অবনীর দুঃখ

অবনীর দুঃখ

গান শুনছে। রবীন্দ্র সঙ্গীত। এখন হচ্ছে-মনে এ কি দ্বিধা…। তবু কাজ হচ্ছে না।ঘুম আসার কোন লক্ষণ নাই। ঝিমানি সঙ্গীত দিয়ে আজ বুঝি আর কাজ হবে না। চোখ মেলে তাকালো। ঠিক তার মাথা বরাবর,দেয়ালে মাকড়সা জাল তৈরি করেছে।অথচ এক সপ্তাহ আগে সব মাকড়সার জাল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে আবার;-মাকড়সার উপর কিছুটা বিরক্ত হল। মন মনে গালি দিল-ফালতু প্রাণী। ছোট ভাই রাতুল,একবার এদিক যাচ্ছে,আর এক বার ওই দিক যাচ্ছে। হাতে বাংলা দ্বিতীয় বই। গুনগুনিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে।সামনে ওর এস-এস-সি পরীক্ষা। দুই মাস বাকি। নবনী বিছানার উপর বসল। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো।চারটা বেজে উনিশ মিনিট। রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করল।হাত মুখ ধেীত করল। মখ লাগালো ফেয়ার এন্ড লাভলী। আয়নার সামনে দাঁড়ালে। হলুদ রংয়ের টিপটা ঠিক কপালের মাঝখানে লাগাল। পড়ল গোলাপী রংয়ের শাড়ি।সাথে গোলাপী রংয়ের ব্লাউজ।কেমন জানি বেমানান লাগছে।

টিপটা অপসারণ করল। গোলাপী রংয়ের বৃওাকার টিপ বসাল। ঠোটে কোন লিপিস্টিক দিল না। লিপিস্টিক দিলে বিশ্রী দেখা যায়। তাই এখন আর লিপিস্টিক লাগায় না। মোবাইল বাজছে। অবনি ফোন করেছে।

-হু অবনি
-রেডি তো
-ইয়েস ডারলিং
-আমি তোর বাসার সামনে
-দাড়া আসতেছি
নবনী অবনির পাশে এসে দাঁড়াল। অবনির হাত ধরল। অবনি হাত ছাড়িয়ে নিল না। মুখে বলল-সুইট ডারলিং। রিকসা ঠিক করল।গতি খুব একটা বেশিও নয়,আবার কমও নয়। অবনি সিগারেট ধরাল। নবনী দেখেতো অবাক।শিখলই বা কবে। সিগারেটের ধোয়া নবনীর মুখের উপর এসে পড়ছে। মনে মনে বলল-ডিসগাসটিং। অবনি নবনীর দিকে তাকাল।দেখল,ও বেশ হা করে তাকিয়ে আছে আর হাতদিয়ে ধোয়া সরাচ্ছে। অবনি হেসে বলল-কিরে অবাক হচ্ছিস?

নবনী হাত দিয়ে ধোয়া সরিয়ে বলল-তাতো হচ্ছি,তোমার যে এত নৈতিক উন্নতি হয়েছে,তা দেখে খুশি না হয়ে পারছি না।
-একটান দিবি? ভাল লাগবে
-না,এ বিষ আমি আমার শরীরে নিতে পারব না। তো এত সুন্দর অভ্যাস হল কবে থেকে শুনি।
-এই দুই-তিন সপ্তাহ
এমন সময় নবনী কাশতে লাগল। কাশি থামা মাত্রই কঠিন কন্ঠে বলল-তোর সাথে রিকসাই যেতে আমার অসহ্য লাগছে। রিকসা থামা। আমি বাসাই চলে যাব।
-কেন?
-তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেল।
অবনি হাসল। বলল-ও এই কথা বেবি। আচ্ছা ফেলে দিলাম।
এই বলে অবনি সিগারেট ফেলে দিল। শাড়ির আচল দিয়ে মুখটা মুচল। এরপর একটি লজেন্স খেল যাতে গন্ধ না আসে। এরপর নবনীর মুখের কাছে শ্বাস নিল। বলল-গন্ধ বের হচ্ছে কি?
যদিও হালকা- গন্ধ বের হছে।তবুও বলল-না।

নবনীতাদের বাসার সামনে ওরা নামলো। পাচতলা বিল্ডিং। ওরা থাকে দুই তলায়। নবনীতাকে ফোন দিতেই কেটে দিল। কাল রংয়ের শাড়ি পরে মিনিট দুইয়ের মধ্যে নেমে পড়ল।

তিন কন্যা হাটতে লাগল। তিন চার মিনিটের পথ। লেকের পাশে বসে বেশ জমিয়ে আড্ডা মারবে। নবনীতা ভ্যানিটি ব্যাগ হতে তিনটি রঙ্গিন চশমা বের করল। ওর বড় খালা আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছে। যদিও নবনীর বিশ্বাস হয় না,তবু মুখ ফুটে কিছু বলে না।তার ধারনা,পাশের মার্কেট হতে কিনে এনেছে। নবনীতা মিথ্যা কথা বলতে যে ওস্তাদ,তা ওর হাড়ে হাড়ে জানা। অবনির মধ্যে এ ধরনের জটিলতা নাই। সবার কথা বিশ্বাস করার সহজাত প্রবৃত্তি দেখা যায়। লেকের পাড়ে ঘাসের উপর বসল। তিনজনের চোখে রঙ্গিন চশমা। নবনীতা ক্যামেরা বের করল। তিন কন্যা বিভিন্ন রং ঢংয়ে ছবি তুলল। কখনো গাছ ধরে,কখনো নৃত্যের ভঙ্গিতে বা ফুল হাতে নিয়ে ইত্যাদি। আশে পাশের লোকজন বেশ মজা পাচ্ছে। কিছু যুবক বয়সের তরুণ হা হয় তাকিয়ে আছে।যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখছে।কিছুটা মনে হয় ক্লান্ত। ঘাসের উপর বসে পড়েছে। কফি খাচ্ছে। একেবারে রাবিশ। মুখে দেয়ার অযোগ্য। তবুও খাচ্ছে। এমন সময় হেংলা পাতলা এলোমেলো চুলযুক্ত একটি ছেলে এসে নবনীতাকে বলল-শুনুন

