তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগী

তুঝসে নারাজ নেহি জিন্দেগী

আমার কিছু ছ্যাঁচড়াপোড়া অসুখ আছে বুঝলেন কিনা! মানে সারাবচ্ছর আমাকে জ্বালিয়ে মারে অথচ মানে বললে মনে হয় “এ আর এমন কি?” যেমন ধরুন, আমার প্রথম ঘুমভাঙানিয়া, দুখজাগানিয়া যদি কেউ থেকে থাকে, সে হল আমার গ্যাস অ্যাসিডিটি। মানে পাতে অম্বল খাবার দরকারই পড়ে না। খেলেই “অম্বল” ফ্রী! আর গ্যাসের কথা কি বলবো ভাই! “ঘেউ ঘেউ ফেউ ফেউ” কবতেখানা মনে হয় আমায় নিয়েই লেখা! একটা সময়ে যখন

“সফিস্টিকেটেড” টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি মানে সহজ বাঙলায় “ন্যাকাচণ্ডী” ছিলাম, খাওয়ার পরে কেউ ঘেউ ঘেউ ঢেকুর তুল্লে ঠাস করে একটা চড় মারার মত ইচ্ছে জাগতো মনে মনে। ইচ্ছাপূরণ দেবী যে আমার সাথে এমনি মস্করা করবেন, স্বপ্নেও ভাবিনি! মানে আমার গালে চড় মারার ইচ্ছেটা অন্যদের মনে সঞ্চালিত করে দিলেন আর কি! চা বিস্কট খেলাম, ঘেউ! ভাত ডাল তরকারি ঘেউ ঘেউ! ফুচকা চাওমিন, ঘেউ ঘেউ ফেউ ফেউ! মাইরি মুখে দেশলাই ধরালে “মুখে আগুন” ততৎক্ষণাৎ হয়ে যাবে! মাঝে মাঝে মনে হয় আমিই ড্রাগনের উত্তরসূরি! গ্যাসের ফ্রী ডিলারশিপ পেটে নিয়েই বসে আছি! এইবারে আমি যদি কাউকে বলতে যাই, গ্যাস, অ্যাসিডিটিতে খুব কষ্ট পাচ্ছি, কেউ সহানুভূতি দেখায় না মশায়! বরঞ্চ “নিজ মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন” বলে সব নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে!

ভগবান আমার জীবনপাত্র উছলিয়া আরেকটি জিনিষ দান করেছেন। না না প্রেম নয়! সর্দিকাশি। আমি নিশ্চিত, যদি কোনোদিন প্রেম কত্তুম, কাশির চোটে প্রেমিককে বিশ্বনাথ দর্শন করিয়ে দিতুম এক্কেরে ফ্রী তে!
মানে কথোপকথন এইরকম হত-

-কি করছ?
-খকখক
-খাওয়া হয়েছে?
– খুক খুক
– চল না আজ বেরিয়ে আসি।
– খক খক খক খক ঘং ঘং খরাৎ….

মানে পুরো শব্দকল্পদ্রুম! কে আর সেধে এই “কাশিশ্বরী”কে নিজে ডেকে ঘরে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলুন! নেহাত বরবাবাজী বিয়ের পরে টের পেয়েছেন। তাই…. আর কি! তাছাড়া কাশির জন্য ডাইভোর্সের অপশন নেই কিনা ভারতীয় আইনে। তবে কাশীবাসী না হয়ে যান, সেদিকে একটু ভয় আছে বৈকি!

সর্দি আমার তিনবার হয়, শীতে, গরমে আর বর্ষায়। তা সারাবছর যদি এই তিনটে ঋতুই বজায় থাকে আমার আর দোষ কি বলুন! আমার পতিদেব তার হাড়জ্বালানো হাসিটি হেসে মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসা করেন,
জন্মের পরে কি ফ্রিজে রাখা হয়েছিল তোমাকে?

তা যাই বলুন সর্দিকাশি বা গ্যাস অম্বল কোনোটিই কেউ অসুখ বিসুকের মধ্যে গেরাহ্যি করে না। সেদিক থেকে আমি বড়ই অভাগা। থাকার মধ্যি হাই প্রেসার। তা সেও আজ ঘরে ঘরে। আগেকার মত কৌলিন্য তার আর নেই। চোখ ওল্টানোর মত ভোগান্তি ভুগতে ভারী ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে, জানেন! পতিদেব বেশ মুখ শুকনো করে ঘুরবে, বেশ সেবা টেবা পাবো। বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে উপভোগ করবো সবার ভালবাসার উষ্ণতা! তা আমার কি সেই কপাল! ওই যে বল্লুম, ছ্যাঁচড়া অসুখের পাহাড় ডিঙিয়ে বোধকরি বড় অসুখবিসুখ ঢোকে না আর!

তা কিছুদিন আগে সেই শুভদিন এসেছিল। ভারি ভুগলুম কয়েকদিন পেট নিয়ে। হতচ্ছাড়া পেট যে তলে তলে “মিত্রো” রবে মজে আছে কে জানে? “স্বচ্ছ ভারত” মিশনে যোগদান করে আমার পেট সাফাই অভিযানে নেমেছে। এদিকে শীতকাল জুড়ে উৎসব। “খাইবার উৎসব” আর কি! আমার আবার জিভে প্রেম! ওইটেই একমাত্র টেকসই। কিন্তু পেটের তা সহ্য হলো না। তাই সেসবকিছুর ওপরেই লাগাম টানতেই হলো। তারপর এলো সর্দিকাশি। আমি মোটেই ডাকিনি, এম্নিএম্নি এলো। গলা জুড়ে বসলো। গলায় তখন সাতসুর খেলছে। কি বলতে চাইছি, আর কি বেরোচ্ছে গলা দিয়ে তার মধ্যি বিস্তর ফারাক। বেশীরভাগই কথা বোঝে না! আরও বেশী জন কথা শুনতে চায়না গলার স্বরের পঞ্চত্ব প্রাপ্তির জন্য। রাগের চোটে সক্কলকে ত্যাগ দিয়ে “যদি তোর ডাক শুনে…” গুনগুনাবো কিনা ভাবছি, হেনকালে তিনি এলেন।

মানে বাজনা আগেই শুনতে পাচ্ছিলুম। গায়ে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, আলিস্যি। এরই মধ্যে ছেলেকে বিদ্যাসাগর বানানোর অসাধ্য সাধনা। তেনার আবার পরীক্ষা চলছিলো কি’না! তারপর সন্ধ্যেবেলা দেখি সোয়েটার, কম্বল কিছুতেই শীত যায়না। ছেলে কেবল একটা ফুলহাতা টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছে কচ্ছিলো দেই কান টেনে। অসময়ে ছেলের বিদ্যাদানের বদলি কম্বল মুড়ি দিতে দেখে পতিদেব অবাক হয়ে মুখে থার্মোমিটার গুঁজে দিলেন।

এই একটা ব্যাপার অসহ্য লাগে আমার। মানে আমার মুখ বন্ধ করা! এক মহিলা, দুই দিদিমণি। বকবকানি আমাদের নৈতিক অধিকার। ডিজিটাল থার্মোমিটারের পিঁকপিক শোনার আগেই মুখ থেকে বের করে দিলাম। তাতেই একশ দুই। পরদিন ছেলের পরীক্ষা। স্কুলে পাঠাতেই হবে। ছেলের বাবা বললেন,

-তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো। কাল কি টিফিন দেবো ছেলেকে?
বললাম,
– ম্যাগি দিও। আর কিছু তো পারবে না!
বাবুর প্রেস্টিজে লাগলো। বললে,
-কেনো? আমি কিছু বানাতে পারবো না?
– পারবেনা কেনো? কিন্ত আমায় হেল্পার পাবে না। এইবারে বুঝে দেখো!
বাইরে গিয়ে চিৎকার করলে,
-ম্যাগিটা কোথায় রেখেছ?
-হুঁ হুঁ বাবা! মুরোদ বোঝা আছে! রান্নাটা তুমি মুখে করো, আমি হাতে!
-ও মা! তোমার বৌমার মাথায় জল ঢালো। কিসব বিড়বিড় করছে!
এ’কথা শোনার পরেও জ্বর যদি দুই থেকে চারে না ওঠে, আর আমি স্ত্রী থেকে ইস্তিরি হয়ে না উঠি তবে মানব জন্ম বৃথা! চিৎকার করে বললাম,
-বই গুছিয়ে দাও তানের।

এইটে প্যাঁচ। সে বান্দা তিনটে ইংরেজি কপি (খাতা বললে পাপ হয়!), তিনটে অ্যারিথম্যাটিক কপি, তিনটে ইভিএস, দুটো বাঙলা কপি আর সমসংখ্যক বইএর ভিড়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে থাকে। ছেলে দৌড়ে এসে বলে,

-সরো সরো, আমি গুছোচ্ছি।

এইবারে বাপ ব্যাটার খণ্ডযুদ্ধের মধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি। যুযুধান দুই পক্ষের কারোরই বিশেষ আপত্তি দেখি না।
পরদিন পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়ি পতিদেবের নিষেধ সত্তেও। ভাত, ম্যাগি বানানোর পর ছেলের বাবা হন্তদন্ত হয়ে ওঠেন। তারপর কিছুই করার না পেয়ে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে “মানসিকভাবে ” আমার পাশে থাকেন। ছেলে বেরিয়ে যেতেই আবার কম্বল মুড়ি। বেশ ঘোর ঘোর, নিশ্চিন্ত। কেউ ডাকবে না। কোনো কাজ নেই! সম্পূর্ণভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল! কি নির্ভার! শাশুড়ি “মা” হয়ে উঠলে এমনই হয়। মনের মধ্যে লেখাগুলি ভুড়ভুড়ি কাটছে। কম্বলের ভেতর থেকে হাত বের করে লেখার ক্ষমতা নেই। একটা কোকিল কাতরস্বরে ডাকছে। তার আর্তি, আকুতি ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকেও। শুধু প্রেম নয়, ঘরবাঁধার আহ্বান নয়, কোন সুদূর ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় এ ডাক! কিছু অপূর্ণতা, কিছু মনখারাপ বালিশ ভেজায়।

ঘোর কাটতে দেখি ছোট্টছোট্ট দুটো হাত গলা জড়িয়ে গালে গাল ঘষে জ্বরে ওম নিচ্ছে পরম মমতায়। চোখ বুজে ভাবি, জ্বর ভালো! বেশ ভালো!

কি ভাবছেন? সাতদিন জ্বরে পড়ে আছি? ফলমিষ্টি নিয়ে দেখতে আসবেন? তেমনি কপাল কি না! দুদিন কবিতা কাজে আসেনি, জ্বর এমনি পালিয়েছে!

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত