা, ডাক্তাররা ব্যাথা দেয় তাই না?
হাসি খুব অবাক হলো—মনে মনে সে যা ভাবছে ডাক্তার কিভাবে তা বুঝে ফেলল? অভিমানের সুরে হাসি বলল,
—হু! খুব পচা।
—হাসি, একটা প্রশ্ন করি?
—হু,
—তোমার বাবার নাম কি?
—ইদ্রিস হোসেন ফজল।
—তোমার খুব রাগী তাই না?
—হু, খুব।
—বকা দেয়?
—হু, খুব।
—কেন বকা দেয়?
—একটু বেশি খেললে, পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে।
—খেললে বকা দেয় কেন? এখান থেকে বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ খেলবে ঠিক আছে।
—উঁহু, বাবা খেলতে দেবে না।
—খেলতে না দিতে চাইলে বাবাকে বলবে কি, ডাক্তার আংকেল আমাকে বলেছে সারাক্ষণ খেলতে, ঠিক আছে?
হাসি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, হু,ঠিক আছে।
ডাক্তার সাহেব সুমিতা দেবীকে ডেকে বলল— এনেস্থেসিয়া প্লীজ।
—জ্বী স্যার।
—হাসি!
—হু,
—তুমি সবচাইতে বেশি কোন খেলাটা পছন্দ করো?
—টেনিস।
—তাই নাকি! আমি কিন্তু আগে থেকেই জানতাম। কিভাবে জানতাম, বল তো?
হাসির মুখে সামান্য ব্যথার ছাপ পরল, সেদিকে গ্রাহ্য না করে সে কৌতুহলী চোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল, কারণ ডাক্তার কিভাবে আগে থেকেই জানত সে টেনিস খেলতে পছন্দ করে তা সে খুঁজে পাচ্ছে না।
ডাক্তার হাসতে হাসতে বলল— কিভাবে জানলাম সেটাই ভাবছ তো? আমিই বলে দিচ্ছি, তুমি তো দেখতে একদম মারিয়া শারাপোভার মতন। যে দেখতে শারাপোভার মতন সে নিশ্চয়ই খুব ভাল টেনিস খেলে।
.
শারাপোভাকে হাসির বিশেষ পছন্দ, ডাক্তারের কথা শুনে সে কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল।
—হাসি!
—হু।
—তুমিকি শারাপোভার মতন উলটো গুনতে পারো?
—কেমন?
—দশ, নয়, আট এমন করে?
—হু, পারিতো।
—দেখি দশ থেকে উলটো এক পর্যন্ত গুনো তো।
—দশ, নয়, আট, সাত, ছ ছ ছয়…
ডাক্তার সুমিতা দেবীকে বললেন, সুমিতা, সিজার কুইক।
—ইয়েস স্যার।
অপারেশন শেষে, কি কি করতে হবে বলার এক পর্যায়ে সুমিতা দেবী ডাক্তার সাহেবকে বলল—কিন্তু স্যার আপনি আজ…
সুমিতা দেবীর কথা শেষ হবার আগেই ডাক্তার সাহেব বললেন—
শোন, সুমিতা, ইংরেজিতে একটা কথা আছে—
“Whatever the situation is, every doctor must give priority to their patients first”…
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার সাহেব বের হয়ে আসলেন। ইদ্রিস সাহেব অপারেশন থিয়েটারের বাইরে হাসপাতালের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন। ডাক্তার সাহেবকে বের হতে দেখে, উঠে এসে তিনি জানতে চাইলেন না অপারেশন কেমন হয়েছে, কেবল রক্তচোখে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ডাক্তার নিজেই ইদ্রিস সাহেবের কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন, অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে, আপনার মেয়ে ভাল আছে, কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে ইনশা আল্লাহ।
ইদ্রিস সাহেব কিছু বললেন না, ডাক্তারের লিফট ঘরের দিকে হেটে যাবার দিকে দাঁত কামড়ে তাকিয়ে রইলেন।
হাসিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করার পর, ইদ্রিস সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে হাসিকে জিজ্ঞাস করলেন, ব্যথা লাগছে মা?
হাসি তখনও কিছুটা ঘোরের মধ্যে ছিলো, ঘোরের মধ্যেই সে উত্তর দিলো, না বাবা।
হাসিকে নিয়ে অবজারভেশন কক্ষের দিকে চলে গেল নার্সরা। সুমিতা দেবী অবজারভেশন রুম থেকে বের হবার পর ইদ্রিস সাহেব জিজ্ঞাস করলেন, আমার মেয়ে কেমন আছে?
—খুব ভাল আছে, চিন্তা করবেন না রাতেই তাকে নরমাল বেডে দেওয়া হবে।
—আপনাদের ডাক্তারের নাম কি?
—ইমতিয়াজ হোসাইন।
—রোগীদের ব্যাপারে উনি এতো উদাসীন কেন? আজ যদি আমার মেয়েটার কিছু হয়ে যেত? আমার মেয়ের যায়গায় যদি উনার মেয়ে আজ অপারেশন থিয়েটারে থাকত তাহলে কি উনি এতো দেরি করতে পারতেন?
—মিস্টার ইদ্রিস…
সুমিতা দেবীকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ইদ্রিস সাহেব বলেই চললেন, এরকম একটা ইরেসপন্সিবল মানুষের ডাক্তারি পেশায় থাকাই উচিত না, উনাকে বলবেন ডাক্তারি ছেড়ে অন্য কোন পেশায় যোগদান করতে। এরকম ডাক্তারের কারণে রোগীদের ভুগতে হয়।
—ইদ্রিস সাহেব, আপনি হয়তো জানেন না স্যারের আসতে দেরি হয়েছে কেন।
—কেন আবার, নিশ্চয়ই প্রাইভেট হাসপাতালের চেম্বারে রোগীর ভীড় বেশি ছিলো।
—মিস্টার ইদ্রিস আপনার ধারণাটা ভুল। স্যার আজ হাসপাতালে আসবেন আমরা ভাবতেই পারিনি, কারণ, আজ সকালে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবার সময়, স্যারের স্ত্রী এবং মেয়ে দুজনই রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আপনার মেয়ের প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে শুনে, উনি উনার মৃত স্ত্রী-বাচ্চাকে কবর দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে এসেছেন। আপনিই বলুন, স্যারের কি আজ হাসপাতালে আসার কথা ছিলো?
ইদ্রিস সাহেব একমুহূর্তেই মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন, তার ছলছল চোখে ভেসে উঠল ডাক্তার সাহেবের হাস্যোজ্জ্বল মুখ, কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল—
“আপনার মেয়ে ভাল আছে, কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে ইনশা আল্লাহ”।