নির্বান্ধব

নির্বান্ধব

মেয়েটার নাম ছিল সম্ভবত দীপ্তি।স্কুলড্রেসে সব সময়ই মালিন্য লেগে থাকতো।চুলটা কান অবধি ছোট করে চাইনিজ কাট।মুখটা একেবারে বাতাসার মতো ছোট্ট আর শুকনো।কানে দুটো পাতলা তোবড়ানো সোনার রিং।হয়তো পাশে এসে বসেনি মেয়েটা কোনদিনও।লাস্টের দিকের কোনো না কোনো বেঞ্চেই বসতো সম্ভবত।খুবই সাধারণ ক্লাসরুমের ভিড়ে মিশে থাকা একটা মুখ।যদ্দূর মনে পড়ে,পড়া বলতে হাত তোলেনি কোনোদিন,মেধাতেও ততোধিক সাধারণ।

সদ্য রূপটানে সচেতন হওয়া বয়সের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তখন সবাই।হঠাৎ একদিন কক্ষণো কথা না বলা দীপ্তি অনেকটা ব্যবধান পেরিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে এসেছিল টিফিন টাইমে।সবার পরিপাটি ঝকঝকে তকতকে উজ্জ্বল সাদা স্কুল ড্রেসের পাশে ও কে নিতান্তই বেমানান লাগছিল।কেউ কেউ তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল অন্য পাশে ঠুনকো অহংকারে।কি জানি ঠিক কিসের ছিল সে অহং,ফার্স্ট বেঞ্চ,নাকি ফরসা জামা, নাকি মেধার।হবে কিছু একটা,কাঁচা বয়সে তো কত কিছুরই মোহ লাগে পর্দা পরা চোখে।আর কয়েকজনের আবভাব খুব স্বাভাবিক না হলেও তুলনায় খানিক সহজই ছিল নিশ্চয়ই,নইলে চুপচাপ এককোণে বসে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করে এতোগুলো একেবারে নিতান্তই নিজের মনের কথা বলে ফেলবে কেন।

ইতস্ততবোধ কাটিয়ে ওঠার খানিক পরেই খেয়াল হয় সবার,হাতে একটা বিয়ের কার্ড ধরে আছে দীপ্তি।সবার উৎসুক মনের মধ্যে হাজার টা সম্ভাবনার উঁকি, হয়তো বাড়িতে দাদা, দিদি, বা কাকা, পিসি কারোর বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে চাইছে।কিছু এঁচোড়ে পাকা সব দলেই থাকে,তেমনই কেউ বোধহয় অত্যধিক মাথা চালিয়ে বলে ফেলেছিল,

‘কিরে, তোর বিয়ে নাকি?তোদের মধ্যে তো বুঝি খুব অল্প বয়সেই বিয়ের চল তাই না? ‘

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে একভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে দীপ্তি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিল, “না, আমার বাবার বিয়ে,এই ২৬শে জানুয়ারী।”

সবার বেকুবের মতো মুখ হাঁ হয়ে গেছিল কিছুটা সময়ের জন্য।তারপর কথা সরলো যখন,তখন আর থামতেই চায় না কেউ।সবার চোখেমুখে দ্বিগুণ উৎসাহ,ঠিক যেন বোমা ফেলেছে কেউ ক্লাসরুমের মাঝে।কৌতুহলী প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেছিল সবাই দীপ্তিকে।বেচারি দম নেবার ফুরসত পাচ্ছিল না উত্তর দিতে দিতে।দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্বের পর মোটামুটি যা জানা গেল তার সারমর্ম এই যে মা মরা মেয়ে,মা মরেছে বহুকাল,তার বাবা আবার বিয়ে করছে সংসারের প্রয়োজনে মানে যেমন লোকসমক্ষে বলা হয়েছে আর কি,ঘুষ বাবদ মেয়ের বাবার বিয়েতে পাওনা দু চারটে নতুন ড্রেস,একটা বড় টেডি বিয়ার,আর বিয়েতে ইচ্ছেমতো বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করার সুযোগ।ঘুষ শব্দ টা যদিও বেড়ে পাকা সহপাঠীদের সংযোজন ছিল।তাদেরই কেউ বোধহয় এসব জেনেবুঝে নিয়ে তারপর বলেছিল,

‘ইস তোর কি ভাগ্য রে,নিজের বাবার বিয়ে দেখতে পারবি!কত গিফ্ট,কত খাওয়া দাওয়া,সাজগোজ,আনন্দ।’

ঠেস দিয়ে বলেছিল না অপাপবিদ্ধ সরল মনে সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না যদিও।কিন্তু সে কথা শুনে দীপ্তির মুখের সব দীপ্তি নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল একথা ঠিক।কার্ড বিলি করে নিজের জায়গায় যাবার সময়,আবার পিছনে ঘুরে ফিরে এসে ছিল দীপ্তি।ফিসফাস গুঞ্জন লক্ষ্য করেও না দেখার ভান করে কাঁচুমাচু হয়ে কুণ্ঠিত স্বরে বলেছিল,

“আমার তো আলাদা করে কোনো ভালো বন্ধু নেই,তোদের কারো বাড়িতে আমাকে একটু থাকতে দিবি সেদিন টুকু?সেদিন তো প্রজাতন্ত্র দিবস স্কুল ছুটি তাই স্কুলে তো আসার উপায় নেই,ঐজন্য বাবা বলেছে মামা বাড়িতে দিয়ে আসবে,সে তো অনেক দূর,সেখানে গেলে যেতে আসতে বহুদিন, অনেকদিন স্কুল কামাই হয়ে যাবে,আমার তো বাড়িতে স্যার নেই কোনো,স্কুল কামাই হলে খুব মুশকিল।”

সবাই বোধহয় যুতসই কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে ভুলভাল অজুহাতে এড়িয়ে গেছিল সেদিন দীপ্তিকে।সবার নিরুত্তাপ মুখ দেখে ধীর পায়ে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে যেতে দীপ্তি হঠাৎই একবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিল খানিকক্ষণ,কে জানে কেন,হয়তো একটা হ্যাঁ বাচক উত্তরের আশাতেই।কে জানে কোথা থেকে কোনোদিন কথা না বলা এক ক্লাসে বসা সহপাঠীদের ওপর এতটা ভরসা করার জোর এসেছিল ওর মনে।সোজাসরল ওর ছোটো ছোটো চোখ দুটোতে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ কেউ পড়তে পারেনি সেদিন।হয়তো সবটা পড়তে পারার কথাও ছিল না শৈশব কৈশোরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো মুখগুলোর।

জানি না দীপ্তি এখন কোথায়,কি করছে,কেমন আছে,কিংবা আদৌ আছে কিনা!সেইদিন ক্লাসরুমের নিরুত্তর নিস্তব্ধতাকে কি ক্ষমা করতে পেরেছিল দীপ্তি নাকি সেসব ওর আজ আর মনেও নেই।হয়তো বা সময় সব ক্ষতেই ঠিক প্রলেপ লাগিয়েছে ধীরে ধীরে।

সেদিন ক্লাসরুমে দীপ্তি আসলেই বড্ড একা ছিল,ও ভেবেছিল,হয়তো খুব ভালো বন্ধু নয় কিন্তু সবাই ওর বন্ধু অন্তত।খুব ভুল ছিল মেয়েটা,নিশ্চয়ই বয়সের ভারে আজ নিজের নির্বুদ্ধিতাতে নিজেই হাসে একা একা।সহপাঠীদের সহমর্মী বন্ধু ভাবার ভুল আর কখনো করেনি হয়তো ওর পরে।

মাঝে মাঝে নিষ্পাপ অবুঝ শৈশবও বড় নিষ্ঠুর হয়।আসল কথা হলো বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ মানুষের কাছে গোটা পৃথিবীটাই রঙ ঢঙ মুছে সাদাকালো নিষ্ঠুর হয়ে ধরা দেয়।

সবার অন্তত একটা করে ব্যথা বোঝার মতো সহমর্মী বন্ধু থাকুক কচি বয়সে,যতদিন না ব্যথা সামলে বুকের ভেতর চাপতে শেখার বয়স হয়ে যায়।

পুনশ্চঃ ফার্স্ট পার্সনে খুবই কম লিখি,তাই উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে হলো,লেখাটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত