” আগে বললেই পারতিস! তাহলে একটু ভালো জামা কাপড় পরে আসতাম না হয়! এই জামা কাপড় পরে কেউ কোয়েস্টে ঢোকে ?!” নিজের জামার কলারটা ঠিক করে নিতে নিতে বলল অমিত।
” কেন ? এটা কি দোষ করেছে। ভালোই তো লাগছে। কোয়েস্টে আসার জন্য আবার সেজে গুজে আসার কি দরকার!” ঝাঁঝিয়ে বলল কুঁড়ি।
কলেজ থেকে সোজা কোয়েস্ট মলে চলে এসেছে ওরা। প্ল্যানটা কুঁড়ির’ই। মলে টলে যাওয়ার খুব একটা পক্ষপাতি নয় কুঁড়ি , তবে যখন জেদ তো তখন যেতেই হবে। অমিত জানতই না যে আজ ওরা কোয়েস্ট যাবে। সুতরাং রোজকার কলেজের আদা খেঁচড়া জামা আর প্রায় হাজার হাজার বছর না কাচা জিন্স পরে কোয়েস্টে ঢুকতে একটু হোঁচট খাচ্ছে সে। গেটের সিকিউরিটি চেক আপের পর ব্যাগ স্ক্যানের লাইনে দাঁড়িয়ে অমিত বলল, ” সেজে গুজে না হোক, একটু ভদ্রস্থ জামা কাপড় তো পরে আসতে পারতাম রে বাবা। এই জামা কাপড়ে যে আমাকে ঢুকতে দিয়েছে ,এই আমার বাপের ভাগ্যি।”
” আমাকে দেখে কি অভদ্রস্থ মনে হচ্ছে তোর ?” চোখ বাঁকিয়ে অমিতের দিকে তাকাল কুঁড়ি।
অমিত কনভেয়ার বেল্ট থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ” আরে বাবা! তুই আর আমি এক হল!? তুই যাই পর তোকে ভালো লাগে। আমাকে দেখ না, মনে হচ্ছে গড়ের মাঠে হামাগুড়ির রেস জিতে এসেছি।”
হাসল কুঁড়ি। তারপর বলল,” আর ন্যাকমো করতে হবে না তোমায়! চল এবার।”
” আরে যাবি টা কোথায় ?” আমার পকেট তো মরুভূমি।
” আহলে চল যেখানে মরুভূমিতে জল পাওয়া যাবে সেখানেই যাই!”
” কিধার ?”
” স্টারমার্ক!
” বই কিনবি নাকি ?” জিজ্ঞেস করল অমিত।
” উঁ হুঁ! বই ঘাঁটব!” জবাব দিল কুঁড়ি।
বই কেনা কেনা বা বই পড়ার থেকে বই ঘাঁটার নেশাটা বোধ হয় একটু বেশি চরম। নতুন নতুন বই, নানান তার রূপ। এটা সেটা ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে দেখতে কখন সময় ফুড়ুৎ করে পালায় বোঝা দুস্কর।
” আরে বাবা, তাহলে কলেজ স্ট্রিট গেলেই তো হত। এখানে আসার কি ছিল!” এসক্যালেটারে পা রেখে বলল আমিত। কুঁড়ি ঠিক পাশেই অমিতের ডান হাতটাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
” কলেজ স্ট্রিটে গেলে তুমি এটা সেটা গোগ্রাসে গিলতে, তারপর শরীর খারাপ করত, তারপর আমার মাথাটা খারাপ হত! তাই না!” টেনে টেনে বলল কুঁড়ি।
কথাটা মোটেও ভুল নয়। কলকাতা শহরের আর পাঁচটা তথাকথিত বই প্রেমী উঠতি কপোত কপোতির মত কলেজ স্ট্রিট ওদেরও খুব প্রিয় জায়গা। অমিত বলল, ” ওরে শোন, কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বই কিনে যারা কালিকার চপ না খেয়ে আসে না, তারা এক একটা জাতীয় অপরাধী। ওই বই পড়ে ওদের মন ভরবে না কোনদিন।”
” হয়েছে হয়েছে! এবার চুপ কর তুই।” হেসে বলল কুঁড়ি।
স্টারমার্কে ঢোকার আগে ডানদিকে একটা কুকিজ কাউন্টার আছে। নানা স্বাদের, নানান বাহারের কুকিজের সম্ভার সাজানো আছে থাকে থাকে। একটা অপূর্ব গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। নাকে গেলেই খিদে বেড়ে যায়। ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অমিত সন্দেহভাজন কাতর দৃষ্টিতে দোকানের দিকে তাকাতেই কুঁড়ি বলল,” এই! কি করছিস কি বল তো! এরকম নির্লজ্জের মত তাকাচ্ছিস কেন ওদিকে? আমার পকেটেও দুর্ভিক্ষের হাহাকার। খাওয়াতে পারব না কিন্তু আমি।”
অমিত মুখটা কাঁচু মাচু করে বলল ,” হে খোদা, রাহেম কর!”
