সকাল থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি একটা গল্প লিখব বলে ।কী নিয়ে লিখব তা ভেবেচিন্তে ঠিক করে নিলেও গল্পের শুরুটা কেমন হবে তা সাজাতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলি। দু’চার লাইন লিখে মুছে ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে লেখার চেষ্টা করছি। নাহ গল্প আর কিছুতেই এগুয় না । খেই হারিয়ে ফেলি। আর যা হয় তাতে আমি নিজেই সন্তুষ্ট নই।কে পড়বে আমার এ ছাঁইপাশ গল্প। গল্পতো নয় যেন রদ্দিমার্কা ফটফটানি। বুঝতে পারছি পাঠক আমার এই গল্প খাবেনা। গল্পের শুরুটা চমকপ্রদ না হলে কী আর পাঠক ধরে রাখা যায়? আমার এই প্যানপ্যানানি মার্কা কথা-বার্তা পাঠক শুনবে ক্যান? আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রথম প্যারা পড়েই পাঠক কেটে পরবে । কিন্তু গল্পটা যে আমাকে লিখে শেষ করতেই হবে !এটা জীবনের গল্প।
আচ্ছা গল্প বাদে কবিতা লিখলে কেমন হয়? যে কবিতায় থাকবে জীবনের গল্প। বাস্তবতার সুর। এখনতো ব্লগ বাজারে কবিতাই বেশি চলে। কেমন কবিতা? গদ্য না পদ্য? আবেগে আপ্লুত হই। উত্তর মিলেও যায় । ছোট্ট ক’লইনের একটি কবিতা মূহুর্তে লিখেও ফেলি। বাহ, বেশ মানিয়েছে তো লাইনগুলো ! নিজের কাছেই বেশ লাগছে। ছন্দময়ও হয়েছে মনে হয়। শিরোনামটাও চমত্কার লাগছে- “ওরা সবাই ফটকা”। এই ফটকাদের নিয়েই এখন যতসব খটকা। পুঁজি বাজারও নাকি ফটকা বাজার। মন্ত্রী বলেন দুষ্টু বাজার। কে জানে ওই বাজারে যারা পুঁজি খাটায় তাঁরা সবাই দুষ্টু কিনবা ফটকা কিনা ? পড়ে দেখা যাক কবিতাখানা ।
আম জাম লিচু কলা
মিলছে সব টাটকা
বাজারে আরো আছে
ইলিশের জাটকা!
টাটকা-জাটকা এই নিয়ে
কেন এতো খটকা?
ভেজাল যদি রুখতে চাস
এক্ষুনি সব আটকা ।
এই কাজটি করছে যারা
ওরা সবাই ফটকা
আইনের চোখে সবাই সমান
এদের ধরে লটকা ।
কবিতা হলেও এটা তো বাস্তবতারই চিত্র। কোন নাটক-সিনেমার গল্প নয়।আমাদের পথচলার বাস্তব গল্প। যাক, পাঠক বোধহয় এই কবিতা এবার খাবে। গল্পের চেয়ে কবিতা দ্রুত পড়ে ফেলা যায়। সুবিধাটা ওখানেই। আর ফরমালিন খেয়ে খেয়ে পাঠক যেই অবস্থায় দাড়িয়েছে তাতে এই কবিতাটা ভালো লেগে যেতেও পারে । ফরমালিনের কত শক্তি !
এর আগেও যে কবিতা লিখিনি তা কিন্তু নয়।উঠতি বয়সের প্রেম আর কবিতা লেখার হাতেখড়ি ভুলে যাই কী করে! তখন তো আর এত্তসব ব্লগের কারবার ছিলনা। তাই কেউ জানতোই না এই গোবেচারা কবির খবরা-খবর। এখন ডিজিটাল যুগ।প্রকাশকদের ধরাধরি নেই। নেই কোনো দরকষাকষি। যা লিখি সবই তো প্রকাশিত হয় ! মূহুর্তেই পাঠক কবিতা পড়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকে। ফেসবুকসহ সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো কতই না সহজ করে দিয়েছে কবি হওয়ার যোগ্যতা। কত কবিতা লিখে ফেসবুক আর ব্লগে পোস্টিং দিয়েছি। পাঠক মুগ্ধ হয়েছে। বাহবাও পেয়েছি বেশ। জন কয়েক সুহৃদ ক্রমাগত লাইক দিয়ে উত্সাহ দিয়েছেন তাতে। আর সেই থেকেই কবি হওয়ার সাহসটা বেড়ে যায়। না, আমি তো কবি হতে চাইনি । নির্মলেন্দু গুণের মত কবিতা লেখার অত মহাগুণ তো আমার নেই ! কিন্তু এই কী দেখছি আমি ! এখন দেখি স্বভাবেও কবি কবি ভাব ! ভয়ও পাচ্ছি । সমাজে এবং স্বগৃহে কবিদের যে অবহেলা!
মনীষা বেশ তাড়া দিচ্ছে ওর দেয়া একটা ফরমায়েশের কাজ অতি দ্রুত সেরে দেয়ার জন্যে । কাজটা কী তখনও সে আমাকে স্পষ্ট করে বলেনি। ও’ সব সময়ই আমাকে এমন রহস্যের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। এটা তাঁর খামখেয়ালিপনা কিনা তাও আমার ডিজিটাল এন্টেনায় ধরা পরেনা। ওর এই রহস্যগুলো আমার অবশ্য বেশ ভালই লাগে। মাঝেমধ্যে ওকে খুব আল্লাদিও মনে হয়। ওর আল্লাদে আমিও পুলকিত হই। তবে কোনটা রাগ, অনুরাগ তা মিলাতে গিয়ে প্রায়শই তালগোল পাকিয়ে ফেলি। রাগ-অনুরাগের জটিল মানবিক সম্পর্কগুলো বিচার করতে হিমশিম খেলেও রাগের মধ্যেও যে কত অনুরাগের নির্মোহ স্পর্শ দিয়ে সে আমাকে জড়িয়ে রাখে তা আমি টেরপাই অনেক পরে । যখন বুঝতে পারি তখন আর তাঁকে কিছুই বলার থাকে না । খানিকটা প্রশংসা করব সেটাও হয়ে উঠেনা ।একটা দুষ্টু বাতিক আমাকে সবসময় দুরে সরিয়ে রাখে। আমি নাকি ওর প্রশংসা করতে বেজায় কৃপণ। এই অভিযোগ মনীষার। এই নিয়ে ওর সাথে আমার খুনসুটি আর মান-অভিমানও কম হয়নি।তাঁর একটাই অভিযোগ আমি সর্বদাই পর নারীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
মনীষা বেশ সহজ সরল । তাই ওর সব কথার অত্ত হিসাব আমি রাখিনা । তাঁর সরলতার দৃষ্টান্ত সে নিজেই। তুলনাহীন এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সচরাচর খুঁজে পাওয়া ভার ।তবে অনেকটা স্টার-জলসার ‘বধুবরণ’ সিরিজের বউরানী ‘কনক’ এর চরিত্রের মত মনে হয়।নিজে ভষ্ম হলেও অন্যের ভালো করাটাই যেন তাঁর জীবনের একমাত্র আরাধনা। মনীষার এই চারিত্রিক গুণাবলী উত্তরাধিকার সম্পত্তির মতো প্রাপ্ত হলেও সে যেন তা অর্জন করেছে নিজের মত করে একান্ত স্বকীয়তায় । কোমলমতি নারীদের এই স্বভাব আমাকে আকৃষ্ট করলেও প্রতিবাদী না হওয়ায় এদের প্রতি মনের অজান্তে গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পেলেও মাঝেমধ্যে তীব্র রাগ অনুভূত হয়। এই রাগ আবার বেশিক্ষণ ধরেও রাখতে পারিনা। কখন যে ভালবাসার হেয়ালি আকর্ষণ আমাকে কাবু করে দেয় তা নিজেও টের পাইনা। মনীষার মমত্ববোধ এবং সীমাহীন নির্মোহ আন্তরিকতার হিসাব-নিকাশ করাটাও যেন বোকামি।
আমি নিশ্চিত, যে কোনো মানব-মানবীকেই ঈর্ষান্বিত করে ফেলবে আমাদের এই গোপন সম্পর্কের বিষয়টি। মনীষার কিছু কিছু ঈর্ষণীয় বিষয় আমাকে এমনভাবে মুগ্ধ করে যে, মনে হয় ঈশ্বর তাকে পয়দা করেছেন শুধুমাত্র একজন মানবের জন্যই ! যে জীবনে কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। মনীষার জীবনের একমাত্র আরাধ্য পুরুষ তার এই ভালবাসার মানুষটি।
যাক গল্পটা এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়েছে।পুরো গল্পটা আমাকে শেষ করতেই হবে। আমি জানি গল্পের এই প্লটটা একবার মাথা থেকে খসে পড়লে কখন যে আবার রাজনীতি এসে চেপে বসবে তা ঠাওর করাও মুশকিল। তাই তরতাজা এই প্লটটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যাবে না। আর ফরমালিনযুক্ত রাজনীতি মস্তিষ্কের অন্দরমহলে একবার প্রবেশ করলে সাহিত্য চর্চার সুকুমারবৃত্তিগুলো যে বিষক্রিয়ায় নিস্তেজ হয়ে যাবেনা তার গ্যারান্টিই বা কে দিবে ? দেশের শীর্ষনেত্রীরা যে ভাবে ফরমালিন দিয়ে প্রতিপক্ষকে বাঁচিয়ে রাখছে তারা কী আমাকে সেই ভাবে বাঁচিয়ে রাখবে শুধুমাত্র একটি গল্প লেখা শেষ করার জন্যে! তবে রাজনীতিতে যেভাবে ফরমালিনের ছিটাফোটা দিন দিন বৃদ্বি পাচ্ছে তাতে দেশের রাজনীতি অচিরেই সতেজ হয়ে রূপে-গুনে অতীত যৌবন ফিরে পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মনীষা এখন কর্মস্থলে ব্যস্ত রয়েছে। স্বগৃহে আমি একা। পোষা বিড়ালটা পাশেই ঘুমোচ্ছে। বিড়ালটা ঘুটঘুটে কালা। জাতে বেঙ্গল ক্যাট। কালো হলেও সে অন্যসব ‘কালা বিলাই’ এর মত আচরণ করেনা। আচরণে বেশ সাদা সাদা ভাব। যাকে বলে নিরেট ভদ্র। চুরি চামারি করে খাওয়ার স্বভাব তার একদম নেই।হাতের কাছে খাবার পেলেই খামখাম করেনা। মনিবের প্রতি আস্থা অর্জন করেছে শতভাগ। তাই মনিবও সন্মান দেখিয়ে ঘরে একাকী রেখে বেরিয়ে যাওয়ার সাহস পায়।যেখানে যেমন প্রয়োজন ভরসা করা যায়। সব কালা বিলাইকে তো আর ভরসাও করা যায়না। এরা রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কখন কী করে বসে তা বুঝা মুশকিল। মনিবও টের পায়না। যাক বিলাই নিয়ে আর এগুবো না। ও এখন ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। দেখা যাক এই ফাঁকে মূল গল্পটা শেষ করা যায় কিনা!
কী হলো আমার? হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে ফেললাম। খেই হারানো সুরের মত লেখার গতিটাও থেমে যাচ্ছে যে! মাথা থেকে হঠাৎ করেই গল্পের প্লটটা হারিয়ে যেতে লাগলো । তবে মন্দের ভালো রাজনীতি এসে ভর করেনি। চোখে কেমন যেন ঝাপসা দেখছি। দৃষ্টিশক্তির এমন অবনতি এর আগে কখনো ঘটেনি তো ? টাইপ করতে গিয়ে কীবোর্ডটাও হারিয়ে ফেলছি বারবার। মস্তিষ্কের কোথায় যেন একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া টের পাচ্ছি। শ্বাস-প্রশ্বাসেও ব্যাঘাত ঘটছে কিছুটা।চোখ ও মস্তিষ্কের এমন প্রতিক্রিয়া একসাথে এর আগে কখনো হয়নি তো!
দিন কয়েক আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম শরীরে ফরমালিনের মাত্রা বৃদ্বি পেলে এমন প্রতিক্রিয়া হয়। আমার তেমন কিছু হয়নি তো? কী অদ্ভূত ব্যাপার ওই লেখার সাথে আমার সবকিছুই যেন মিলে যাচ্ছে । ওই লেখায় ছিল রক্তে অম্লত্ব বৃদ্ধি পেয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসে ক্রমশ অবনতি ঘটতে পারে। আবার ফরমিক অ্যাসিড শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটিয়ে যকৃত ও কিডনিতেও আক্রমন করে থাকে! মনীষা কী জানে ফরমালিনের কারণেই আমার শারীরিক অবনতি এইভাবে ঘটছে ! ও এখন কর্মক্ষেত্রে ভীষণ ব্যস্ত।
আমি যে আর গল্প লেখা চালিয়ে যেতে পারছিনা! কী হবে এখন? তরতাজা প্লটটা মাথা থেকে একবার খসে পড়লে আবার ফিরে পাবো তো? কী যন্ত্রণা আমার! গল্পের প্লটটি আবারও হারিয়ে যাচ্ছে। মনীষাকে কতবার কথা দিয়েছিলাম একটা গল্প লিখব। নির্মোহ জীবনের গল্প। যে জীবনে কোনো চাওয়া নেই,পাওয়া নেই। আছে শুধু ভালবাসা।
মনীষা কে দেয়া কথা আর রাখতে পারছিনা।আকাশে উড়ন্ত প্লেনের মত দূর দিগন্তে অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গল্পের সতেজ প্লটটি। গল্পটি শেষ করতে না পারলেও অন্তত একটি কবিতা লিখতে চাই । কারণ আমি কবিতাও বড্ড ভালবাসি । শুধু গল্পে নয়, কবিতায়ও বাস্তবতা থাকে। বেঁচে থাকার প্রেরণা থাকে। থাকে আকুতি, মিনতি। শুধু একটু ফরমালিন পেলেই কেল্লাফতে।অন্তত দিনকয়েক সতেজ থাকতে পারবো। সতেজ থেকে থেকে মনীষাকে দেয়া আমার কথাটিও রাখতে পারব। আমি আবারও সতেজ হতে চাই। সতেজ থাকার জন্যে একটু ফরমালিন চাই ।
আমাকে একটু ফরমালিন দেবে?
আমি কচি মুরলী বাঁশের মতো
অনবদ্য সরস ফুলের মতো
রূপ, ঘ্রাণে ঝরঝরে থাকতে চাই
আজকাল মাছেরা যেমন থাকে
তরতাজা সতেজ
ফলেরা যেমন থাকে চকচকে টাটকা
আমিও তেমন থাকতে চাই
টাটকা ও সতেজ।
হাড়-মজ্জা ক্ষয়ে যাওয়া যন্ত্রণা
শেষ বারের মতো আমি
ঝলমলে দেখতে চাই
আমি ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ না হয়ে
মৃত্যুর আগে আর একবার
সতেজ হয়ে বাঁচতে চাই
দেবে, আমাকে একটু ফরমালিন?
একটু ফরমালিন পেলে আমি আবারও গল্প লিখবো। মনীষাকে দেয়া কথাটি রাখতে পারবো। আমাকে যে বাঁচতে হবে । মনীষার জন্যই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।