-আমার কান খোলাই আছে, বলুন
এমন সময় ছেলেটা ইতস্তত করে বলল-আপনি হলেন আমার জীবনের তৃতীয় সুন্দর নারী।এই কার্ডটা নিন।আমার নাম্বার আছে।
এই বলে ছেলেটা কার্ড এগিয়ে দিল।নবনীতা হাতা নিল।এরপর মৃদু হেসে কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলল।
ছেলটা হতাশ কন্ঠে বলল-ছিঁড়ে ফেললেন
-ইয়েস ডেয়ার বয়।কোন ছেলের তৃতীয় নারী হয়ে বেচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।নিজেকে ভাল করে একবার আয়নায় দেখবেন।তাহলে আশা করি চিরকুট দিয়ে ব্যর্থ হবেন না।

ছেলেটা সামনে হতে সরে পড়ল।তিন কন্যা এ নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ হাসল।তাদের হাসি যেন ফুরাতেই চায় না।নবনী দশ টাকার বাদাম কিনল।লেকের জলে রক্তিম লাল সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।নবনীতার ফোনটা এসময় বেজে উঠল।এক রোমিও ফোন করেছে।কয়েকদিন ধরে বেশ ডিস্টার্ব করছে।ফোনটা দিল কেটে।ফোন কেটে দিয়ে লাভ নেই।যতক্ষণ না ধরবে,ততক্ষণ ফোন দিতেই থাকবে।নবনীতা অস্পষ্টস্বরে বলে উঠল-ও,কী যে পেইন?
ফোন রিসিভ করল।
-শুনুন

কথা শেষ না হতেই ছেলেটা বলল-জানু,কেমন আছ জানু
-ফোনটা রাখুন।আপনার সাথে কথা বলতে আমার ইচ্ছা নেই।
-কিছুক্ষণ কথা বললে কি এমন ক্ষতি হয়
-আপনার মত বাস্টার্ড ছেলের সাথে কথা বলার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
-তোমাকে অসাধারণ লাগছে। অসহ্য সুন্দর। মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে তোমাকে……
নবনীতার রাগ চরমে উঠল। ফোনটা সাথে সাথে কেটে দিল। ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল। দিক,শত হাজারবার ফোন দিক। সিম কার্ডটা বদল করতা হবে। দুই সখীর দিকে তাকাল।তারা মৃদু হাসছে। নবনীতার পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মত অবস্থা। কান্না করতে ইচ্ছে হল। এমন সময় এক ছেলে এসে অবনীকে বলল-হাই অবনী

অবনী ছেলেটার দিকে তাকাল। ছেলেটার হাসি হাসি মুখ।চিনতে অসুবিধা হল না। ওর কলেজমেট ছিল। স্টুডেন্ট হিসেবে বেশ নাম ছিল। কিছুদিন একসাথে অংক স্যারের কাছে প্রাটভেট পড়েছে। মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে থাকত। যদিও কখনই অফার দেয়নি,ওর প্রতি যে ছেলেটার বেশ দুর্লতা আছে তা ওর দৃঢ় বিশ্বাস। অবনী মৃদু হেসে বলল-কি খবর রনক?
-হু,ভাল।তুমি?
-আছি মোটামুটি।তো কোথায় আছ?
-ঢাবি।তুমি?
-প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছি।আইটিতে।তোমার বিষয় কি?
-ফার্মেসী
এরপর ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।ঢাবিতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। নবনীতার বেশ উৎসাহ দেখা দিল। বলল-রনক,সামনে শুক্রবার কি তোমার সময় হবে?
-হবে না মানে,একশবার হবে।
-তাহলে সামনে শুক্রবার যাচ্ছি। তোরা কি বলিস?
অপর দুইজন মাথা নাড়লো। এক সপ্তাহ পর।

তিন কন্যা আর রনক-চা স্টলের সামনে বসে আড্ডা মারছে। সাড়ে দশটা বাজে। এমন সময় ওদের বয়সের এক যুবতি সামনে এসে দাঁড়ালে।
-রূপা,অবনী আর ওর বান্ধবী
-আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি। তোমার মুখে অবনী নামটা এতবার শুনেছি যে,কানঝালা হয়ে গেছে। এখন দেখে বুঝতে পারছি,সত্যি ও এত প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

অবনীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।রনকও বেশ লজ্জা পাচ্ছে।রুপা অবনীর পাশে বসল। অবনীকে উদ্দেশ্য করে বলল-তোমাকে আমার বড় ঈর্ষা হয়। যখনি ওর সাথে কথা বলি,তোমার কথা ও বলবেই।প্রথম প্রথম বড় রাগ হত। এখন যে হয় না,তা নয়;কিন্তু কিছুটা কম। আমাদের সম্পর্ক এক বছর হল। আমারি দেখার সাধ ছিল-বলতে পারেন ওর বার বার বলার কারনে।খুব ভাল লাগছে।ইচ্ছেটা পূরণ হল।

তিন কন্যা রিকসায় উঠল। কিছু দূর যেতেই,অবনী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। মনে হল,রনককে যে ওর খুব প্রয়োজন।কিন্তু বুঝতে যে অনেক দেরি হল।যখন বুঝলো, তখন আর কিছু করার নেই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত