সকাল আটটার এলার্ম দিয়ে ফোনটা খুব কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। এতটাই কানের কাছাকাছি রাখলাম যেন এলার্ম বাজার প্রথম ধাপেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। কাল ১৪ ফেব্রুয়ারি,ভালবাসা দিবস। আমার জীবনের বিশেষ একটি দিন। আমার জীবনের বিশেষ একজন মানুষের সাথে নতুন করে জীবন শুরু করার দিন। কাল আমাদের ২২-তম এনিভার্সেরির দিন।
এলার্ম বাজার সাথে সাথেই লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। বাবাকে চা দিয়েই সাথে সাথে রান্না বসানো শুরু করলাম। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বাবা বলল,
-আমিতো রাতেই রান্না করে রাখছি মা
-আমি বাসার জন্য রান্না করছিনা বাবা। আমার এক বন্ধুর জন্য রান্না করব
“ওহ” শব্দটা বাবার মুখ থেকে বের হলো কি না জানিনা, কিন্তু আমার কানে এরকম শব্দটা উচ্চারিত হচ্ছিলো বারবার।
বাবার সাথে কথা না বাড়িয়ে রান্নায় মন দিলাম। তার পছন্দের পাবদা মাছের ঝোল করলাম। ফুলকপির সাদা ফুলের অংশটা দিয়ে গরুরমাসের কাবাব করলাম। বাসায় রাখা সুগন্ধি চালের ড্রাম এক সাইডে ফেলে রেখে মোটা আতপ চালের সাদাভাত করলাম। সাথে আমার মায়ের রেসিপিতে পায়েশ করলাম। প্রতিটা রান্না করার সময় আমি খুব যত্ন করে টেস্ট করে দেখছিলাম পাবদার ঝোলে লবণ বেশি হলো না তো? ফুলকপির টুকরো গুলো খুব বেশিই কি বড় হয়ে গেল! ভাতটা খুব বেশি নরম হয়ে গেলে সে আবার খেতে পারবেনা। পায়েশের মিষ্টিটা আজ খুব বেশি হয়ে গেলেতো মুশকিল!
রান্না সেরে গোসল করে নিলাম। টকটকে বেগুনি শাড়ির সাথে হলুদ কালারের ব্লাউজ আর নীল রঙের টিপ পড়লাম। দেখতে বিদঘুটে লাগলেও এটাই তার প্রিয় সাজ। ঠিক ১২ টা বাজার ৫ মিনিট আগে আমার রান্না করা তার প্রিয় খাবারগুলো টিফিনবক্সে ভরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
আমাকে হঠাৎ তার অফিসে দেখে কমবেশি সবাই অবাক হয়ে গেল। আমার বিশেষ মানুষটি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল আমি অসুস্থ কি না! আমার জ্বরটা আবার বাড়লো কি না!
অফিসের বাগান টেবিলে আমরা দুজন বসে আছি। আমার সামনে বসে আমার বিশেষ মানুষটি কেমন যেন উসখুস করছে। বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছি এভাবে হুট করে এসে বুঝতে পারছি। টিফিনবক্স খুলে তার পছন্দের খাবারগুলো সামনে রাখতেই সে আমার দিকে তাকালো। তার চোখে অস্বস্তির বদলে আমি বিস্ময় দেখতে পাচ্ছি। হুট করে হার্টফেল হওয়ার মত বিস্ময়।
-আমি তোমাকে খাইয়ে দেই?
অবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে তার চোখের জল চিকচিক করছিল। হাত ধুয়ে আসার বাহানায় উঠে আসলাম তার সামনে থেকে। আসার আগে একটা হলুদ খাম আর একটা ধূসররঙের খাম তার হাতে দিয়ে আসলাম।
আড়াল থেকে দেখছিলাম ধূসররঙের খাম খুলে আমার চাকরির জয়েনিং লেটার দেখে তার চোখের চিকচিক করা পানিটা আরেকটু বেশি ঝলসে উঠছিল। চোখেমুখের অস্বস্তি আর বিস্ময় কেটে গিয়ে আনন্দের আভাস ফুটে উঠছিল৷ আমি আড়াল থেকে অপেক্ষায় ছিলাম হলুদ খামের চিরকুটটা তার চোখের সামনে মেলে ধরার। সে যখন চিরকুটটা খুলে মনে মনে পড়ছিল, তার উচ্চারিত প্রতিটি আওয়াজ যেন আমি দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম।
……
চিরকুটঃ
“মায়ের মৃত্যুর পর যখন নিজেকে সবচেয়ে অসহায় মানুষ হিসেবে ভাবা শুরু করেছিলাম,তখনই তুমি সবথেকে কাছের মানুষ,সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে আমার জীবনে এসেছিলে। ধন্যবাদ বাবা সেই দিনটির জন্য।
.
দাদীর কথার উপেক্ষা করে দ্বিতীয় বিয়ে না করে আমাকে নিয়ে এই অজানা শহরে পালিয়ে এসেছিলে বলে আজ আমি ” আমি” হতে পেরেছি। ধন্যবাদ বাবা সেই সময়টার জন্য৷
তোমাকে ধন্যবাদ বাবা, জীবনের ২২ টি বছর আমাকে আগলে আগলে রাখার জন্য। মায়ের জন্য কখনও মন খারাপ না হতে দেওয়ার জন্য। আমার সব অন্যায়, অশান্তি ভালবাসা দিয়ে দূর করার জন্য। পছন্দের পাবদা মাছের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ আমার পরীক্ষার ফি দেওয়ার কথা মনে হওয়ায় সানন্দে ছোট মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য। তুমি বাড়ি ফিরে কি খাবে তা চিন্তা না করেই তোমার রান্না করে যাওয়া খাবারটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পরও রাতে বাড়ি ফিরে আমার গায়ে চাদর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য৷ প্রতি ঈদে,জন্মদিনে আমার মাঝে নতুনত্ব সৃষ্টি করে সারাবছর নিজে জাস্ট কোনোভাবে চালিয়ে দেওয়ার জন্য।
ধন্যবাদ বাবা “ইরা” নামের সত্ত্বাকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য। সকল অন্যায়,হিংসা,দ্বেষ ভুলে সকলকে ভালবাসতে শেখানোর জন্য।
অবশেষে তোমাকে ধন্যবাদ বাবা, আমার বাবা হওয়ার জন্য।
শেষের লাইনে লাল কালির অক্ষরে লিখা ছিল,
ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা নিও সুপারহিরো বাবা।”
চিরকুট পড়া শেষ করে বাবা হাউমাউ করে কেঁদে দিল। বাচ্চাদের মত এদিকওদিক তাকিয়ে আমাকে খুঁজছিল। আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বাবার হাত ধরে বললাম, চাকরির রিজাইন লেটারটা লিখে তোমার বসের রুমে দিয়ে আসতে পারবে? এই শেষ কষ্টটা একটু করতে পারবে?
বাবা আমার হাত ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদে চলেছে। আমি বাবাকে কান্না থামাতে দিচ্ছিনা৷ আজ আমার বাবা বিলাসের দিন। বাবার চোখের লবণাক্ত অশ্রুতে মুগ্ধ হওয়ার দিন। বাবার জীবনের “মেয়ে” থেকে “মা” হয়ে উঠার দিন।