সারপ্রাইজ

সারপ্রাইজ

পলাশের সাথে আজ তুমুল ঝগড়া হয়েছে রাকার। একটা মানুষের এত ঘুম আসে কোথা থেকে? আজ যে দিনটা আর পাঁচটা দিনের মত নয় সেটা কি পলাশ জানে না? আজ রাকার জন্মদিন। SGর ইম্পর্টেন্ট ক্লাসটা না থাকলে রাকা আজ কলেজও যেতনা। যেতে হল নেহাত ঠেকায় পড়ে। পলাশকে বলেছিল কোন্নগর কফি হাউসে মিট করতে। জন্মদিনের দিন কাছের মানুষটাকে দেখতে কার না ইচ্ছে করে? পলাশ সাফ জানিয়ে দিল অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে না। অতএব দেখা হওয়ার কোন গল্প নেই।

আজকের দিনেও এতটা কড়া করে বলতে হল? একটু ভালো করে বলা যেতনা?
রাকার দু চোখে জল চলে আসে।

নাহ্, আজ রাতেই পলাশের সাথে কথা বলতে হবে। ও কি এই সম্পর্কটা নিয়ে আদৌ সিরিয়াস?
অটোটার প্রবল হর্নে সম্বিৎ ফিরল রাকার। একটুর জন্য ধাক্কা লাগলনা অটোটার সাথে।

রাকার কলেজ বাগবাজারে। ক্যালকাটা উইমেন্সের ছাত্রী ও। বাগবাজার থেকে লঞ্চে হাওড়া আসে। তারপর সেখান থেকে মেন লাইনের ট্রেন ধরে।

বাগবাজার জেটিতে আরও পরিচিত কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আজ আর ঘটিগরম খেতে খেতে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছেনা রাকার। সবার থেকে বেশ খানিকটা তফাতেই থাকতে ভালো লাগছে। লঞ্চেও সবার থেকে আড়ালে গিয়েই বসল।

প্রীতি একটু চেঁচিয়ে বলল,” কিরে বার্থডে গার্ল, মুখটা অমন বাংলার পাঁচ কেন?”
_” কিছুনা রে। জাস্ট মুড অফ। তোরা গল্প কর।”
পলাশ ফোন করছে।
কেটে দিল রাকা।
অসহ্য।

আসবে না..আবার ফোন করে এত ব্যাখ্যা দেওয়ার কি আছে।
সত্যি.. পলাশটা আগে কত হুজুগে ছিল। রাত বারোটায় প্রথমে উইশ করত। তারপর পরদিন কেক নিয়ে হাজির হত। হইহই করতে করতে কেটে যেত সারাদিন। এখন আসা তো দূর..রাতে উইশটা অবধি করেনা। কিছু বললে বলবে ঘুমিয়ে গেছিলাম।

আচ্ছা..যত দিন যায় রিলেশন বুঝি এমনই ফিকে হতে থাকে? শুধু টেকার জন্যই থাকা। আসলে আর কোন আবেগ নেই, আনন্দ নেই, এক্সাইটমেন্ট নেই।

_” লাইলা মে লাইলা

কেসি তু লাইলা
হার কোয়ি চায়ে
মিলনা আকেলা
ও লাইলাআআআআ”….
কচি গলার রিনরিনে আওয়াজে রাকার হুঁশ ফিরল।
লঞ্চ আহিরীটোলা পেরিয়েছে।

ভিক্ষা করতে উঠেছে দুটো ছেলেমেয়ে। ছেলেটার বারো তেরো বছর বয়স হবে। একটা ঢোল মত নিয়ে আপন খেয়ালখুশি মত একটা ছন্দ বাজাচ্ছে। আর বছর পাঁচেকের মেয়েটা নানা রকমের কসরৎ করছে, কখনো ডিগবাজি খাচ্ছে, কখনো লাফ মারছে, আর সেই সাথে গান গেয়ে যাচ্ছে।

রাকা এদের রোজই দেখে। দিনে দু’বার। সাথে খুচরো পয়সা থাকলে কখনও বা একটাকা দু’টাকা দেয়, কখনও বা দেয়না। মেয়েটা বাটি নিয়ে সামনে এসে বলল,” দে না দিদি একটা পয়সা?”

আজ কেমন যেন মনটা খারাপ লাগল রাকার। পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে বাটিটায় দিয়ে দিল।
পাশের ভদ্রলোক কেমন যেন একটা টেরাভাবে তাকালেন। সেসব দেখার সময় বাচ্চা মেয়েটার নেই। সে ছুটে গেছে তার দাদার কাছে ব্যাপারটা দেখানোর জন্য।

রাকার হাসি পেয়ে গেল। কখনও কখনও অন্য মানুষের হাসির কারণ হতে পেরে ভালোই লাগে।
হাওড়া এসে গেছে। তাড়াহুড়ো করে লোক নামছে। রাকা আজ সবার পিছনে। অন্যমনস্ক।
লঞ্চ থেকে নেমে জিন্সের পকেট থেকে টিকিটটা বের করে এগিয়ে গেল কাউন্টারের দিকে।
টিকিট দেখিয়ে ট্রেন ধরবে বলে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে হঠাৎ চিল চিৎকার।
_” দিদিইইইইই….এ দিদিইইইইই”…
রাকা পিছন ফিরে দেখে সেই মেয়েটা।
চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে আসছে।
রাকা হনহন করে এগিয়ে গেল খানিকটা।

_” কি রে?”
_” দিদি তুমার টাকা”।
_” নারে এটা আমার না। আমারটা পকেটে।”
_” না গো.. তুমারই। তুমি পকেট থেকে কি একটা বার করলে তখন পড়ে গেল। হামি দেখেছি।”
রাকা পকেট চেক করল। সত্যিই ত। একশো টাকার নোটটা নেই।
তাহলে বোধহয় টিকিটটা বের করার সময় পড়ে গেছে।
এইজন্য মা বারবার বারণ করে এইভাবে টাকা রাখতে।
রাকার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল,” Thank you রে। খুব ভাল থাকিস বোন”।
মেয়েটা একটা মিষ্টি হাসি হেসে চলে গেল।
রাকা খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়াল। ঘটনাটা পুরো ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
একটা বাচ্চা কতটা নির্লোভ হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।
রাকা একবার ভাবল টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দেবে মেয়েটাকে। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়ে আর দেখতে পেলনা।
অগত্যা উল্টোদিকে ফিরে হাঁটা দিয়েছে অমনি আবার ডাক।

_” অ্যাই রাকা.. দাঁড়াও।”

পলাশ!
_” তুমি এখানে?”
_” তো কি করব? তুমি তো ফোন ধরছিলেনা। জানতাম তোমার ছুটি হবে সাড়ে চারটেয়। সেই মত হিসেব করে চলে এলাম। লঞ্চ টা থামতেই এত লোক নামল, ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তোমায়।”
_” তুমি যে বলেছিলে তুমি আসবে না?”

_” উফফ…ইয়ার্কিও বোঝোনা গো? একটা ছোট্ট ঢপ মারতে হয়েছে যদিও অফিসে। ও ঠিক আছে..ম্যানেজ করে নেব। ওমা.. আবার চোখে জল কেন? কিগো? ওগো..”
রাকা হেসে ফেলে।
পলাশ এগিয়ে এসে হাতটা ধরে।

এগিয়ে চলে দিনটা.. রোজের মত। একটু মনখারাপ,একটু ভালোলাগা,একটু অভিমান, আর অনেকখানি সততা নিয়ে চলতে থাকে জীবনচক্র। প্রতিটা মুহূর্ত এনজয় করুন। আপনি জানেনও না জীবন আপনাকে নতুন কি সারপ্রাইজ দিতে চলেছে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত