ভুলোমনী

ভুলোমনী

“ আমার একটা সমস্যা আছে। সারা বছর শরীরে জ্বর থাকে, সর্দি কাশি আমার কাছে নিশ্বাসের মতন। পারবেন মানিয়ে নিতে? ”

উদয় আকাশের দিকে তাকালো।

“ জানি না আপনি কী ভাবছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার পরিস্কার করে দেই। আমি আপনাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যাইনি। আপনি যেহেতু দেখতে শুনতে বেশ ভালো এমনটা ভাবতেই পারেন। ”

মহল কথাটা শুনে চমকে গেলো। কিছু একটা বলবে তখনি মধ্যবয়সী লোকটা আবার বলে উঠলো।
“ আমি যখন বুঝতে শিখি। তারপর থেকেই দেখতাম বড় বোন বিছানাতেই সারাদিন শুয়ে থাকতো। একের পর এক রোগে চেহারাটাও নষ্ট হয়ে গেছিলো। ডাক্তার কম দেখায়নি বাবা। লাভ হয়নি। মা চিন্তা করতো এ মেয়েকে কে নিবে? অবশেষে এক ভদ্রলোক নিজের একমাত্র ছেলের জন্য বোনকে পছন্দ করলো। বিয়েও হলো। কিন্তু উনারা স্বস্তিতে বোধহয় নতুন বৌয়ের সাথে একটু মশকরা করার সময়ও পায়নি। হাসপাতালেই পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর। উনারা খেদমতের কমতি রাখেনি। টাকা পয়সাও হিসাব করে ভাঙেনি। তবুও সুস্থ হলো না। হাসপাতালেই নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। আপুর মুখটা অনেক দিন হলো দেখি না। মনে পড়লেই কষ্ট পাই। তারচেয়ে বেশি কষ্ট বোধহয় দুলাভাই পায়। বেচারাকে সবাই বলার পরেও আরেকটা বিয়ে করছে না। কোনোদিন নাকি করবেনও না। ”
মহলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু মুখ থেকে ভিন্ন কথা বের হলো।
“ আপনি কী আমাকে করুণা করছেন? ”

“ এটাই হলো আপনাদের সমস্যা জানেন? আমি কী একবারও বলেছি যে আপনাকে বিয়ে করতে চাই। করুণা করার মতো অত সুপুরুষ আমি নই। আমার তো ভালবাসার মানুষও আছে। আমি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি শুধুমাত্র মা বলেছে তাই। আর আমার বড় বোনের কথাটা বলে বুঝালাম যে আপনার কপালে আমার দুলভাইয়ের মতো একটা স্বামী আছে। আপনি নিশ্চয়ই শান্তনা দিলাম ভাবলেন না? ”
মহল থমকে গেলো।

মুহূর্তেই মুখটা কেমন অন্ধকারে পরিণত হয়েছে! এই কথাটা শুনার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। মধ্য বয়সী লোকটাকে প্রথমবার দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিলো। সেবার ছিলো পাত্রী দেখা। চোখ তুলে একবার তাকিয়েছিলো শুধু। এবার বাইরে আলাদাভাবে দেখা করতে এসেছে।

মনভরে লোকটাকে দেখছিলো সে। অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে কথা বলে। শ্যামলা কালো লোকটা কথা বলে সোজাসাপ্টা। মুখে দাড়ি আছে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো নিজের খুব আপনজনের সাথে এই খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। হঠাৎ বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছে!
কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে বললো।

“ আপনার ভালবাসার মানুষ আছে? ”
“ হ্যাঁ আছে। আমি আমার মাকেও বলেছি। কিন্তু উনি এই প্রেমটেম ভালো পান না। উনার ভাষ্যমতে প্রেম করা মেয়েরা সংসারী হয় না। আপনাকে মা পছন্দ করেছে। আপনি ভদ্র শিক্ষিত তার উপর দেখতে বেশ। কিন্তু আমি অতটাও খারাপ লোক না জানেন? যে একটা মেয়ের স্বপ্নে সাজানো সংসারটা অন্য মেয়েকে দিয়ে সাজাবো। ভাবতে পারেন আপনার সারা বছর জ্বর কাশি সর্দি ইত্যাদি থাকে বলে আমি পছন্দ করিনি। কিন্তু না! যাহোক এতো কথা বলার মনে হয় দরকার ছিলো না তাই না? আপনার কথাবার্তা শুনেই বুঝেছিলাম আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি! বেশি কথা বলা আমার অভ্যাস! না বাজে অভ্যাস আসলে। ”
মহল ভদ্রতা দেখানো একটা হাসি দিলো।

“ আমি তাহলে আসি হ্যাঁ? বৃষ্টি আসবে মনে হয়। সন্ধ্যাও হয়ে যাচ্ছে। আর যদি বৃষ্টি আসে তাহলে তো বুঝতেই পারছেন। সর্দি সংশয়ে রূপান্তরিত হবে। ”

“ আমিও তাই ভাবছি। ”

বলেই দুজন উঠলো। লোকটা অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে! অদ্ভুত ব্যাপার হলো মহলের ভালো লাগছে। বেশি কথা বলা মানুষদের একদম সহ্য করতে পারে না মহল। কিন্তু এই লোকটার কথা যেন এক গুণী শিল্পীর তরুণ বাঁশি। সারাদিন বাঁশির সুরটা শুনতেই মন চাচ্ছে!
রিকশা ডেকে দিলো উদয়।

কেনো যেন কান্না পাচ্ছে মহলের। কোনো ছেলের জন্য তাঁর চোখে পানি আসবে তা কোনোদিন ভাবেনি মহল। কিন্তু আজকে আসলো। রিকশার হুডটা তুলে নীরবে কাঁদলো কতক্ষণ! বৃষ্টি নামলো। রিকশা থেকে নেমে গিয়ে হেঁটেই বাড়ির পথ ধরলো মহল।

বৃষ্টির পানির মাঝে চোখের পানি বিলীন হয়ে গেছে। নাহয় হয়তো রাস্তায় দুয়েকজন জিজ্ঞেস করতো, আপা কাঁদছেন কেনো?

গা ভিজে গেছে পুরোটা।
মা দরজা খুলেই বললো।

“ কোথায় গিয়েছিলি তুই? জামাই কখন থেকে এসে বসে আছে। ”
মহল দুঃখের মধ্যে হাসলো। শেষ বয়সে মায়ের মাথাটা গেলো। বিয়েই হয়নি যে মেয়ের তাঁর জামাই আসবে কোথা থেকে?

কিন্তু ঘরের চৌকাঠ পেরোতেই উদয়কে দেখে অবাক হয়ে যায় মহল।

“ আপনি? ”
উদয় কথা না বলে হরহর করে মহলের রুমে ঢুকে বসে থাকলো। মহলও পিছন পিছন ঢুকলো।
“ কী ব্যাপার কথা বলছেন না কেনো? আপনি এখানে কীভাবে আসলেন? ”

উদয় রুমের দরজাটা লাগিয়ে নিলো। এতক্ষণে উদয়ের হাতে একটা তোয়ালে। মহলের মাথার পানি মুছতে মুছতে বললো।

“ সরি মেরি জান। মেরি মেহবুবা, প্লীজ বাড়িতে চলো। তোমাকে ছাড়া যে এক মুহূর্তও ভালো লাগে না। ”
মহল ঠাস করে মাথা থেকে উদয়ের হাতটা সরালো।

“ কী আজেবাজে বকছেন? আমি আপনার বাড়িতে যাবো কেনো? আর ভদ্রতা শেখেননি জীবনে? একটা মেয়ের মাথার পানি হুট করেই মুছে দিচ্ছেন! ”

“ তুমি এই সজলকে ঝারি দিলে? নাহয় আমি একটু বকাঝকা করেছি! তাই বলে তুমি বাপের বাড়ি চলে আসবে? ”
মহল চোখ বড়বড় করে জবাব দিলো।

“ আপনি দেখি নিজের নামটাও ভুলে গেলেন। নিজের নামটা মনে না থাকলে আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনার নাম উদয়। কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথে আমি নদীর পারে দেখা করেছি। আর তারচেয়ে বড় কথা আপনার ভালবাসার মানুষ আছে! ”

উদয় আবার মহলের মাথায় হাত দেয়ার চেষ্টা করলো।

“ দেখো রোকেয়া, তোমার আমার বিয়ে হয়েছে অনেক দিন হলো। এর মধ্যে আমরা দুবার হানিমুনও করে ফেলেছি। তুমি পনেরো দিনের অন্তঃসত্ত্বাও!”

মহল ছিঃ ছিঃ করে উঠলো।
“ ছিঃ, এরকম বাজে কথা একদম বলবেন না। আর আমি রোকেয়া না। আমি মহল। ”
লোকটা হঠাৎ হেসে দিলো।
“ আবার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোমার না? আচ্ছা দাঁড়াও। ”
বলেই শরীরের শার্টটা খুলতে লাগলো। মহল চোখমুখে হাত দিয়ে বললো।
“ কী ব্যাপার আপনি শার্ট খুলছেন কেনো? ”
“ নাহলে বুকের দাগটা দেখাবো কীভাবে? যে দাগটা তুমি কাঁচের গ্লাস দিয়ে দিয়েছিলে! ”
মহল আর কথা বললো না।
দরজাটা খুলে মায়ের কাছে গিয়ে বললো।

“ মা এই লোকটা পাগল হয়ে গেছে। উনার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছিলো না? এখন কী এসব বাজে কথা বলছে দেখো! ”

“ কী বাজে কথা? ”
“ আমি নাকি অন্তঃসত্ত্বা, উনার বুকে কাঁচের গ্লাস দিয়ে দাগ করে দিয়েছি। আবার আমার বদলে রোকেয়া ডাকছে! ”
মহলের মা-ও হাসলো।
“ আর হাসাবি না রোকেয়া। জামাইটা অনেকদিন পর এসেছে। রান্নাবান্না কর। ”
মহল চুপ হয়ে গেলো।

উদয়ের সাথে যেন নিজের মা-ও পাগল হয়ে গেছে। হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে চোখ গেলো মহলের। উদয়ের সাথে তাঁর বিয়ের ছবি! দেখে বুঝা যাচ্ছে বেশ কয়েকদিন আগের!

কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলো না সে। তবে কিছু তো একটা কাহিনী আছে! সোফায় বসে খেয়াল হলো লোকটা তাঁর রুম থেকেই বের হয়নি!

আবার ঢুকে বললো।
“ আচ্ছা আপনার নাম যেন কী? ওহ সজল। তো সজল সাহেব আপনি কী করেন? ”
“ আমি কিছুক্ষণ আগেও মনোবিজ্ঞানী ছিলাম। এখন নিজেই মানসিক রোগী! আপন বৌ আমাকে চিনছে না! ”
মহল বেশ চিন্তিত হয়ে বললো।

“ প্রমাণ করতে পারবেন আমি আপনার বৌ? ”
“ প্রমাণ? খুবই বেদনাদায়ক কথা বললে রুকাই! এইযে দেখো তোমার বালিশের উপড়ে হুমায়ন আহমেদের বাসর বইটা পড়ে আছে। ওটা পড়ে নিজের নামটাই মহল দাবি করো। আর এইযে আমার বুকের মাঝে একটা কাটার দাগ। কলা ছুঁড়তে গিয়ে যে রান্নাঘর থেকে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছিলে তার দাগ। আমরা বান্দরবনে ও কক্সবাজারে হানিমুনে গেছি। তোমার নাভিতে তিল আছে একটা। সবচেয়ে বড় কথা তোমার পেটে আমার বাবু। আর কীভাবে প্রমাণ দিবো? ধুর আর ভালোই লাগছে না। থাকো তুমি, মন চাইলে শ্বশুরবাড়ি যেয়ো। আবার ফোন করে আসতে বলো না। ”

বলেই লোকটা দীর্ঘশ্বাস নিলো! কিন্তু মহল কিছুতেই বিশ্বাস করলো না।
“ মাথা নষ্ট হয়ে গেছে আপনার। কিন্তু আপনি আমার ব্যাপারে এতো জানেন কীভাবে? ”
“ তো তোমার ব্যাপারে আর কোন বলদে জানবে কচু? বাবু হওয়ার আশায় রইলাম। তখন যদি বাচ্চার বাপ মানো। ”
বলেই লোকটা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। না না আবার ফিরে আসলো।

“ আর শুনো। ”
“ কী? ”
“ কিছু না। নিজের খেয়াল রেখো। এখন তো আর তুমি একা না! সর্দি জ্বর হলে বাবুরও সমস্যা হবে। ”
“ বাজে কথা বন্ধ করুন তো। ”
লোকটা আর কথা বাড়ালো না। মহলের মাকে সালাম দিয়ে চলে গেলো।
মাথাটা ঠাণ্ডা করে একটু বসতেই আবার কে যেন ডাকাডাকি করছে। এগিয়ে যেতেই একজন বললো।
“ আপা, ভাড়াটা দেন চইলা যাই। কম রাইত তো আর হইলো না। রিকশা জমা দিতো হইবো। ”
“ ওহ চাচা, ভুলে গেছি। এক মিনিট। ”

খাটের উপর থেকে সাইটব্যাগটা নিয়ে আসলো মহল। টাকা বের করতেই কিছু বাচ্চাকাচ্চার ছবি বেরিয়ে এলো। এরই মাঝে হুঁশও ফিরলো রোকেয়ার! এগুলো সজল রেখেছিলো।

“ আচ্ছা চাচা, একটা লোককে দেখছেন কালো শার্ট পড়া? এইমাত্র বের হয়েছে। ”
“ হ্যাঁ, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গেলো। ”
“ আপনি পেলে আবার বলবেন যে রুকাই ডাকছে, হ্যাঁ? ”
“ আইচ্চা। ”

ফোনে বারবার চেষ্টা করেও পেলো না রুকাই। বেচারার রাগটা মনে হয় বেশিই হয়েছে! কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসলো ঘরে। কাপড়টা পরিবর্তন করতে ওয়াশরুমে ঢুকতেই সজল বললো।
“ কীহ? গোসলটাও করতে দিবে না? ”
রুকাই ভয় পেলো!
“ আপনি ভূত না প্রেতাত্মা? ”
“ ভুলোমনী ”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত