পঁচিশ পেরোনো মেয়েটা সারাদিন রূপচর্চা করে, মাসখানেক পর দাদার বিয়ে, তার আগে ফর্সা হতে হবে৷ পার্সের জমানো টাকা ফুরোতে থাকে ফাউন্ডেশন, কম্প্যাক্ট পাউডার কেনার দায়ে। দাদার বিয়ে ভালোই শেষ হয়। অনেক ছবি তোলে মেয়েটি, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্টের সঙ্গে সঙ্গে গোটা পঞ্চাশ নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট জমা হয় সোশ্যাল বাড়িতে। সবশেষে অনেক রাতে, সবাই চলে যাওয়ার পর মেয়েটি মুখ ধুয়ে চুলে আলতো খোঁপা করে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়, চোখে পড়ে চোখের নিচের কালি, কপালের ওপরে পাতলা হয়ে যাওয়া চুলের গোছা। চোখের জল বাঁধ মানে না, মনে পড়ে দাদার বন্ধুর সেই স্ত্রীকে, একটুও না সেজে কী সুন্দর লাগছিলো ওকে, ও কেন ওরকম হতে পারে না!
পকেটে পাঁচশো’টা টাকা নিয়ে ভদ্রলোক বেরিয়েছিলেন বাজারে৷ বাজারে ঢোকার মুখেই সুদৃশ্য এক রেষ্টুরেন্ট। বাইরের কাচ ভেদ করে চোখ চলে যায় ভেতরের সুন্দর আলোয় ভরা টেবিল চেয়ারের দিকে। কাউন্টার আলো করে বসে থাকে চকচকে পোষাকের এক যুবক। ছেলে বড় হোক, অবস্থা ফিরুক, তারপর একদিন ঠিক আসবেন সবাই, যত ইচ্ছে খাবেন ওই বাঁদিকের চেয়ারটায় বসে বসে।
বাজারের মুখেই দেখা তার সঙ্গে। কতদিন পর দেখা। কলেজে পড়ার দিনগুলোয় একেই ভেবে কত ভুলভাল কবিতে লিখেছেন একদিন। ভদ্রলোককে দেখে হারানো মানুষটি কিন্তু চিনতে ভুল করলো না। একগাল হেসে এগিয়ে এল দামী পার্স হাতে। একথা সেকথার পর সে জানিয়ে দিল, সে আসলে আসছিলো রেষ্টুরেন্টে খেতে। বোধহয় পুরোনো বন্ধুত্বের দাবিতেই, এই ভদ্রলোকও জীবনে প্রথমবারের জন্য এমন চকচকে রেষ্টুরেন্টে ঢুকলেন। সে যখন অর্ডার করছে, আমাদের চেনা ভদ্রলোকটি আড়চোখে দেখে নিলেন নানান ডিসের দাম। তারপর বললেন, “রোজ রোজ এই রেষ্টুরেন্টে খাওয়া, সহ্য হচ্ছে না আর! ছেলে তো প্রায়ই বায়না করে, আমার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। ওয়েটার! একটা কফি শুধু আমার জন্য।”
সাড়ে চারশো’ টাকা বিলের পর ওয়েটারকে পঞ্চাশ টাকা টিপস দিয়ে বেরোলেন ভদ্রলোক। হারিয়ে যাওয়া পছন্দের মানুষটি মিসেস সমেত নিমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিল হাসিমুখে। চেনা ভদ্রলোকটির চোখে ভেসে উঠলো বউটার কাজ করা হাত, সারাদিন ছেলের জন্য খাটতে খাটতে ফেটে যাওয়া পায়ের গোড়ালি। বউটার জন্য খুব মায়া লাগলো হঠাৎ।
দু’বছর আগের পুজোর জামা। বছর তিরিশের যুবকটি তাই হাতে সোজা করে পরে এসেছে বড়লোক বন্ধুর বিয়েতে। বড্ড ইচ্ছে ছিলো মেয়েটাকে আনার, কিন্তু আজ সকালেই খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা কেটেছে, সরকারি হাসপাতালে ইঞ্জেকশন করে দিয়েছে। সারাদিন কেঁদে কেঁদে এই সন্ধেবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা।
বন্ধু এসে দেখে গেল সবাই ঠিকঠাক খাচ্ছে কিনা। হাসিমুখে বলে গেল, “ভালো করে খা ভাই! বৌদিকে মেয়েকে আনলি না! খুব খারাপ করলি কিন্তু!”
বারবার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কতরকম খাবার, মেয়েটা মিষ্টি খেতে কত ভালোবাসে। কিন্তু এখান থেকে গ্লাসে ভরে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া…অসম্ভব! শেষ পাতে আইসক্রিম। সম্মানের থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায় পিতৃস্নেহ। বন্ধুর দেখাশোনার মাঝেই যুবকটি বলে ওঠে, “ইসসস! আইসক্রিমটা দিয়ে দিল! আমার তো দাঁতে ব্যথা হয় এত ঠান্ডা খেলে! পকেটে থাক বরং, একটু গলে গেলে পরে খাবো।”
ঘন্টাখানেক পর বাড়ি ফেরে যুবকটি৷ মেয়েটা তখনও ঘুমোচ্ছে। মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ও বলে ওঠে, “আমি কেমন মজা এনেছি! কে খাবে! কে খাবে মজাটা!”
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে মেয়েটি। আশায়, আগ্রহে চোখ বড় বড় করে তাকায় বাবার দিকে। বাবা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ম্যাজিক করার মতো হাতের উপর মেলে ধরে গোলাপী রঙের কৌটোয় ভরা আইসক্রিম। তারপরের দেড় ঘন্টা ছোট্ট এক ঘরের বাড়িটা বাবা মা আর মেয়ের খিলখিল হাসিতে আর গল্পে মেতে ওঠে।
মানুষ আসলে শামুকের মতোই প্রাণী। সবাই নিজের নিজের মতো খোলস পরে ঘুরে বেড়ায়। শুধু সব শেষ হয়ে গেলে, সে যখন শুধু খুব কাছের মানুষের কাছে আসে, তখন সে খোলস ছাড়ে, একবার হাঁফ নিয়ে জিরিয়ে নেয়৷ সবার হয়তো এই কাছের মানুষটুকুও জোটে না, সে নিজের কাছেই নিজের খোলসটুকু ঝেড়ে ফেলে তৈরী হয় পরেরদিনের জন্য, অন্য কোনো খোলস পরার জন্য।