—কি ব্যাপার অফিস থেকে এসেই রান্না ঘরে ঢুকলে যে?
—ভাবছি রাতের রান্নাটা আজ আমিই করব।
—তুমি রাঁধবে?
—এতো অবাক হবার কি আছে? ছেলেরা কি রাঁধতে পারে না নাকি?
—না মানে, শেষ পর্যন্ত খাওয়া যাবে তো?
—টিটকারি করছ নাকি?
শিউলির মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। নারীরা যে পুরুষদের কি ভাবে? তাদের ধারণা পুরুষ মানুষের একমাত্র কাজ হচ্ছে পরিবারের অর্থের যোগান দেওয়া। অফিসে যাওয়া-আসা, এছাড়া পুরুষ্রা আর কিছুই করতে পারে না।
ফ্রিজ থেকে মাংস, সবজি বের করে ধুয়ে কাটতে শুরু করলাম। নিয়মিত রান্না করি না বলে পেঁয়াজ কাটতে একটু সমস্যা হয়। দু-চারটা কাটতেই চোখ থেকে জল ঝরতে শুরু করে। ব্যাপারটা আমার মন্দ লাগে না, মাঝে মধ্যে কান্নার চর্চা ভাল—চোখ পরিস্কার থাকে।
শিউলি ফ্রিজে ঢেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বঁটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পরতেই বলল—
—কি কি কাটতে হবে আমাকে বল, কেটে দিচ্ছি।
—প্রথমেই তো তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুড অফ করে দিছো, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। যে রাঁধতে জানে সে কাটতেও জানে।
—তাই বুঝি! দেখ আবার হাত কেটে নিয়ো না।
—ঢং।
—ঠিক আছে বাবা, গেলাম আমি, কিছু লাগলে ডেকো।
মরিচ কাটতে গিয়ে বুঝলাম, হাতের আঙ্গুল অলরেডি কাটা পরেছে। শিউলিকে হাত কাটার ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না, কোনক্রমে বুঝতে পারলে, এ নিয়ে সে হাসি-তামাশা শুরু করে দিবে। নিয়মিত তো আর কাটাকাটি করি না, একটু-আধটু কাটতেই পারে।
মাংস চুলোয় বসিয়ে দিলাম। মাংসে কাচা মরিচের ঝাল খাই না অনেক দিন। আজ ইচ্ছা হচ্ছে কাচা মরিচ বাটা দিয়ে মাংস কষিয়ে রাঁধতে। রান্নাঘরে ব্লেন্ডার খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শিউলিকে ডেকে বললাম, ব্লেন্ডার টা কোথায়?
—ব্লেন্ডার তো নষ্ট হয়েছে ক’দিন হলো। ব্লেন্ডারে কি করবা?
—মাংসে মরিচ বাটা দিতাম, আচ্ছা পাটায় বেটে নিচ্ছি, আদা-রসুন বাটা আছে তো? নাকি ওগুলোও বাটতে হবে?
—নাহ ওসব আছে, মরিচ আমি বেটে দেই?
—লাগবে না। আমিই বেটে নিবো।
—দেখো হাত কিন্তু জ্বালা করবে।
—ঢং।
—ঠিক আছে বাবা আর ঢং দেখাচ্ছি না, গেলাম আমি।
পাটাতে মরিচ বাটতে গিয়ে হঠাৎই আঙ্গুলের কাটা অংশে তীব্র জ্বালা শুরু হবার পর মনে পরল, মরিচ কাটতে গিয়ে হাতের আঙ্গুল কেটেছে। কাটা অংশে মরিচের ঝাল লাগা মানে! যার লেগেছে সেই কেবল বুঝবে, “উহা হকিস্টিকের দু-চার, দশ বারির চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক”।
বেশকিছুক্ষণ বাচ্চাদের মতন আঙ্গুল চুষে মুখ থেকে বের করলাম, কিন্তু জ্বলা তো কমছে না, পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এতোক্ষণে জ্বালা-পোড়া বন্ধ হয়ে যাবার কথা। আঙ্গুলের দিকে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখলাম—মরিচের ছোট্ট একটা বিচি। এই ক্ষুদ্রতম মরিচের বিচির যেই পরিমাণ জ্বালানোর ক্ষমতা আছে পৃথিবীর অন্য কিছুর এতো ক্ষমতা আছে বলে আমার হয় না। মরিচের ক্ষমতার উপর পর্যালোচনা করে আমি মরিচকে উপাধি দিয়েছি— “দ্যা সুপার ডেঞ্জারাস এনিমি”।
এই নাম দেওয়ার পেছনে একটা বিশেষ কারণ আছে। মরিচের দল সর্বদা সুযোগের সন্ধানে থাকে, সুযোগ পেলেই এরা বিস্ফোরিত হয়ে মানুষকে একদম কাবু করে ফেলে। আজ দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর তাদের মনের খায়েস পূরণ হয়েছে।
হাত ভালভাবে ধুয়ে ঘরে গিয়ে শিউলির চোখ ফাঁকি দিয়ে ওয়ান্টাইম ব্যান্ডেজ নিয়ে এসে আঙ্গুলে লাগিয়ে নিলাম। মরিচের বাকি অংশ বেটে মাংসে সব মসলা দিয়ে দিলাম। এরমধ্যে শিউলি এসে আবারও রান্নাঘরে ঢুকল।
—কি ব্যাপার আপনার রান্না কতদূর?
—হাত পকেটে ঢুকিয়ে বললাম, এইতো শেষের দিকে।
—শুধু মাংস রাঁধলেই হবে? ভাত রাঁধবে কে?
—ভাত রান্না হয়নি?
—হবে কোত্থেকে? সেই যে অফিস থেকে এসে রান্নাঘরে ঢুকেছন, কিছু কি করতে দিয়েছেন?
—ভাত হতে আর কতক্ষণ! তুমি যাও, আমি ভাতের চাল ধুয়ে বসিয়ে দিচ্ছি।
শিউলি মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটতে কাটতে বের হয়ে গেল। শিউলির কয়েকটা অঙ্গ-ভঙ্গির মধ্যে মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটা আমার বিশেষ পছন্দের। এরকম ভাবে ভেংচি কাটলে বেশির ভাগ মানুষকেই বিরক্তিকর দেখায় কিন্তু শিউলিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়।
রান্না-বারা শেষ করে শিউলিকে ডাকলাম। শিউলি কপাল ভাঁজ করে রান্নাঘরে ঢুকল।
—রাঁধব বলেছিলাম রেঁধেছি, টেবিলে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তোমার।
—সেই তো আমাকে প্রয়োজন পরলই। যান ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আসুন।
—দেখো নিয়ে যাবার সময় তরকারিতে কয়েক চামচ লবণ দিয়ে বোসো না।
—পারমুনা আমি নিতে। কষ্ট কইরা রাঁধছ, কষ্ট কইরা টেবিলেও নিয়া যাও।
শিউলি রাগলে ওর গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে যায়, চোখে তেজ ঝরে পরে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়।
শিউলির হাতের রান্নার প্রশংসা করতেই হয়, ফাইভ স্টার হোটেলের বাবুর্চির রান্নাও শিউলির হাতের রান্নার ধারের কাছে নাই। শিউলিকে আরেকটু রাগানোর চেষ্টা করলাম।
কি সব রান্না-বারা কর, মুখ দিয়ে ঢুকতে চায় না, আজ আমি রেঁধেছি, খেয়ে দেখো—বলেই রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। শিউলি এখন কিছুক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করবে, এরপর খাবার টেবিলে একে একে সব খাবার নিয়ে আসবে। এরকম আগেও হয়েছে তা না, তবে আমি ওর গতিবিধি বুঝতে পারি। শিউলি এখন রাগের দ্বিতীয় সীমায় আছে, এর বেশি রাগালে খবর আছে। রাগের তৃতীয় সীমা লঙ্ঘন করলে শিউলি বাচ্চাদের মতন হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।
ওয়াশরুমে আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে দিলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে খাবার টেবিলে আব্বার পাশের চেয়ারে বসলাম। আব্বা-আম্মা, ছোটবোন বিথী সবাই খাওয়া শুরু করেছে, শিউলি শুধু আমার জন্যে এখনও বসে আছে।
শিউলি আমার প্লেটে ভাত দেওয়ার সময় আব্বা জিজ্ঞাস বলল—বউ মা আজকের মাংসটা খুব ভাল রেঁধেছো, কাচা মরিচের ঝালটা ভাল লাগতেছে দাও আরেকটু দাও। আব্বার প্লেটে মাংস তুলে দেওয়ার সময় বিথীও বলল, ভাবী আজকের রান্নাটা জোশ হইছে, ঝালটা একটু বেশি হইছে যদিও। আম্মা বলল, ঝাল হইছে দেখেই তো মজা লাগতেছে, দাও বউমা আমাকেও একটু দাও।
শিউলির মুখটা কালো হয়ে আছে, এর কারণ হচ্ছে রান্নার ক্রেডিট তাকে দেওয়া হচ্ছে, রান্নাতো সে করেনি রান্না করেছি আমি, এখন সবাইকে তার বলতে হবে, রান্নাতো আমি করিনি, নিবিড় রেঁধেছে। আমার উপর রেগে থাকায় আমার নাম সে মুখে আনতে চাইছে না, কিন্তু না এনেও উপায় নেই, কারণ তাহলে সে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবে। আমি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছি।
আব্বা আবার বলল— বউ মা মাঝে মাঝে এইভাবে রান্না কইরো, ভিন্ন স্বাদ ভালই লাগে।
—বাবা রান্নাতো আমি করিনি, আপনার ছেলে করেছে।
—তুই রান্না করছিস?
—হু।
আম্মা আমাকে নিয়ে ছোট থেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আব্বাকে উদ্দেশ্য করে আম্মা বলল— নিবিড় যে ছোট থেকেই ভাল রান্না করে তা মনে হয় আপনি জানেন না? যারাই ওর রান্না খাইছে সবাই ই প্রশংসা করছে।
আমি রান্না করেছি জানতে পেরে আব্বার মনে হয় জ্বলতে শুরু করেছে, তিনি সবজান্তার ভঙ্গিতে বলল— এতো ঝাল দিলে গ্যাষ্ট্রিকের সমস্যা হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা এমন যে, কিছুক্ষণ আগে তার বউমা রেঁধেছিল তাই সবকিছু পারফেক্ট ছিলো, খুব টেস্ট হইছিলো, এখন শুনছে আমি রান্না করছি, এখন একে একে ক্ষুত বের হতে শুরু হইছে।
একটা এলাচিতে কামড় পরতেই তিনি বলল, এতো এলাচি দিছিস কেন?
আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম শিউলির মুখে হাসি ফুটেছে, আনন্দে আত্নহারা হয়ে যাচ্ছে সে।
আম্মা আব্বাকে বলল, শুধু শুধু ক্ষুত বের করতেছেন, নিজেতো রান্নার ক’ও বোঝেন না অন্যের রান্নার দোষ বের করতেছেন।
—কি! আমি রান্নার ক’ও বুঝিনা? জীবনে তো কম রান্না করে খাওয়াইনাই, এত্তো বড় অপবাদ।
—খাওয়াইছেন, কোনদিন তেল বেশি, কোনদিন লবণের জন্যে মুখে দেওয়া যায় নাই।
আব্বা-আম্মার এই তর্ক দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকবে। এরপর যখন তারা টেবিল থেকে উঠবে তখন দুইজনের সাথে দু’জনের কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে উঠে ছাদে চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে শিউলিকে ম্যাসেজে লিখলাম দুই কাপ চা নিয়ে ছাদে আসো। শিউলি রিপ্লাই করল—পারব না, কিন্তু আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই শিউলি দু’টা কাপ, চায়ের ফ্ল্যাক্স নিয়ে ছাদে হাজির হবে।
মিনিট দশেক পর শিউলি ছাদে এলো। চায়ের কাপ, ফ্ল্যাক্স ছাদের রেলিংয়ে রেখে বলল— দেখি হাত দেখি।
—কেন?
—কতটুকু কেটেছে দেখি।
—কাটেনি।
ধুর বলেই শিউলি আমার ডান হাতে মোবাইলের আলো ফেলে বলল— ভালই তো কেটেছে।
—হাত কেটেছে তুমি জানলে কি করে?
—আমি সব জানি।
—তো আর কি জানো?
আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে শিউলি বলল, আপনার নক্ষত্রের পুরোটাই জানি।
—কি করে জানো?
—তাতো বলা যাবে না।
—কেন বলা যাবে না?
—খুব সিক্রেট।
—আব্বা-আম্মার ঝগড়া থামছে?
কাপে চা ঢালতে ঢালতে শিউলি বলল— দুইজন উঠে চলে গেছে।
—জানি।
—কিভাবে জানো?
—অভিজ্ঞতা বুঝলে অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার ফলে কয়েকটা চুলে পাক ধরেছে। তুলে দাও তো।
শিউলি চাঁদের জোছনায় একটা একটা করে পাকা চুল খুঁজতে শুরু করল। আমি জানি শেষ পর্যন্ত একটা পাকা চুলও সে তুলে দিবে না, কিন্তু দীর্ঘ সময় সে এমনটাই বোঝাবে যেন সে পাকা চুলই খুঁজছে। এসবই আমার অভিজ্ঞতা, বুঝলেন?
“অভিজ্ঞতা”।