মুঠোফোনের কেরামতি

মুঠোফোনের কেরামতি

এই কয়দিন আগে আমি মেয়ের কাছে এসেছি। সদ্য কেনা ফ্ল্যাটে তিনটি লিভিং রুম, দুটি বাথরুম, একটা কিচেন, ছোট্ট একটু ডাইনিং আর দুপাশে সরু সরু দু’ফালি বারান্দা। এরই মধ্যে পরী, মানে আমার মেয়ে বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলেছে সারা ফ্ল্যাটটা। জামাই আমার ভীষণ ভালো, পরিশ্রমী, একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো পোস্টে চাকরি করে। আমার মেয়ে পরীও চাকরি করে। আর আছে আমার নাতনি সুন্দরী, অবশ্য ওর পোশাকি নাম আলাদা। আমিই এই ‘সুন্দরী’ নামটা দিয়েছি। এখানে আসার পর পরই আমার নাতনি আমাকে স্মার্ট ফোনের তালিম দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে বড় খটমট লাগে।

পরীদের রান্নার মেয়েটি বড় ভালো, নাম সোনালী। ওর হাতের রান্নাও খুব ভালো। বেশি ঝালমশলা দেয় না। আমাকে ‘মাসীমা, মাসীমা’ করে একেবারে পাগল করে দেয়। নতুন নতুন রান্না শিখতে চায় আমার কাছে। আমার কাছে গোকুল পিঠের রেসিপি শিখে নিয়ে সবাইকে খাইয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে একেবারে।

পরীরা যখন অফিস বেড়িয়ে যায়। তখন আমি আর সোনালী ডাইনিং টেবিলে দু’কাপ চা নিয়ে মুখোমুখি বসি – কত গল্প হয় আমাদের। আমাদের দেশের বাড়ির গল্প থেকে শুরু করে আমার শ্বশুর শাশুড়ি মায়ের কথা – কত কিছু।
আমার নাতনিও ততক্ষণে স্কুলে চলে যায়। সামনের বছর ও মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। আমি তখন সারা বাড়িতে একা, একেবারে একা। সোনালীও চলে যায় কাজকর্ম সেরে। উলের কাঁটা আর গোলা দুটো নিয়ে আমি দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসি। পাকা চুলগুলো রোদে একটু মেলে দিই।

আমাকে মেয়ে, জামাই, নাতনি সবাই বলছে এই ফ্ল্যাটে পাকাপাকি ভাবে চলে আসতে। আমার দু’কামরার ফ্ল্যাটটা বড় ঘিঞ্জি এলাকায়। একা থাকতে ভয়ও লাগে। শরীর টরীর খারাপ হলে খুব মুশকিল। তাই সবাই চাইছে আমি এখানেই চলে আসি। দেখি ভেবে আর একটু।

আজ সুন্দরী আমাকে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছে। আমার একটা সহাস্য বদন ছবিও কোথা থেকে ম্যানেজ করে প্রোফাইল পিকচার বানিয়ে দিয়েছে। আর সেই অ্যাকাউন্টে প্রথম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে আমার মেয়ে পরী।

আমার সারা দিনের কাজ বলতে সকালে স্নান সেরে পূজো করা, জলখাবার খেয়ে খবরের কাগজে সংবাদগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া, তারপর ভাত খেয়ে উলবোনা, গল্পের বই পড়া, ভালো না লাগলে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া, তারপর সুন্দরী বাড়ি ফিরলে ওর মুখে স্কুলের গল্প শোনা। পরী আর জামাই ফিরতে ফিরতে তো সেই রাত ন’টা বেজে যায়। দুজন মিলে বাইক চড়ে অফিস যায়, আবার ফিরে আসেও একসাথে।

আজ আর উল বুনতে ইচ্ছা করছে না। দুপুর বেলা দক্ষিণের বারান্দায় বড় বেশি রোদ লাগছিল বলে পূব দিকের বারান্দায় এসে বসেছি। হাতে করে স্মার্ট ফোনটা নিয়ে এসেছি। সুন্দরী রোজ একটা করে ফাংশন আমায় শেখাচ্ছে। এই তো ফেসবুক খুলতে পেরেছি। গতকাল আমি মাছের মুড়িঘন্ট বানিয়ে ছিলাম আর সেই ছবি আমার অ্যাকাউন্টে আমার নাতনি পোস্ট করেছিল। আজ দেখি অনেকজন সে ছবি লাইক করেছে।

বেশ মজার তো! আমি অন্নপূর্ণাদের বেড়াতে যাওয়ার ছবি দেখতে পাচ্ছি। ওরা পেলিং বেড়াতে গিয়েছিল। আবার আমার জা সুদীপা দেখি বাড়িতে বিরিয়ানি বানিয়ে ছবি পোস্ট করেছে।

ওমা, সুতনু কত বড় হয়ে গেছে! এই তাহলে সুতনুর বউ, মানে আমাদের বউমা। কি সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে। আমাদের সাথে অবশ্য অনেক দিন দেখা সাক্ষাত নেই, তাই বিয়েতেও নেমন্তন্ন করে নি। কিন্তু ওরা সেই আমার শ্বশুর বাড়ির পাশেই থাকত। আমাদের বাড়িতে কতবার আসত ছেলেবেলায়।

আমাদের টবের গাছে সুন্দর বেলফুল ফুটেছে। আমি স্মার্ট ফোনের ক্যামেরাটা অন করার চেষ্টা করলাম। সুন্দরী বলেছিল… হ্যাঁ এই তো… এই গোল জায়গাটাতে আঙুলের সামান্য ছোঁয়া দিলেই… ক্যামেরা অন হয়ে গেছে। এই তো কেমন ঝকঝকে ছবি তুলে ফেলেছি ফুলের থোকাটার। নিজেরই খুব আনন্দ হচ্ছে। আমাদের ছোটবেলায় এসব ছিল না বাবা! সত্যি, ওরা এই বয়সেই কতকিছু জেনে ফেলেছে।

এবার ভিডিও অন করার চেষ্টা করে দেখি একবার, হ্যাঁ হ্যাঁ, এইখানে প্রেস করতে বলেছিল। এবার চালিয়ে দেখি। ওমা, এই তো রাস্তাটা কেমন দেখতে পাচ্ছি। ওই তো একটা রিক্সা যাচ্ছে। তার মানে আমি ছবি তুলতে আর ভিডিও করতে শিখে গেছি। সুন্দরী স্কুল থেকে ফিরলেই ওকে বলতে হবে। পরীও শুনে খুব আনন্দ পাবে।

ভিডিও মোড অন করে আমি ফুলের টবগুলোর ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ মনে হল সামনের ফ্ল্যাট থেকে কেমন যেন কথাকাটাকাটির আওয়াজ আসছে। ওদের বারান্দাটা ঠিক আমাদের উল্টো দিকে। আমি কৌতুহলী হয়ে কান পাতলাম। একজন বৃদ্ধ বোধহয় বলছেন, “আমায় ছেড়ে দাও। আমি সই করতে পারব না। যে ক’দিন আছি, একটু শান্তিতে থাকতে দাও।” যেন কাতর মিনতি করছেন কারো কাছে।
কেউ বলে উঠল, “সই করতে পারবে না মানে? তোমাকে এখানে সই করতেই হবে। করো সই।”
-উঃ আমায় এরকম কোরো না। আর মেরো না। আমায় ছেড়ে দাও।
– না সই করলে আরো মারব। মেরে ফেলব তোমাকে।

একজন বৃদ্ধ মানুষ ছুটে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। একজন মাঝবয়সী লোক বেরিয়ে এল তার সাথে। আমাদের বারান্দায় জামাকাপড় মেলা ছিল। আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। ওরা আমাকে দেখতে পায় নি। মাঝবয়সী লোকটা বৃদ্ধকে চড় মারল, মাথা ঠুকে দিল গ্রিলে – মাথা থেকে রক্ত ঝড়তে লাগল। তখন ধাক্কা দিয়ে বারান্দার

মেঝেতে ফেলে দিল। আমি থরথর করে কাঁপছি, আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
বৃদ্ধের কান্না শুনে নীচে দু’চারজন লোক দাঁড়িয়ে গেছে। তারা কান্না আর ভারী পতনের শব্দের উৎসটাকে খুঁজছে।

মাঝবয়সী লোকটা আর বারান্দায় নেই। বেগতিক দেখে সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ এখনও পড়ে আছেন। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কিংবা মরে গিয়ে থাকতেও পারে।

এবারে আমি বারান্দার গ্রিল ধরে পরিত্রাহী চিৎকার করতে শুরু করলাম, “কে কোথায় আছো গো। ওনাকে বাঁচাও। ওই যে বারান্দায় পড়ে আছেন।”

নীচের লোকগুলো ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওরা উপরে এসে বৃদ্ধকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। তার আগে নাকের কাছে হাত রেখে বলছিল, “এখনও মরে নি। বেঁচে আছে। অনেকটা রক্ত বেরিয়েছে। এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ভিডিওটা কোনরকমে ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছি। সবাই জানুক এই অমানবিক কান্ডটা।

-ওহঃ দিদুন । তুমি কামাল করে দিয়েছ। তোমার ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। তোমার ভিডিও দেখে তাবড় তাবড় পুলিশ অফিসাররা নড়েচড়ে বসেছেন। সম্পত্তির লোভে ছেলে বাবাকে ধরে মারছে! এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে সবাই। আজ নিউজ চ্যানেলেও এই নিয়ে আলোচনা হবে।
পরী আর আমার জামাই কোথ্থেকে খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

-মা, তুমি যে কি করেছ তুমি নিজেই জানো না মা। তুমি সমাজের অনেক বড় উপকার করেছ। তোমার ভিডিও দেখে অন্যায়কারীকে ধরা হয়েছে। ওর কঠিন সাজা হবে।

-সত্যি মা, আপনি একটা বিরাট কাজ করেছেন।
আমার জামাই বলল।
– আমি আর কি করেছি। সব আমার এই মুঠোফোনটার কেরামতি । আর আমার সুন্দরী দিদিভাই-এর সাকসেসফুল ট্রেনিং।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত