সকাল সকাল ঘুম ভেঙে বিছানায় বসে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে আছি৷ বিছানা থেকে নামতে একদম ইচ্ছা করছে না। শিউলি হুশিয়ার করে গেছে হাত মুখ না ধুলে আজ নাকি কপালে এক ফোটা জলও জুটবে না। আমিও জিদ চেপে বসে আছি, দেখি আমাকে খেতে না দিয়ে কি করে সে খেতে বসে। মূল ঘটনা আসলে এটা না, ঘটনা হচ্ছে এই শীতে ঠান্ডা পানি ছোয়া মানে ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার শামিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ যেহেতু অফিস নাই সেহেতু সারাদিন আমি এভাবেই শুয়ে বসে আয়েশ করে কাটাব। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে ঠান্ডা জলের ছিটা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আম্মা এসে ঘরে ঢুকলেন। সকাল সকাল আম্মার হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকা মানে, সে এসেছে বিশেষ কোন প্রয়োজনে। আম্মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে লেপ আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম।
—সকাল কয়টা বাজে জানিস?
—জেনে কি হবে? আজ আমার অফিস নাই জানো না?
—অফিস নাই তাই বলে কি উঠতে হবে না?
—নাহ, আজ সবকিছু এই বিছানাতেই হবে।
—এক্ষুনি ওঠ, কাজ আছে।
—তাতো আপনার মুখ দেখেই বুঝছি।
—কচু বুঝছিস তুই।
—ওতো ভনিতা না করে বলে ফেল, কি করতে হবে?
—তোর বাবাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেই ভোর ছয়টা বাজে বাসা থেকে বের হয়েছে, এখন বাজে এগারোটা, ঔষধও খেয়ে যায় নাই।
—তো আমাকে এখন কি করতে হবে?
—গিয়ে একটু খুঁজে দেখ, কোথায় না কোথায় গিয়ে বসে আছে।
—পারমু না।
—এমন করেনা বাবা, যাহ গিয়ে একটু দেখ, কোন বিপদও তো হইতে পারে।
—তোমার দরদ উতলায়া পরতেছে এখন? রাতে তো ঝগড়া করার সময় কিছু কম করনাই। তুমি ঝগড়া করছ তুমিই খুঁইজা আনো গা তোমার জামাইরে।
—আমার জামাই তোর কিছু লাগে না?
—নাহ! সে আমাকে সর্বদা পচানোর চেষ্টা করে।
—ধুর! ওসব মজা করে। যাহ বাবা একটু খুঁজে দেখ গিয়ে।
—আমারেই কেন বলতে হইবো? বিথী আছে না ওরে বল, নইলে নিশাদরে বল, তোমার বউমারে বল। আমি কোথাও যাইতে-টাইতে পারব না, আজকে আমার ছুটি, সারাদিন আয়েশ করে কাটাবো আমি।
—যাবি না তাইলে?
—নাহ, একদম না।
আম্মা চলে গেলেন, মিনিট খানেকের মধ্যেই এক বালতি পানি সমেত আমার ঘরে উপস্থিত হয়ে বললেন,
—উঠবি নাকি ঠান্ডা পানি মাথায় ঢালব?
—আরে নাহ, এইসব কইরোনা মনের ভুলেও।
—ওঠ তাইলে,
—উঠমু না।
আম্মা সত্যি সত্যি বালতি থেকে এক মগ পানি এনে আমার মাথায় ঢালতে যাচ্ছিল, কোনরকম লাফিয়ে উঠে পরলাম। অল্পের জন্যে এই যাত্রায় বেঁচে গেছি।
—যাহ এখন গিয়া তোর আব্বারে খুঁজে নিয়া আয়।
—এই সাঁঝ সকালে কি যে শুরু করছ না। আচ্ছা যাইতেছি, নাস্তাটা খায়া যাই, তবে বাড়ি আসার পর সারাদিন আর ডিস্টার্ব করবানা, রাজী আছো? রাজী থাকলে বল রাজী।
—রাজী।
ঘর থেকে বের হয়ে ডায়নিংয়ে বসে শিউলিকে বললাম নাস্তা দাও। শিউলি গোমড়া মুখে বলল, বলছি না, হাত-মুখ না ধুলে আজকে তোমার কপালে এক ফোটা জলও জুটবে না?
—মনে করছটা কি? তুমি বলবা আর হয়ে যাবে? বাইরে খামু আমি।
—যাও খাও গে।
ঘরে ঢুকে প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগ নিতে হাত দিলাম, কিন্তু পকেট ফাঁকা। ব্যাপারটা কি মানিব্যাগ সরালো কে? এও নিশ্চয়ই শিউলির কাজ। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে শিউলিকে বললাম—
—মানিব্যাগ কই রাখছ?
—হাত-মুখ ধোয়ার পর পাবে।
—তুমি বললেই হল? মনে করছটা কি মানিব্যাগ ছাড়া আমার কাছে টাকা নাই?
—যাও সেসব দিয়া কিছু খাও গে।
—ওক্কে।
বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। আসলে পকেটে এক টাকাও নাই৷ পকেটে টাকা রাখলে প্রায়ই টিস্যু মনে করে ফেলে দেওয়ার বাতিক আছে আমার, তাই দুই টাকার নোটও আমি মানিব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখি৷
বাড়ি থেকে বের হতেই আবুল ভায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখতেই তিনি যেন সব বুঝতে পেরে গেছেন। আমার মন মেজাজ খারাপ দেখলে তিনি খুব আনন্দ পান। মুখে একটা আনন্দের হাসি এনে তিনি বললেন,
—বউ ঝাটার বাড়ি দিছে নাকি?
—ওই মিয়া আর কোন কথা খুঁইজা পান না? মন-মেজাজ খারাপ দেখলেই শুধু বউয়ের কথা কন, আর দিলে দিছে, আমার বউ আমারে দিছে তাতে আপনার কি?
—তোমারে তো দেইখা তো এমনই মনে হইতেছে।
—আপনার সবসময়ই এইডাই মনে হয়। যাক গা, ভুলে মানিব্যাগ বাসায় রাইখা আসছি একটা সিগারেট খাওয়ান।
—একটা কেন দশটা খাও কিন্তু কি হইছে খুইলা কও।
—সিগারেটের সাথে এক কাপ চা খাওয়াইবেন?
—হু চল।
আমি জানতাম আবুল ভাই না করবে না, কারণ শিউলির সাথে কি হইছে, কি কি বলে গালাগাল দিলো, এইসব শোনার জন্যে তার মন উদগ্রীব হয়ে আছে।
কুরবানের চায়ের দোকানে বসে প্রথমেই রুটি কলা, একটা লাড্ডু মেরে দিলাম। আবুল ভায়ের সেদিকে কোন খেয়াল নাই, একটু পর পর তিনি কেবল জানতে চাইছে, কি হইছে, বউ কি বেশি বকাঝকা দিছে?
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললাম, ভাই সিগারেট দেন তো৷ আবুল ভাই সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিলেন।
—আসলে খুব চিন্তায় আছি ভাই।
—কি হইছে? কি নিয়া চিন্তা করতেছো? না বললে বুঝব কি করে?
—আব্বাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
—হায় আল্লাহ! বল কি? থানায় ডায়েরি করছ? মাইকিং করছ?
—না ভাই এখনো করা হয়নাই।
—কি করে হল বল তো, আংকেল কি হারিয়ে গেছেন নাকি কেউ কিডন্যাপ করেছে? কারও কল এসেছিলো?
—আপনে না আসলেই দুই লাইন বেশি বুঝেন।
আবুল ভাই কথাটা গায়ে মাখলেন না, মূল ঘটনা শোনার জন্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
—ভাই একশো টাকা আছে আপনার কাছে? থাকলে দেন, মানিব্যাগ নিয়া বের হইনাই তো।
আবুল ভাই পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে দিলেন।
—আসলে হইছে কি ভাই, আব্বা সকালে বাসা থেকে বের হয়ে এখনো বাসায় ফিরে যায় নাই, মনে হইতেছে আশে পাশে কোথাও বসে আড্ডা দিতেছে। আপনে থাকেন তাইলে, আমি যাই।
আবুল ভাই ফ্যাকাশ মুখে বসে রইলেন।
আব্বাকে আমার খুঁজে বের করার প্রশ্নই ওঠে না, বাড়ির রাস্তাঘাট সবই তিনি চেনেন, সময় হলে নিজেই ফিরে যাবেন। আমাকে আপাতত পেট পূজো করতে হবে, ক্ষিধায় পেট চো চো করছে।
মায়ের দোয়া হোটেলে গিয়ে স্যুপ-পরোটা অর্ডার করে বসে আছি। এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে চোখ গিয়ে পরল হোটেলের বাবুর্চির পাশের ব্যাক্তির দিকে। তিনি বাবুর্চির সাথে আলাপ করছেন, গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবুর্চির রান্না দেখছেন, কিন্তু আব্বা হঠাৎ এসব দেখছেন কেন? হোটেলের বাবুর্চি হবেন নাকি?
আব্বার কর্মকান্ড দেখতে দেখতে খাবার চলে এলো। খেয়ে দেয়ে হোটেল থেকে বের হবার সময় আব্বাকে বললাম, আপনে এইখানে কি করেন? রান্না শিখতেছেন নাকি?
আব্বা আমাকে দেখে ভীষণভাবে লজ্জা পেয়ে গেলেন। বাবুর্চির কাছ থেকে সড়ে এসে বললেন, আরে নাহ, বাবুর্চি আমার পরিচিত লোক, অনেক দিন পর দেখা হইলো তো তাই একটু কথা বলতে ছিলাম।
—ও আচ্ছা, তাইলে কথা শেষ কইরা বাসায় আসেন। ছোটমামা আসছে বাসায়।
—ওই বদমাইশটা আসছে কেন?
—আমি কি জানি।
—তোর আম্মা কি করে?
—পোলাও কোরমা রান্না করতেছে।
—আমাক তো জীবনেও পোলাও কোরমা রান্না কইরা খাওয়ায় না, বদমাইশটা আসছে দেইখা পোলাও কোরমা রান্ধা লাগব?
—সেই কথা আমারে বলতেছেন কেন? আম্মারে গিয়া বলেন।
—আপনার কি যাইতে দেরি আছে?
—হু, তুই যা আমি কথা শেষ কইরা আসতেছি।
—আচ্ছা। আসার সময় ৭০টাকা দিয়া আইসেন হোটেলে। মানিব্যাগ নিয়া আসিনাই তো, আপনারে দেইখা নাস্তা করলাম।
আব্বা কিছু বললেন না, বিক্ষিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
বাড়ি ফিরে দেখলাম ছোট মামা চলে আসছে। মামা বাড়িতে এলেই আম্মা পোলাউ-মাংস রান্না করে। আজকেউ তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না।
আমি ঘরে গিয়ে দেখলাম, বিছানায় কোন তোশক চাঁদর নাই। শিউলিকে ডেকে বললাম, তোশক কই?
—জানো না?
—আমি জানব কোত্থেকে? সবাই মিলে মনে হচ্ছে আজকে আমার উপ্রে আইসা পরছ, ছুটির দিন একটু যে শান্তি মতন ঘুমামু তারও উপায় নাই।
—তোমারে ঘুমাইতে না করছে কে?
—তাইলে তোশক সরাইছো কেন?
—এতো বড় বুড়া গাধা যদি বিছানায় প্রসাব করে তাইলে তোশক সরাব না? বুয়া এসে তোশক ধুয়ে ছাদে শুকায়া দিয়া গেছে।
আমি চিৎকার করে আম্মাকে ডাকলাম। আম্মা দ্রুত এসে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাস করল, কিরে পাগলা কুত্তার মতন চিল্লাইতেছিস কেন?
—তুমি যে আমার মান ইজ্জত সব প্লাস্টিক করে দিছো, সেইদিকে কোন খেয়াল আছে তোমার? দেখ তোমার বউমা কি বলতেছে, আমি নাকি বিছনায় হিশু করে দিছি, তোমারে কইছিলাম, পানি ঢাইলো না?
আম্মা হাসতে হাসতে বলল, বউমা আসলে নিবিড় ক্লাস ওয়ান থেকেই বিছানায় এইসব করে না, ওরে ঘুম থিকা উঠাইতে গিয়া আমিই এক মগ পানি ঢালছিলাম।
আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তোমরা আমার আরামের ঘুমটা হারাম কইরা ছারলা। তোমাদের সাথে আর থাকমুই না।
বাড়ি থেকে বের হয়ে, দোকান থেকে আবুল ভায়ের দেওয়া ১০০টাকা দিয়ে ১২টা সিগারেট কিনে আনলাম। আব্বা ততক্ষণে বাসায় এসে হাজির হয়েছেন।
আমি সোজা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই আব্বা বিক্ষিপ্ত কন্ঠে আমাকে ডাকতে শুরু করলেন। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মামা তাকে সব বলে দিছে। গতকাল রাতে আমিই মামাকে কল করে বলছিলাম, আব্বা-আম্মার মধ্যে তুমুল ঝগড়া হইছে, একজন আরেকজনের মুখ দেখা দেখি বন্ধ হয়ে গেছে, আপিনি দ্রুত বাসায় আসুন।
আব্বা এই মুহূর্তে আমাকে সামনে পেলে কাচা গিলে খেয়ে ফেলবে, আব্বার সামনে একদম যাওয়া যাবে না। মোবাইল বের করে শিউলিকে বিপদ সংকেত পাঠালাম—ত্রিপল ফাইভ। মানে আমি ভীষণ বিপদে আছি, আমাকে তার রক্ষা করতে হবে। শিউলি রান্নাঘর থেকে দ্রুত ঘরের সামনে এসে একটা টোকা দিলো, আমি দরজা খুলে দিলাম।
আব্বা আমার উত্তর না পেয়ে দরজার সামনে এসে ডাকতে শুরু করলেন, শিউলি এগিয়ে গিয়ে বলল-
—বাবা নিবিড়ের তো প্রচন্ড জ্বর, বিছানা থেকে উঠতে পারছে না, কিছু করতে হবে কি?
—জ্বর এলো কোত্থেকে? ওরে তো একটু আগেও দেখলাম হোটেলে বইসা নাস্তা করতেছে।
—ওখান থেকে আসার পর থেকেই জ্বর।
—ও আচ্ছা ঠিক আছে, সন্ধ্যাবেলা ডাক্তারের কাছে নিয়া যায়ো।
—আচ্ছা বাবা।
বাবার মেজাজ এক নিমিষেই ঠান্ডা করে দিতে শিউলির তুলনা হয় না। দরজা লাগিয়ে এসে শিউলি বলল— যান, এবার গোসল করে নিন।
—উঁহু, কি ঠান্ডা বাপ্রে!
—করবা না?
—নেহি, ইয়ে ইম্পসিবল হেয়।
—বাবাকে ডাকলাম,
—না ভুলেও না।
—তাহলে যাও গোসল করে নাও।
—শাস্তি দিচ্ছ?
—হু,
—কেন?
—কারণ আপনি হাত-মুখ না ধুয়ে নাস্তা করছেন।
—আজকে মাফ করো।
—ডাকছি বাবাকে।
ভুলেও না, যাচ্ছি আমি। তৃতীয়বার শিউলির কথার অবাধ্য হই না, যদি হই তবে তার ফলাফল হয় ভয়ংকর।
এবারের যাত্রায় মামা কিছু অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন। সেই গল্প অন্য কোনদিন বলব।