” ধ্যাৎ! তুইও না! সত্যি!” ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল কুঁড়ি।
স্টারমার্কে ঢুকে ব্যাগ রেখে বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে গেল ওরা। গোটা কোয়েস্টে মলের এটাই বোধ হয় সবচেয়ে মূল্যবান জায়গা। এর আগেও ওরা দুজন এখানে এসেছে। তবু যেন প্রতিবারই আসার টানটা বেড়ে যায়। এত বইয়ের সাজানো সংসারে বুঁদ হয়ে যায় ওরা। অমিত বাংলা বইয়ের সেকশনের সামনে এসে বলল, ” আমার একটা অবজেকশান আছে।”
” বলে ফেল্ ।” আশাপূর্ণা দেবীর বকুল কথাটা হাতে নিয়ে বলল কুঁড়ি।
” ইংরিজি বইয়ের এত সেকশন। কমিক্স, ফ্যান্টাসি, হিস্ট্রি, রোম্যান্স, কই বাংলা বইয়ের তো এরকম কিছু নেই এখানে। বাংলা বই শুধু এই একটা দেওয়ালে ছাড়া কোথাও নেই । দিস ইজ ইনজাস্টিস।”
” এতক্ষনে একটা ভালো কথা বলেছিস । এটা আমারও মনে হয়েছে অনেকবার। বাংলা সাহিত্যে যা বই আছে এখানে তার নূন্যতম পার্সেন্টেজও নেই। শুধু কয়েকটা ক্লাসিক সাজিয়ে রেখেছে। নতুন লেখকের বই আছে, কিন্তু আরও চাই।”
” হ্যাঁ। আর দাম গুলো দেখ না! একদম কমায় না এরা। কলেজ স্ট্রিটে এসব বই হাফ দামে পাওয়া যায়। সাধে সবাই কলেজ স্ট্রিট যায় রে! এখানে ওই ঘুরতে আসা আর বই ঘাঁটাই ঠিক আছে।” সমরেশ মজুমদারের মৌষকাল হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলল অমিত।
” তাই ?” বই থেকে মুখ না তুলেই বলল কুঁড়ি।
” তাই নয় তো কি!”
” যেদিন তোর বই এখানে থাকবে সেদিন দেখব এসব কথা কোথায় থাকে!”
” এই শোন, প্রথমত আমি লেখক নই। সেকেন্ডলি আমার মত খাজা লেখকের লেখা কেউ ছাপবে না, আর ছাপলেও কেউ কিনবে না। এখানে আসার কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমার ওই সস্তা লেখার জন্য কেউ গাঁটের কড়ি খসাবে না।”
” ফালতু বকিস না! যারা বইয়ের মর্ম বোঝে, তারা যে দাম’ই হোক না কেন, ঠিক কিনে নেবে। লেখাটা সেইরকম হওয়া চাই শুধু।”
” তা ঠিক!”
” আচ্ছা এটা নিয়ে কি বলবি? এটার জন্যেও কি কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে ?” একটা বই হাতে নিয়ে বলল কুঁড়ি।
অমিত দেখল কুঁড়ির হাতে শেষের কবিতা। একটা ম্লান বক্ররেখা ফুটে উঠল ওর মুখে। সে কুঁড়ির হাত থেকে বইটা নিয়ে বলল, ” এটার কোন দাম হয় না রে। প্রাইসলেস।”
” সত্যি’ই তাই। দাঁড়ি বুড়ো একখান জিনিস লিখে গেছেন বটে!”
” আচ্ছা কুঁড়ি, একটা কথা বলব ?” অমিতের গলা শান্ত।
কুঁড়ি কি একটা বই খুঁজছে বই র্যাকে। সে অমিতের দিকে না তাকিয়েই বলল, ” হ্যাঁ বল।”
” আমার আর তোর গল্পটা কোনদিন শেষের কবিতা হয়ে যাবে না তো ?” অস্বাভাবিক রকম স্থির অমিত। ঝড়ের ঠিক আগের মুহূর্তের মত নিবিড়।
থমকে অমিতের দিকে তাকাল কুঁড়ি। ওর চোখের দিকে তাকাতেই বুকটা অদ্ভুত রকম কেঁপে উঠল। অমিতের দৃষ্টি কেমন জানি ঘোলাটে। ছাই চাপা। সে বলল, ” কেন? তোর কি কোন কেতকী আছে নাকি ?”
” উত্তরটা তুই জানিস কুঁড়ি!” দৃঢ় গলায় বলল অমিত।
কিছুক্ষন চুপ করে থাকল কুঁড়ি। তারপর অমিতের চোখে চোখ রেখে বলল, ” তুই অমিত রে নস আর আমি লাবণ্য হতে চাই না। দেখিস একদিন আমাদের গল্পটাও এই বই র্যাকে থাকবে। শুধু গল্পের শেষটা শেষের কবিতার মত হবে না। কথা দিলাম।”
বাম হাত দিয়ে কুঁড়ির একটা হাত ধরল অমিত। ডান হাতে শেষের কবিতা ধরা আছে। সে একটু কাছে সরে এসে কুঁড়ির দিকে মুখ নিয়ে যেতেই কুঁড়ি বলল, “অ্যাই! একদম না! সরে দাঁড়া, এটা পাবলিক প্লেস!!”
অগত্যা! ব্যাজার মুখে সরে দাঁড়াল বেচারা অমিত। শেষের কবিতাটা তখনও ওর এক হাতে ধরা। আরেক হাতে ধরা কুঁড়ির হাতটাও।