আস্তে আস্তে কমে আসছে ট্রেনের গতি ।প্লাটফর্মে ঢুকছে ট্রেন। ব্যাগপত্র নিয়ে এগিয়ে চললাম গেটের দিকে।
কত দিন পর গ্রামের বাড়ি ফিরছি, পাঁচ মাস তো হবেই। কলকাতায় একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করি। কাজের চাপে আর বাড়ি ফেরার সময় বের করে উঠতে পারি না।আজ কিছুটা বাধ্য হয়ে তিনদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। পরশু আমার বিয়ে। জীবনের সাতাশটা বসন্ত একা থাকার পর অবশেষে খানিকটা নিজের ইচ্ছায় আর কিছুটা পরিবারের চাপে বিয়েতে রাজি হতে হয়েছে। বিয়েটা যার সাথে হচ্ছে সে অবশ্য আমার পরিচিত। আমার ছোটবেলার বন্ধু শিউলি। আমাদের গ্রামের দুটো গ্রাম পরেই শিউলিদের গ্রাম।
ক্লাস নাইন থেকে আমাদের প্রেম। শিউলির মা কেয়া কাকিমা প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছিলেন আমাদের সম্পর্কটা। আমার বাড়ি থেকেও অমন শান্ত চোখের শিউলিকে মেনে না নেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তারপর থেকে দুটো গ্রামের সবাই জানত অশোকনগরের শিউলি ফুটছে আমার জন্য।
কাজের চাপ যতই হোক না কেন, দিনে একবার মাকে আর শিউলিকে ফোন করতে কক্ষনো ভুলি না। হবু বইটা আমার ভারি অভিমানী। একটুতেই চোখের কোণে জল জমে তার। আমার অ্যাটেনশন পেতে একটু বেশিই ভালোবাসে সে।
প্লাটফর্মে এসে নামলাম। স্টেশন জনশূন্য। টিমটিম করে জ্বলছে দুটো বাতি। স্টেশন থেকে আমার বাড়ি প্রায় তিন কিমি। এত রাতে আর রিকশা পাওয়া যাবে না। অগত্যা হেঁটেই যেতে হবে তিন কিলোমিটার রাস্তা।
লাগেজের ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর এসে একটা চেনা অবয়ব চোখে পড়ল। আরে এ তো শিউলি! বেশ অবাক হলাম। শিউলি হাসতে হাসতে এগিয়ে এল আমার দিকে।
বলল,” কিরে কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?”
বেশ রাগ হল আমার। আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে শিউলি কিছু না জানিয়ে এত রাতে স্টেশনে এসে বসে আছে ! এত রাতে যদি কোনো বিপদ ঘটতো!
আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,
“কাল তো এমনিই দেখা হত। এত রাতে আসা টা কি খুব দরকারী ছিল?”
শিউলি হেসে বলল,” কি আর হবে তুই থাকতে!আসলে জানিস, আমার হবু বরকে দেখার জন্যে আর ধৈর্য সইছিল না। তাই চলে এলাম।”
আমার দেওয়া হলুদ সালোয়ার কামিজটা পরেছে শিউলি। কপালে ম্যাচ করা কালো টিপ। হলুদ চুড়িদারটা যেন জাপটে ধরে আছে ওর পেলব দেহটাকে। একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে উঠল আমার মন। বাস চলাচলের পাকা রাস্তা ছেড়ে দুজনে কাঁচা রাস্তায় এসে পড়লাম।
” তুই আসিসনি বলে বিয়ের শাড়ীটা কেনা হয়নি এখনও। বাকি সব কেনাকাটা কমপ্লিট। কাল যাবি আমার সাথে। তোর তো নীল বেনারসি খুব পছন্দ।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
শিউলি এবার বলল,” জানিস আজ রানাদের বাড়িতে আইবুড়ো ভাত দিল। আমাকে একটা সোনার আংটি দিয়েছে।” বলে বাম হাত টা তুললো শিউলি। দেখলাম মাঝের আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করছে সোনার আংটিটা।
” তুই এত দূরে দূরে হাঁটছিস কেন? সরে আয় আমার দিকে।” বলে হাত ধরে শিউলি কে টেনে নিলাম নিজের দিকে। শিউলির সুবাসে ভরে উঠল আমার মন।
শনি মঙ্গলের হাট পেরিয়ে গ্রামের সীমায় ঢুকলাম আমরা। প্রতি শনি আর মঙ্গল বার এখানে হাট বসে বলে জায়গাটাকে সবাই “শনি মঙ্গলের হাট” বলেই চেনে। হাট পেরিয়ে বামদিকে শিব মন্দির টা চোখে পড়ল। কিছু দিন আগেই শিবরাত্রি ছিল। শিউলি আমার নামে মানত করে দুধ ঢালতে এসেছিল। বৈশাখ মাসে এখানে গাজন মেলা হয় খুব ধুমধাম করে।
শিউলি বলল,” চল অভি…মন্দিরে প্রণাম করে আসি।”
দুজন মিলে মন্দিরে এসে উঠলাম। প্রদীপটা এখনও জ্বলছে টিমটিম করে। প্রণাম করে দক্ষিনা বাক্সে একটা দশ টাকার কয়েন ফেললাম।
মন্দির থেকে নামছি এমন সময় শিউলি বলল,” চল অভি…বিয়ে টা করে ফেলি।”
বেশ অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,” কি?? ”
” আমাদের তো পরশুই বিয়ে হচ্ছে। তার আগে আজ মন্দিরেই বিয়েটা করে ফেলি আমরা।”
বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম,” কিন্তু কিভাবে? ”
” কিছুই না। তুই শুধু ঠাকুরের সামনে কলাপাতা থেকে একটু সিঁদুর নিয়ে পরিয়ে দে আমাকে। ব্যাস। তাহলেই হবে।”
শিউলির ছেলেমানুষিতে বেশ বিরক্ত হলাম। রাত বিরেতে এরকম পাগলামি করার কোনো মানে হয়!
” পাগল নাকি! এসব পাগলামো বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। অনেক রাত হয়েছে।”
” উহু।তা হবে না। আমাকে সিঁদুর না পরিয়ে দিলে আমি নড়ছি না এখান থেকে। প্লিজ।”
সেই সাথে প্রাণঘাতী চোখের করুন আর্জি। যা ইগনোর করা ভগবানেরও দুঃসাধ্য।
অগত্যা সামনের কলাপাতা থেকে একটু সিঁদুর নিয়ে লাগিয়ে দিলাম ওর চুলের মধ্যে। খুশি হয়ে আমার দিকে তাকাল ও। আবার বলল,” আংটি ছাড়া আবার বিয়ে হয় নাকি! আমাকে আংটি পরিয়ে দিবি না?”
কালই গড়িয়াহাট থেকে কিনেছি সোনার আংটিটা। ওকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলাম ছবি তুলে। বেশ পছন্দ হয়েছিল ওর। অগত্যা ব্যাগ থেকে আংটিটা বের করে পরিয়ে দিলাম ডান হাতের অনামিকায়। আস্তে আস্তে বুকে টেনে নিলাম ওকে। তারপর আলতো করে চুমু খেলাম ওর কপালে। আবেশে চোখ দুটো বুজে এল ওর।
মন্দির থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলাম দুজনে। বাড়ি আর বেশি দূরে নয়। সামনের মোড়ে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। বামদিকের রাস্তাটা এগোলে শিউলিদের গ্রাম। আর ডান দিক ধরে এগোলে আমার গ্রাম। মোড়ের মাথায় এসে বললাম,” চল তোকে ছেড়ে দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরব। ”
“না না। আমি চলে যাব ঠিক। এইটুকু তো রাস্তা। তাছাড়া রাত এমন কিছু হয়নি। তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নে। সেই কখন বেরিয়েছিস।”
বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। আমাদের দোতালা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। তবে সারা বাড়ি অন্ধকার। বোধহয় শুয়ে পড়েছে সবাই। নাহলে লোডশেডিং।
গেট খুলে ঢুকে দেখলাম সামনেই বিশাল প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। এককোনে রাখা সারি সারি চেয়ার। বোধহয় কনেযাত্রীদের বসার ব্যবস্থা করা হবে এই প্যান্ডেলে।
দরজায় এসে দুবার টোকা দিতে দরজা খুলে দিল মা। সামনের ঘরে বসে আছে সবাই। বাবা, দাদা, বৌদি, ছুটকি। কিন্তু সবাই চুপ কেন! আমি আসার পরেও কারো মধ্যে আনন্দের লেশমাত্র চোখে পড়ছে না!
ছুটকি এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারপর কাঁদতে লাগল হাউ হাউ করে।
” দাদাভাই ,শিউলি দি”.
” শিউলি কি?”
” শিউলি দি আর নেই রে । ”
” মানে?? কি আবোলতাবোল বকছিস! প্লিজ চুপ কর।”
বৌদি বলল,” আজ বিকেলে তোমার জন্যে আংটি কিনতে গেছিল। ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট।” আর কোনো কথা কানে ঢুকল না আমার।
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চললাম শিউলির বাড়ি। এদের প্রমাণ করতেই হবে যে শিউলি বেঁচে আছে।
শিউলির বাড়ি পৌঁছে দেখলাম বাড়ির সামনে একটা শববাহী যান দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে অনেক লোকজনের ভিড়। ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম। একটা সাদা চাদরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে আমার শিউলি। আমি নির্বিকার ভাবে এগিয়ে ওর মাথায় হাত দিলাম। ওই তো বামদিকের চুলের ফাঁকে এখনও সেই সিঁদুর লেগে আছে। একটু আগেই আমরা জীবনের সেরা মুহূর্ত কাটিয়ে এলাম। এরা কি বিশ্বাস করবে সে কথা!