– ভেবে দেখ! রাজি তো?
– হ্যাঁ গো হ্যাঁ। আর কতবার বলব।
– না! এখনো যদি কোনো লুকোনো ইচ্ছে থেকে থাকে।
– না গো। আমার এখন ওই একটাই ইচ্ছে।
– বেশ তাহলে তৈরি হয়ে নাও। ওরা অফিসে বেড়িয়ে গেলে আমরাও রওনা দেব।
– বুবুনটার কষ্ট হবে। ওর তো মায়া বেশী।
– দীপু যখন ছোটো ছিল ওরও অমন মায়া ছিল। সেবার নীপা হবে বলে তুমি হাসপাতালে ছিলে, ছেলের কি কান্না। ওর মা নাকি মরে যাবে। কার কাছে শুনেছিল যারা হসপিটালে যায় তারাই মরে যায়। মনে নেই মা কত কষ্ট করে ওকে সামলেছিল।
– মনে নেই আবার! কবে থেকে বলোতো দীপুটা বদলে গেল?
– দিনক্ষণ কি আর সেভাবে বলা যায়? চুপি চুপি কবে যে বদলে গেল!
– মনে আছে ভিত-পূজোর সময় ওর নামেই পুজো দিয়েছিলে। বলেছিলে নিজেরটা দেখে বুঝে নে। সব কিছু তো ওদেরই ছিল বল। ওদের জন্যই তো তুমি অত কষ্ট করতে। ভালো স্কুল, ভালো মাস্টার। লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়তে কষ্ট হবে তাই অত দামি দামি বই কিনে দিতে।
– সে তো সব বাবারাই চায় সন্তান থাকুক দুধেভাতে। নতুন কি আর করলাম। নীপার বিয়ের সময় তুমিই বরং সব গয়না দিয়ে দিলে। এখন সিটি গোল্ড পরে সম্মান বাঁচাও।
– আহা! তখন পারতে অত গয়না গড়িয়ে দিতে? দীপুর তিনটে সেমিস্টারের খরচ বাকি তখনো।
– আচ্ছা নীপা তো মেয়ে। বৌমাকে দেখ, বাবা-মায়ের জন্য কত ভাবে। অথচ আমাদের মেয়েটা-
– না গো! ওকে কিছু বল না। ওকে তো সংসারটা সামলাতে হয়। তার ওপর ওই দুষ্টু ছেলে।
– রাখতো! দাদা-বউদির সঙ্গে গুজগুজ ফুসফুস করার সময় পায় কি করে?
– কি করবে বল? পোড়া কপাল আমাদের। ঠিকমতো মানুষ করতে পারিনি।
– রাবিশ! আমরা শিখিয়েছিলাম বাবার জমানো টাকা কোথায় কি আছে খুটেখুটে নিজের করে নিতে? আমরা শিখিয়েছিলাম মায়ের নামের বাড়ি কেড়ে নিতে? আমরা পাঁচ ভাই। মা মারা যাওয়া অব্দি ভাড়া বাড়িতে থেকেছি। দেশের বাড়ি বিক্রি করিনি। দীপু দেখেনি? কু-শিক্ষা না গো, আজকালকার ছেলেমেয়ে গুলো যেন কেমন। সব কিছুতে সিকিউরিটি খোঁজে।
– নিরস গদ্যময় জীবন ওদের। বাস্তববাদী হতে গিয়ে স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে।
– আমরাও বাস্তববাদী ছিলাম কিন্তু মনটাকে খোলা রাখতাম।
– আচ্ছা! তিলতিল করে গড়া আমাদের এই বাড়িটাতে ওরা যখন একা হবে আমাদের কথা মনে পড়বে না? খারাপ লাগবে না!
– আছো তো এতদিন। মনে পড়তে দেখেছো? কেমন করে দিন কাটাচ্ছি জানতে চায়?
– আমরা যেভাবে ওদের হাতড়ে বেড়াই অল্প বয়সে ওরাও তো আমাদের জড়িয়ে থাকতো । আমরা তো ছাড়িয়ে নিই নি।
– শুকনো পাতার মতো আমরা মড়মড় করে ভাঙছি। আমাদের জড়িয়ে থাকা লতারা গাছ হয়ে গেছে গো।
– প্রতি জন্মদিনে আমার হাতে পায়েস খেয়ে কি খুশী হতো। এখন সারাদিন অপেক্ষায় থাকি কখন মুখটা একটু দেখবো, দূর থেকে আশির্বাদ করবো।
– তুমি কি দূর্বল হয়ে পড়ছ?
– না গো! আজকাল তো ভুলেই আছি সব কিছু। ওদের ভালোতে আনন্দে গা শিরশির করে না। কষ্ট পেলে কান্নাও আসে না। বাড়ি টাকাপয়সা আগেই নিয়েছিল। রাগ, মান-অভিমান তাও নিয়ে নিয়েছে। আর থেকে কি করবো বল?
– তুমিই তো বারণ করলে। না হলে আদালতে তোমার ছেলেমেয়েদের উলঙ্গ করে দিতাম।
– কাকে উলঙ্গ করবে বল? তোমারই তো সৃষ্টি। সারা জীবন ধরে তিলতিল করে যা গড়লে তার গায়ে লোকজন কালি মাখাবে সেটা দেখতে পাড়তে?
– ওই যে বললে অনুভুতিগুলো মরে গেছে। চৈত্র শেষের শুকনো পাতা আমরা, ঝরে পড়ার অপেক্ষায় আছি।
– অথচ এই লাবণ্যহীন সম্পর্ক্যই নাকি জগতের শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক্য।
– চল! চল! দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওই তো ওরাও বেড়িয়ে গেল। এবার রেডি হয়ে নাও।
– আমি তো রেডিই।
– ভালো কাজের আগে পূজো দিতে না তুমি! আজও আগে পূজো দিতে যাবো।
– হ্যাঁ চল। ওদের মতো করে থাকুক ওরা। তামাটে হয়ে যাওয়া সম্পর্ক্যের বোঝা আর বইতে হবে না।
তারাপীঠের একটি হোটেলে অজ্ঞাত পরিচয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে আত্মহত্যা মনে করলেও অন্য কিছু আছে কিনা তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।