লাল টুকটুকে বৌ

লাল টুকটুকে বৌ

গতকাল স্কুল যাওয়ার পথের ঘটনা৷ এমনিতেই বাসে উঠে আমার টার্গেট থাকে একদম শেষের সারির সিট, একটু উঁচু এই সিটে বসে বাসের ভেতরের সব লোককে দিব্যি দেখা যায়৷ কত যে গল্প ঘুরে বেড়ায়, ধরতে পারলেই হল৷ আমি বরাবর সেই ধান্দায় থাকি, আজও ছিলাম৷ কিন্তু মাঝপথে একটা স্টপেজে হঠাৎ করে নিজেই গল্প হয়ে গেলাম৷
থেমে যাওয়া বাসের গেট ধরে তখন এক ঠাকুমা৷ অতিরিক্ত ওজনের ভারে ঠাকুমা গেট ধরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যার্থ হচ্ছেন৷ পিছনে আরেক ঠাকুমা, তুলনামুলক কম ভারী৷ তিনি পিছন থেকে ঠেলাঠেলি করেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারছেন না৷ ওদিকে পিছনের গেটের হেল্পার বাসের ছাদে উঠে মাল নামাচ্ছেন৷ অতঃপর আমিই হাত বাড়ালাম৷

প্রথমে ভারী ঠাকুমাকে টেনে ওপরে তুললাম, সেই দেখে পিছনের দ্বিতীয় ঠাকুমা এক পা বাসের পাদানিতে রেখে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,

—লে, আমাকেউ তুল৷ ওখে যখন তুললি আমাকেও তুল৷
উপায় নেই, দ্বিতীয় ঠাকুমাকেও টেনে তুললাম৷ পিছনে আমার সিটের দুইপাশে ফাঁকা জায়গায় দুজনে বসলেন, আমি বসলাম মাঝে৷ এপর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু হঠাৎ প্রথম ঠাকুমা অতিশয় স্নেহপরবশ হয়ে আমার মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে হালকা ঘেঁটে দিয়ে আশীর্বাদ করে ফেললেন,

—ভাল থাক বাবা ভাল থাক৷ একটা লালটুকটুকে বৌ হোক৷
এই বলে মুচকি হাসলেন৷ আমি পিওর কনফিউশনে পড়লাম, ব্যাপারটা আশীর্বাদ না অভিশাপ! ঠিক সেই মুহুর্তে অপরদিক থেকে দ্বিতীয় ঠাকুমা আমার থুতনি ধরে হালকা নেড়ে দিয়ে বললেন,
—আরও একটা হোক!
আমি আঁতকে উঠলাম,

—মানে?
—ক্যানে! ওকে তুললি, উ আশীব্বাদ করল, আমাকেও তুললি তাই আমার তরফ থেকেও একটা বৌ হোক৷
মুহুর্তের মধ্যে সিট ছেড়ে ছিটকে উঠলাম, বাসের ড্রাইভার কি কারণে এমার্জেন্সী ব্রেক কষল জানিনা!
যাইহোক, কথায় কথা বাড়ে! দুইপাশে দুই ঠাকুমা, কথা বেড়েই চলল৷ বেশ কিছুক্ষন কথাবার্তা বলার পর যেটুকু বুঝলাম, প্রথম ঠাকুমা একটু রক্ষনশীল হলেও দ্বিতীয় ঠাকুমা রীতিমত আধুনিকা৷ ৩৭৭ থেকে গণপ্রধানমন্ত্রী সমাবেশ, সব খবর নখদর্পণে৷ এবং অবশ্যই কথার ধার আছে, সাথে একটু দুষ্টুমি ভাব, বেশিরভাগ কথা তার সাথেই হতে লাগলো৷ বয়স্কা মানুষ, আলাপ পরিচয়ে আত্মীয়তা খোঁজার নেশায় মশগুল৷ আমার বাড়ি কোথায় জানার পর ঠিক খুঁজে পেলেন আমার পাড়ায় তার দুরসম্পর্কের কে ছিল, কি নাম তার, কিভাবে মারা গেল! তার বাড়ির খবর, শ্বশুরবাড়ির খবর, স্বামীর মৃৃত্যূর দুঃখ! সব, সবকিছু মন উজাড় করে বলে গেলেন, আমি বাধ্য শ্রোতা৷ একটা পর্যায়ে এসে হঠাৎ একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন,

—বাবা, কি কর তাহলে? চাগরিবাগরি কিছু করছ নাকি এখনও পড়াশুনা?
কেন জানিনা আজ পরিবেশ অনুকূলে থাকলেও ইয়ার্কি ফাজলামি করতে ইচ্ছে করলনা৷ স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলাম,

—না ঠাকুমা! পড়াশুনা শেষ৷ চাকরীই করছি৷
আবার থুতনি ধরে আদর করে বললেন
—বাহ্ ! ভাল ভাল, খুব ভাল! তা কি চাগরী কর?
— একটা স্কুলে পড়াই৷
—সিভিক মাষ্টার নাকি! হা হা হা….

ঠাকুমা এবার ঠুকলেন আমায়! যদিও নিছকই মজার ছলে! তবে তিনি যে এই খবরও রেখেছেন সেটা দেখে বেশ ভাল লাগলো, আবার আশ্চর্যও হলাম৷ কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম,
—না ঠাকুমা! আমি হাইস্কুলে আছি৷ কিন্তু, আপনি এই সিভিক মাষ্টার ব্যাপারটা কিভাবে জানলেন?
—কি মনে করেছ বাছা! বয়স হইছে বলে কি খবর রাখিনি? আমার লাতিন(নাতনী) আছে, সেই ত সব বলে৷ ঐ সব ফেসবুক হোটাসএপ করে ত! সব খবর রাখি!

‘হোটাসএপ’ শুনে বেশ খানিক্ষন হাসলাম! সকলেই হাসলাম৷ সামনের স্টপেজেই আমার স্কুল, নামার জন্য রেডি হচ্ছি এমন সময় ঠাকুমা আবার বললেন,
—তা হ্যাগো! বলি বিয়া সংসার হইচে না হয়নি? না হলে বল বাপু, মেয়ে আছে হাতে৷
বেশ পুলকিত হলাম, ভেতরের গ্যাঁড়া সত্ত্বাটা চাগাড় দিয়ে উঠলো! বললাম,

—না, বিয়ে হয়নি! আপনার হাতে মেয়ে আছে নাকি?
—হ্যাঁ, আছে তো! আমার লাতিন, পড়াশুনায় খুব ভাল! এবছর কলেজ পাশ কল্ল!
হাসি চেপে রেখে ঠাকুমার পিছনে লাগা কন্টিনিউ করলাম,
—গায়ের রঙ কেমন?
—এগবারে ধবধবা ফরসা লয়! তবে দেখতে ভাল! উজ্বল শ্যামবর্ণ৷
—না ঠাকুমা! করবনা৷
—কেন?
—ঐ ঠাকুমা বলেছে, লাল টুকটুকে বৌ হবে৷ লাল টুকটুকে মেয়ে না হলে আমি বিয়েই করবনা!

তিনজনেই হো হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম৷ পাশাপাশি যারা এতক্ষন আমাদের কথাবার্তা শুনছিল তারাও আমাদের হাসিতে যোগ দিল৷ একটা সুন্দর সকাল কাটিয়ে স্কুলে ঢুকলাম…

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত