অঝোর বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যে আমার করুণার হাতটা বাড়িয়ে দেব সে সুযোগ আজও পাইনি, কালও যে পাব না তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। মেয়েটার বাবা হয়তো ডাক্তার, সেজন্য সর্দি-কাশিকে সে খুব একটা তোয়াক্কা করে বলে মনে হয় না। সে আধঘণ্টা ধরে ফুটপাতে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়তো ভুলে গেছে, তার হাতে বৃষ্টি প্রতিরোধক একটা ছাতা আছে। তা না হলে কেউ কি এভাবে ছাতা বন্ধ করে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে?
মেয়েটার মাঝে পাগলামির সব কটা উপাদান আছে, আমি সেই দিনই প্রথম টের পেয়েছিলাম, যেদিন বাসের মধ্যে ঐ মেয়েটার পায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার পা লেগেছিল। আমি অবশ্যই অনুতপ্ত হয়ে সরি বলেছিলাম। মেয়েটা রেগেমেগে নরকের কাঠের টুকরার মতো হয়ে গিয়েছিল। যাক, কিচ্ছু বলেনি। পাবলিকের নির্ঘাত গণধোলাই থেকে পুরোপুরি বিপদমুক্ত একজনকে আবিস্কার করছিলাম সেদিন। সে যখন বাস থেকে নামছিল তখন তার একুশ বৎসর বয়সী ছোটমোট হস্তীর ওজন সম্পূর্ণ দেহের সবটুকু ভর আমার পায়ের ওপর দিয়ে বলেছিল__
‘I’m very very sorry ভাইয়া।’
তখন বুঝতে পেরেছিলাম, কত গমে কত আটা। ইচ্ছে করছিল, সব কটা জুতার কোম্পানিতে আগুন লাগিয়ে দেই। কীসব আজেবাজে জুতা তৈরি করে। হস্তীর পায়ের নিচে পড়ে অনেক সময় পিঁপড়া বেঁচে যায় কিন্তু এই সব জুতার নিচে পড়ে তো একটাও বাচঁবে না, সব কটা শহিদ হয়ে যাবে! নিজের কথা আর নাই বা বললাম।
সেদিন থেকে ঐ জেদি মেয়েটার জুতার প্রেমে পড়ে গেলাম । প্রতিদিন রুটিন করে তিন তিন বার আসতাম বাস টার্মিনালে কিন্তু সৌভাগ্যবশত এক দিনও দেখা হতো না। আজ দুর্ভাগ্যবশত তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল । তাকে প্রতিদিন খুঁজতে খুঁজতে আমার প্রেম আর জুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। কখন যে প্রাকৃতিক প্রেম হয়ে তার পুরো অস্তিত্বে হানা দিল, একটুও টের পেলাম না।
হঠাৎ কোথা থেকে এসে আমাকে ঘিরে ছিন্নমূল শিশুরা কীর্তন দিতে শুরু করল। আকুতি ভরা চোখে কিছুটা সুরে সুরে বারবার ওরা বলতে লাগল__
‘একটা লাল গোলাপ দেব স্যার, একটা লাল গোলাপ?’
আমি ওদের কথা শুনেও না শোনার ভান করে পকেট থেকে পাতাবিশিষ্ট একটা কদম ফুল বের করলাম। নাকের কাছে নিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললাম__
‘আহ্ কী বিশ্রী গন্ধ!’
তাতে কী। আমি জানি, প্রাকৃতিক ভালোবাসার জন্য কদম ফুলের কোনো জুড়ি নাই। অনেক কষ্ট করে বৃষ্টিতে ভিজে ঐ মেয়েটার জন্য প্রতিদিন কাদামাখা কদম ফুল কুড়াই। ঐ মেয়েটি কি এই ভালোবাসার মূল্য বুঝবে?
আমার প্রেম প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নিয়েছে তাই কৃত্রিম ফুল কিনতে যাব কোন দুঃখে! যাদের প্রেম কৃত্রিমভাবে জন্ম নিয়েছে তাদের জন্য গোলাপ দরকার। আমার জন্য না।
ঘন্টা খানিক হয়ে গেল মেয়েটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মনের মধ্যে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে শুরু করল। মন আমার পাগল মনকে চুপিচুপি বলল__
‘কোন পাগলিটাগলির প্রেমে পড়েছিস না তো?’
রাস্তার ওপাশ থেকে এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। ভদ্রতার খাতিরে মাঝেমধ্যে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ যেন মেয়েটা আমাকে ইশারায় ডাক দিল। আমি তখন কাপুরুষের গণ্ডি পেরিয়ে সুপুরুষের বেশে মেয়েটার কাছে যেতে লাগলাম। রাস্তা পার হয়ে মেয়েটার কাছে যেতে না যেতেই ট্যাক্সি এসে হাজির। শালার ট্যাক্সি আর আসার সময় পেল না। ইচ্ছে করছে…না থাক।
মেয়েটার কাছে আমি বারবার বোকা হয়ে যাচ্ছি। ভাবতেই নিজেকে গাধা নাম্বার ওয়ান মনে হলো। প্রচণ্ড রাগ মাথার মধ্যে চেপে বসল। চিৎকার করে বাংলা সিনেমার হিরো’র মতো ডায়লগ দিতে লাগলাম__
‘আজ এ প্রেমের শেষ দেখে ছাড়ব দুষ্টু মেয়ে, তোমার ঐ হস্তী মার্কা পায়ের কসম।’
আশপাশে চেয়ে দেখলাম আমার এই পাগলামি ডায়লগ আর কেউ শুনছে কি না। দেখলাম চেয়ে সেই ছিন্নমূল পোলাপান আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেছে। ডাকলাম ওদের__
‘এই, তোমাদের দলনেতা কে?’
খুব উৎসাহ নিয়ে একজন হাত তুলল। আমি তার আনন্দে পানি ঢেলে দিয়ে বললাম__
‘তোমাকে আজ শাস্তি পেতে হবে হাসাহাসি করার জন্য।’
সঙ্গে সঙ্গে ঐ পিচ্ছি দলনেতা বলে ওঠল__
‘আমি দলনেতা নই স্যার। ও আজকে দলনেতা। আমি গতকাল ছিলাম।’
কী চালাক বাচ্চাটা! ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ার আভাস পেয়ে নিজেকে কীভাবে বাচিঁয়ে নিল। ওদের মধ্যে দলনেতা কে খুঁজেই পাওয়া গেল না। ও না সে, সে না ও বলেই ঝগড়া বেড়েই চলল। আমি ওদের ঝগড়া থামিয়ে বললাম__
‘শাস্তি তোমাদের সবাইকে পেতে হবে। সবাই কান ধরে উঠবস করতে হবে এক শ থেকে এক পর্যন্ত।’
তখন ছোট্ট একটা মেয়ে বলল__
‘আমরা কান ধরে উঠবস করতে রাজি আছি, তবে আমাদের সবগুলো ফুল কিনতে হবে স্যার, টাকাটা খুবই দরকার।’
মেয়েটার কথা শুনে খুব মায়া হলো। সবগুলো ফুল কিনে ফেললাম। জিন্দগির একটা দিন কিপ্টামি ভুলে উপভোগ করে কাটাব, ক্ষতি কী?
এক গাদা কৃত্রিম ফুল হাতে নিয়ে প্রাকৃতিক ভালোবাসার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম ঐ মেয়েটির সন্ধানে। সকাল দশটার দিকে ব্যস্ততম রাস্তার জনবহুল ফুটপাতে ঐ মেয়েটির পিছু নিলাম। সুন্দরী মেয়েদের চলন যে এতোটা বাঁকা হয় সেদিন প্রথম বুঝতে পারলাম। খানিকক্ষণ হাঁটার পরে মেয়েটির অতীব নিকটে চলে আসলাম। মেয়েটি বোধহয় কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল আমি যে তার পিছু নিয়েছি। আমি যখন সাহস নিয়ে তার খুব কাছে চলে গেলাম তখন সে নিচু হয়ে পায়ের জুতা খুলতে লাগল। আমি তখন ইজ্জতের ভয়ে কৃত্রিম ফুল আর প্রাকৃতিক ভালোবাসা ডাস্টবিনে ফেলে সিডরের গতিতে এক দৌড়ে একসঙ্গে প্রায় চার মাইল জায়গা অতিক্রম করলাম। উৎসুক জনতা ধর ধর বলে পিছু নিল। দৌড়ে থাকা অবস্থায় নিজের মধ্যে একজন দক্ষ চোর আবিস্কার করলাম। খালি পায়ে তো আর কলেজে যাওয়া যায় না। তাই জুতা কিনতে গেলাম একটা দোকানে। গিয়ে দেখি দোকানদারের সঙ্গে একটা মেয়ের বাগবিতণ্ডা চলছে। তাকিয় দেখি ঐ মেয়েটি। সে খুব রাগ করে দোকানদারকে বলছে__
‘গতকালকে জুতা কিনছি অলরেডি এক পায়ের ফিতা ছিঁড়ে গেছে আর অন্য পায়ের অবস্থা যায় যায়। একটু জায়গা হাঁটা যায় না নিচু হয়ে জুতা ঠিক করতে হয়। আপনি জুতা চেইঞ্জ করে দিন, নইলে টাকা ফেরত দিন।’
মেয়েটির মুখে এমন কথা শুনে আমি পুরাই টাসকি খেলাম। যেন আমি আরেক বার বোকা হয়ে গেলাম মেয়েটার কাছে। তার মানে দাঁড়াল কী__
‘সে হাতের ইশারায় আমাকে ডাকেনি, ডেকে ছিল ট্যাক্সিকে। সে নিচু হয়ে ছিল ফিতা ঠিক করতে, জুতা খোলেনি আমাকে মারার জন্য।’
আমিও নাছোড়বান্দা, এগিয়ে গেলাম মেয়েটির সামনে। যতটুকু পায়ে চাপ প্রয়োগ করলে ‘উহ্’ শব্দটি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ততটুকু চাপ প্রয়োগ করলাম তার পায়ের ওপর। চড় মারার পূর্বেই হাতটা চেপে ধরে বললাম__
‘I’m extremely sorry, পায়ে লাগেনি তো?’
ঠিক তখনই সে আমাকে এযাবৎকালের সেরা নির্ভেজাল হাসি উপহার দিল। কিছুক্ষণের জন্য আমি চিরশান্তিতে পিরামিড হয়ে গেলাম।
আম্মু এই পিরামিডকে নাড়াতে চাইলেন। পিরামিডের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন__
‘ইমু, ওঠ না বাবা। সেই কখন সকাল হয়েছে। কলেজে যাবি না?’