২১৯ বাসটা পেতে আজ একটু দেরী হলো অন্যদিনের থেকে।হাত ঘড়িতে দেখলাম কাটাটা প্রায় ১০ ছুঁই ছুঁই।শীতটা বড্ড জাঁকিয়ে পড়েছে এ বছর।ফোনটা বের করে দেখলাম অফ হয়ে গেছে কখন!! ইস.. বাবা মনে হয়…!যাই হোক, টিকিট কাটলাম পাইকপাড়ার, ওখানেই যে ঠাঁই হয়েছে এই পাঁচ বছর হলো। পেশায় একটু পরে বলছি, নাম জয়দীপ কান্তি রায়, সংক্ষেপে জোকার!!গল্প শুরু করি তাহলে…
ক্লাস ফোর থেকেই পড়াশুনা ছাড়া বাকী সব কিছুই ভালো লাগত।স্পোর্টস, স্কুলের নাটক সবেতেই আমি “এক” নম্বর।একবার স্কুলের এক নাটকে “গাছ”হয়েছিলাম।যখন শহর থেকে লোকগুলো এসে আমায় কুড়ুল দিয়ে কাটছে, আমার কষ্ট দেখে সারা স্কুল কেঁদে ফেলেছিল।আমি না বড্ড খুশি হয়েছিলাম মনে মনে, কেমন একটা অভিনেতা অভিনেতা ফিল হত।সেই ছোট্ট থেকেই সময় অসময়ে ছুট্টে যেতাম পাড়ার থিয়েটারে।বাবার দেওয়া পকেট মানিগুলো জমিয়ে টিকিট কেটে দেখতাম মূকাভিনয় ওঁদের।কী অদ্ভুত যে কী করে বলি!! কথা না বলে সব কিছু ফুটিয়ে তুলত কত অবলীলায়।কখনো হাসতাম, বা কখনো একা একাই কাঁদতাম।মনে হত যদি আমার এমন শক্তি থাকত!কারখানাটা লক আউট যখন হল, তখন আমি ক্লাস নাইন।বই খাতা গুলো যত্ন করে তুলে রাখলাম শেলফে।বাবা লজ্জায় মুখ দেখে আর কথা বলত না, মুখ দেখে বুঝতাম অন্তর থেকে পুড়ছে লোকটা।ওই কটা দিন স্কুলের সবার মধ্যমণি ছিলাম আমি।যতক্ষন না স্কুলে যেতাম, সবাই অপেক্ষা করত আমার জন্য।
আমি গেলেই শুরু হত ওদের হাসি, ঠাট্টা।কেউ বসে মজা করে মাথার চুল ঘেঁটে দিত, কেউ বা ব্যাগ ঘেঁটে টিফিন বক্স বার করে ক্লাসের ওপরের শেলফে উঠিয়ে রাখত, আর বলত”যা নিয়ে আয় দেখি”।চুপ করে দেখতাম শুধু, যতক্ষন না চোখ দিয়ে জল পড়ত, ততক্ষণ হাসত ওরা।শেষমেশ বলত,
-নে লিলিপুট কাঁদিস না আর!
হু লিলিপুট ই বটে, আরও অনেক নাম আছে আমার।’নাটা’, ‘বামন’ কত কী!!সেই ছোট থেকেই শুনতে হয়।শুধু মা বাবার চোখে কোনোদিন লজ্জা ছিল না আমার জন্য।দিনের শেষে যখন মার পেটটা জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলতাম সারা দিনের আমার অত্যাচারের কথা, শুধু মাথা ভালো করে চুলটা সাজিয়ে বলত,
-এই তো বাবু আমি তো আছি পাশে।
মায়ের দেহটা পুকুর থেকে যখন ওঠাচ্ছিল ওরা, একটুও কাঁদিনি।বাবা শুধু পুকুরের সিঁড়িতে বসে চেয়েছিল মার দিকে।কারখানাটা লক আউট হওয়ার পর,কাকু সামলেছিল বাবাকে।আমার দুর্বল দুটো হাত তখন ও অক্ষম ছিল।বাড়ির আয়নাতে লাগানো পোস্টার দেখে বলতাম,
-তোমার মত একদিন হব দেখো, সারা পৃথিবী দেখবে আমায়!
পোস্টারটা এক ভদ্রলোকের।নাকের নীচে ছোট্ট গোঁফ, মাথায় কালো টুপি আর হাতে লাঠি নিয়ে সারা বিশ্বকে হাসাতেন, বলা বাহুল্য আমিও বড় ভক্ত ওঁনার।চেষ্টা করতাম ওনার মত কিছু না বলেই বডি মুভমেন্ট করার ।সবার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে করতাম, নিজেই পড়তাম, নিজেই হাসতাম। সেদিন খবরটা দিল সুদীপ।পাড়ার মোড়ে চা খাচ্ছিলাম।গ্লাসটা ফেলে ছুট্টে এসে ঘরে দেখি বাবাকে ধরে কাকু আর কিছু লোক ওঠাচ্ছে।স্ট্রোকটায় একটা সাইড বাবার প্যারালাইসিস হয়ে যায়।অনেক কষ্ট করে কাকু নিয়ে আসে কলকাতায়।ওই যে আগেই বললাম না, পাইকপাড়ার ওখানেই বাড়ি খুঁজে দেয় ছোট্ট দেখে।কাজ বুঝলেন কেউ দিতে চাইত না।শরীর দেখে বুঝত হয়ত।শেষমেশ কাজ পেলাম একটা মুদি দোকানে , মাইনে ৩০০০। ওষুধপত্রের খরচা খুব বাড়ছিল।কাকুর একার হাতে পেরে উঠছিল না।আমি না কোনো কোনোদিন আধপেটাই শুয়ে থাকতাম, কাকু জিজ্ঞেস করলেই বলতাম,
-খাইয়েছে আজ মালিক।
ভালো লাগত না কিছু জানেন! দেখলাম একদিন ফেরত পথে পোস্টারটা।বড় বড় হরফে লেখা পাইকপাড়ার মোড়ে ” রাশিয়ান সার্কাস”ঠিকানা টালা পার্ক! এই তো কাছেই।বিকেলে সেদিন গেলাম সেখানে।ইয়া বড় একটা তাঁবু, ভেতরে গিয়ে আধশোয়া একটা লোক দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
-ও দাদা, মালিক কোথায়?
পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বলে,
-কী দরকার?
বুঝলাম ঘুম ভাঙ্গালাম, বললাম,
-কাজের ব্যাপার।
“কী হয়েছে রে?” একটা গলা শুনলাম।একটা লোক ভেতরে ঢুকল কান খোঁচাতে খোঁচাতে।পাঞ্জাবী পরা , বয়স এই
৫০ ! দেখে বলল,
-কে করবে কাজ?
বললাম,
-আমি
হেসে ফেলল উনি।বলল,
-কেন ইয়ার্কি মারছেন?
সব বললাম ওনাকে।বলল,
-কাল থেকে চলে এস বিকেলেই , প্র্যাকটিস কিন্তু রাত অব্দিও হবে কোনো কোনোদিন।
বাবাকে বললাম সেদিন রাতে,
-কাল থেকে বুঝলে একটু ফিরতে দেরী হবে, দুটো টিউশনি ধরেছি।
কী বুঝলো জানি না, বাঁ চোখ দিয়ে জলের ধারা দেখলাম।খুব অস্পষ্ট কথা কিছু, মুখটা এখনও সামান্য বাঁকা ই আছে।শুনলাম না আর, ইচ্ছে করল না।
পরের দিন ঠিক ৬টা সময় পৌঁছে গেলাম তাঁবুর সামনে।ভেতরে ঢুকে দেখি, উড়ে বাপরে!! ইয়া বড় বড় হাতি, কোনো কোনো জায়গায় বাঘ রাখা। কত মেয়ে ছেলে প্র্যাকটিস করছে।কেউ জাগলিং করছে।কেউ বা বড় একটা গোল রিং এ আগুন লাগিয়ে তার ভেতর দিয়ে জাম্প মারছে।দেখছিলাম এসব, পেছনে হাত পড়ল কার,
-এই যে, কী যেন নাম তোমার বলেছিলে?
কালকের লোকটা, বললাম,
-জয়দীপ
-হু জয়, দাঁড়িয়ে না থেকে এর সাথে চলে যাও।
তাকিয়ে দেখলাম আমারই মত একজন দাঁড়িয়ে পাশে।বলল,
-চলো ভাই
যেতে যেতে তাকে নাম জিজ্ঞেস করলাম, বলল,
-রূপেন।বাড়ি কোয়েম্বাতে।
নিজেই বলল আবার,
-শোনো সবার প্রথম মনে রেখো যত যন্ত্রনা হোক, শুধু মুখে হাসি নিয়ে পারফর্ম করে যাবে।তুমি যত বার পড়ে আবার উঠবে, দেখবে দর্শক আনন্দে হাততালি দিয়ে ভালোবাসা উজাড় করে দিচ্ছে।
হেসে ফেললাম এবার।বললাম,
-সে ছায়াপথ অনেকদিন আগেই মাড়িয়ে এসেছি।নাহলে এখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।
সব বললাম ওকে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল কিছু,
“এ জায়গা ও জায়গা এই যে সং সেজে ঘুরে বেড়াই কেন জানো?শুধু ছেলের মুখে বাবা শুনতে।ছেলেটা আমার কথা বলতে পারে না।শুধু হাসে, খিদে পেলে কাঁদে।প্রচুর টাকা লাগবে, অপেরাশন করতে গেলে। জানি না কতটা পারব।ওকে নিয়েই ঘুরে বেড়াই সব জায়গায়।আমি যখন লাফাই, ঝাপাই বা কোনো স্টেজে বা এই সার্কাস যখন বসে, একবারে কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে কলা কৌশল দেখাতে শুরু করি, সবার সাথে মনে হয় ও খুব হাসে।খুব খুব হাসে।দেখতে পাই না তখন।কী করে দেখব? তখন তো একবার করে পড়ে আবার উঠে ডিগবাজি খেতে ব্যস্ত আমি! ব্যাস ওই টুকুই পাওয়া আমার।
এ টুকু বলে চোখের দিকে তাকালো আমার।নিজেকে কথা দিয়েছিলাম, না কষ্ট গুলোকে বাইরে আনব না। কতদিন যে বাবা বলেনি আমায়,
-বাবু, মুখে কিছু ভালো লাগে না এই খাবার।কিছু ভালোমন্দ খাওয়াবি আজ?
বুক ফাটল আজও, কিন্তু মুখে বললাম,
-থ্যাংক ইউ, এই কথা গুলো খুব দরকার ছিল।
খুব মনোযোগ দিয়ে শুরু করলাম প্র্যাকটিস।কী করে হাঁটতে হয়, কী করে খেলার সরঞ্জাম গুলো দিয়ে খেলতে হয়, কী করে নিজেকে কষ্ট দিয়ে বারবার করে হাসাতে হয়। রোজ ফেরার পথে শিখে যেতাম কিছু।বাড়ি গিয়ে উঁকি মেরে দেখতাম বাবা শুয়েছে কিনা, তারপর আয়নার সামনে ওঁকে দেখিয়ে প্র্যাকটিস করতাম।ঠিক , ভুল জানি না, তবে নিজেকে মনে হত ওইটুকু সময় কলকাতার সবচেয়ে বড় “মাইম” শিল্পী!সেদিন ছিল ডিসেম্বরের ২০।সকালে উঠে রোজনামচা যেমন আমার, বাবার ঘরে যাই।আজ গিয়ে দেখি ওঠেনি এখন।গায়ে হাত দিয়ে দেখি খুব জ্বর।চোখ মেলতে পারছে না।দৌড়ে কাকুকে ডাকলাম।ওষুধ একটা খাইয়ে , বললাম বাবাকে,
-খুব কষ্ট হচ্ছে না বাবা?
সেই অবাধ্য কষ্টটা আজো চোখের পাশ দিয়ে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।বললাম,
-আজ যাব না বাবা।
চোখ ঝাপটে যেতে বলল মনে হয়।কাকুকে বললাম,
-তুমি থাকবে তো?
নিমরাজি বুঝলাম।বললাম,
-তাড়াতাড়ি আসব।
পারিনি কথা রাখতে।প্র্যাকটিস থেকে ফিরে দেখি ঘর ফাঁকা।ফোন করলাম কাকু কে,
– মোড়ের কাছের হাসপাতালে আছি, চলে আয়।
এসে শুনলাম জ্বর খুব বেড়েছিল তাই ভর্তি।হাতে মার শেষ চিহ্ন ছিল একটা, বিক্রি করলাম ওটা।যা টাকা পেলাম, কাকুকে দিয়ে বললাম,
-দেখো যা পারো রাখো হাতে।
দু দিন পর ফিরলাম বাড়ি একেবারে শ্মশান হয়ে।আমি বড্ড খুশি জানেন।খুব কষ্ট পাচ্ছিল বাবা, আর পাবে না এই ভেবে।শুধু ওই যে বদভ্যাস টা, সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে যাওয়া, ওটা আর হবে না।যাকগে, বাবা বলত,
-জয়, একদিন কিন্তু অনেক নাম করতে হবে তোকে।এই শহরে সবাই যেন তোকে চেনে।
রেডি হয়ে বেরোলাম ।তাঁবুর কাছে এসে দেখি রূপেন দাঁড়িয়ে।মুখটা শুকিয়ে এসে বলল,
-শুনেছি সব।
বললাম,
-শো কবে?
-রবিবার
“আচ্ছা”বলে ঢুকলাম ভেতরে।চার দিন হাতে।শুরু করলাম প্র্যাকটিস।গোল চাকতি মাথা দিয়ে ঢুকিয়ে কোমরের কাছে এনে সেটাকে বার পঞ্চাশ ঘোরাতে হবে।অনেক চেষ্টা করলাম , অবশেষে হলো। বার কয়েক ঝালিয়ে নিলাম, এতদিনকার প্যাশন আমার!!
রবিবার দিন একটু আগে পৌঁছলাম।মেকআপ করতে হবে তো! চোখে মুখে রং ঢেলে, নাকের সামনে বল লাগিয়ে রেডি।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
-পারতে হবে জয় ।
আসর জমে গেছে।সার্কাসের মালিক দু বার এসে বলে গেলেন এন্ট্রির কথা।ঢুকলাম আমি।আচমকা করতালি সব থেমে গেল।পেছন ফিরে দেখি সেই রূপেন ইশারায় বলছে ,কিছু একটা ভুল করেছি আমি।ওর দিকে তাকাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম।নাকে আর মাথায় একটু লাগল।করতালিতে এবার ফেটে পড়ছে সার্কাস।আমার না ওই শুয়ে শুয়ে মনে হলো মাকে দেখলাম।যেমন যন্ত্রনা পেলে চিল্লিয়ে উঠতাম,”মা”।মা দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরত।এরা কেউ আদর করলো না, না ব্যথার জায়গায় হাত বুলিয়ে দিল।হাসি দেখে বুঝলাম আমার যন্ত্রনা দেখে ওরা হেসে ফেলেছে হয়ত।উঠে দাঁড়িয়ে শুরু করলাম খেলা।চুপি চুপি বলি কিছুটা নকল করা ওঁনার।ওই যে যার কথা বলেছিলাম, নাকের নীচে ছোট্ট গোঁফ, হাতে লাঠি।বার বার ডিগবাজি খাচ্ছি, হাততালি তে কানের পর্দা ফাটার জোগাড়।আস্তে আস্তে একে একে সবাই এসে স্টেজ মাতিয়ে দিল।মনে হল, “ওই যে বাবা বসে, হাসছে, খুব হাসছে ।না, মুখটা বেঁকা নেই আর।ইশারায় মনে হয় ডাকল আমায়।থাক পরে যাব”।
মনে মনে বললাম”বাবা, তোমার জয় কিন্তু তোমার কথা রেখেছে।জয় হয়ে না জোকার হয়ে দেখো, আজ সবাই ওকে চেনে”।
ধুর খেলায় আবার মন দিই।অভিনয় টা ভালো না করতে পারলে, ভেতরের “জয়”নামের কঙ্কালটা যদি দেখে নেয় এরা??