দিন দিন কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে শ্রীয়া । নইলে কেউ একটা আইসক্রীম এর জন্য ঝগড়া করে এই বত্রিশ বছর বয়সে ? ভেবে নিজেরই লজ্জা করছে শ্রীয়ার । নিজেই হেসে ফেলল , কিন্তু মুহূর্তেই একটা কালো মেঘ ঘিরে ফেলল হাসিটাকে । সত্যি , আজ যদি মা , বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো এতটা খিটখিটে হতো না শ্রীয়া । এই তিনতলা বাড়িতে একা , ঘরগুলো যেন খেতে আসে ওকে । পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না শ্রীয়ার । ওদের থেকে দূরে থাকাই ভালো । এইতো সেদিনই রাস্তায় যেতে যেতে শুনল -” বাবা মা এত খরচা করে বিয়ে দিল সংসার করতে পারলো না । উরু উরু মন থাকলে কি আর সংসার করা যায় ?”
উরু উরু মন । সত্যি , নিজের কুড়ি বছর পরিশ্রমের পর পাওয়া চার ঘন্টার প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করতে চাওয়াটা উরু উরু মন । মার খাওয়ার পর শুধু মার কথা শুনে সংসারে পরে থাকাটা উরু উরু মন। কিন্তু মা, বাবাই যখন নেই তখন আর পরে থাকেনি ও । সব ছেড়ে চলে এসেছে । তারপর যদিও পাড়ার অনেকেই দ্বিতীয়বার ঘটকালি করতে চেয়েছিল , শ্রীয়া রাজি হয়নি ।
এসব ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলটা বেজে উঠল । মাসি এসে গেছে রান্না করতে ।
শ্রীয়াকে দেখেই মাসি বলে উঠল – দিদিমণি তুমি স্কুলে যাওনি , শরীর খারাপ ? ডাক্তার ডাকি ?
– না না ।
মানদা মাসিকে খুব ভালোবাসে শ্রীয়া । তাই রাতে মাসি রান্না করতে এলে মাসির সাথে অনেক গল্প করে শ্রীয়া ।
– মাসি তোমার মেয়ে কোথায় গো ? একটা N.G.O তে যাব ।ওখানে ছোট গরিব বাচ্চাদের পড়ানো হয় । ওকে নিয়ে যাব ভাবছি ।
– ও পড়বে দিদিমণি ? ও বাড়িতে ।
– আচ্ছা ।
ব্যাস । সুহানি কে মানে মানদা মাসির মেয়েকে নিয়ে পৌছে গেল শ্রীয়া ‘প্রথম কুঁড়ি’ N.G.O তে ।কত ছোট ছোট বাচ্ছা সেখানে গান গাইছে , নাচ করছে । সত্যি চারপাশের দুনিয়া নিয়ে এদের কোনো ভাবনা নেই । কত না থাকা তাও যেন সব আছে । এটাই হয়তো ছোটবেলা । যখন কেউ হিসাব শেখেনি , তাই পাওয়া , না পাওয়ার হিসাব কেউ করে না। এরই মধ্যে সুহানি গিয়ে নাচতে শুরু করে দিয়েছে ওদের সাথে ।
সুহানিকে রেখে শ্রীয়া একটু ভেতরের দিকে গেল । একই সেই মুখ । এনার সাথেই তো কাল ঝগড়া হয়েছিল । শ্রীয়া কিছু বলবে তার আগেই
– একি আপনি এখানেও চলে এলেন একটা আইসক্রীম এর জন্য ?
– মানে টা কি ? আপনি কি ভাবেন আমাকে ? শ্রীয়ার সব অনুতাপ উধাও । গলায় সেই আগের মতো ঝাঁঝ ।
– সেটাই ভাবছি । আপনি কি বলুন তো ?
না , শ্রীয়া আর কথা বাড়ায়নি । লোকটাকে দেখলে যেন অটোমেটিক মাথায় রাগ চড়ে যায় । সেদিন সুহানির নামটা N.G.O তে লিখিয়ে চলে আসে শ্রীয়া । এরপর থেকে রোজই নিজের স্কুলের পরে N.G.O তে যায় শ্রীয়া , সুহানি একাই যেতে পারে তাও । প্রায় রোজ লোকটার সাথে দেখাও হয় , ঝগড়াও হয় । এক এক সময় তো বাচ্ছারা এসে ওদের ঝগড়া থামায় ।
মানদা মাসি সেদিন বেরোনোর সময় বলেই ফেলল – কেন তুমি যাও ওখানে দিদিমণি ? সুহানি তো একাই ..
কেন ? আমি কি ভয় পাই নাকি ? যে ওনার জন্য N.G.O তে যাওয়া ছেড়ে দেব ?
– তা আপনি নাই পেতে পারেন ।
হঠাৎ সেই লোকটার গলা পেয়ে শ্রীয়া চমকে উঠল ।
– আপনি এখানে ?
– আজ বাচ্চাদের নিয়ে পিকনিকে যাওয়ার দিন । কেন সুহানি বলেনি ? যাই হোক রেজিস্টারে এই ঠিকানা দেওয়া ছিল। তাই নিতে এলাম । বাইরে বাস দাঁড়িয়ে।
শ্রীয়ার মনে পরল সুহানি বলেছিল । কিন্তু ওর ই মনে ছিল না । এর জন্য বাড়ি বয়ে আসার কি ছিল তা বুঝলো না শ্রীয়া। ওই তো পৌছে দিতে পারতো । সুহানি তখন মানদা মাসির পাশে দাঁড়িয়ে । যাওয়ার জন্য প্রস্তুত । ওরা বেড়োতে গেলেই শ্রীয়া বলে উঠলো – দাঁড়ান । আপনার নাম আর নম্বর টা দিয়ে যান ।
– কেন ? ভয় পাচ্ছেন ? আমায় ক্রিমিনাল মনে হয় ?
শুনেই রাগ চড়ে বসল শ্রীয়ার । – আপনি সোজা ভাবে কথা বলতে পারেন না ?
– না , আমি শুধু সোজা লোকের সাথে সোজা ভাবে কথা বলি । যাই হোক , আপনার এত চিন্তা যখন আপনিও চলুন । ওখানে খোলা মাঠ , সুন্দর জায়গায় ঝগড়া করতে বেশ লাগবে ।
শ্রীয়া এতটাই রেগে যে কি বলবে মাথায় আসছে না । কিন্তু সুহানি আর ছাড়ে ! চল না , চল না বলে শ্রীয়ার হাত ধরে টানছে । আসলে ঐটুকু বাচ্চাদের সাথে থাকতে ভালোই লাগে , কিন্তু …
– আর কিন্তু কিন্তু করবেন না । চলুন ।
অদ্ভুত তো , লোকটা কি করে জানলো …
যাই হোক । এসব ভাবনার মধ্যেই শ্রীয়া বাসে চাপলো । বাসে গান , নাচ সব কিছু বেশ লাগছিল । শ্রীয়া লক্ষ্য করল যে লোকটা ওর সাথে কথা বলে আর বাচ্ছা দের সাথে খেলে দুটো মানুষ পুরো আলাদা । হয়তো একই । নইলে কেউ একটা আইসক্রিম এর জন্য ঝগড়া করতে পারে এত বড় বয়সে ।
এসে গেছি । সব বাচ্চাদের হইচই তে শ্রীয়া নিজের ভাবনা থামিয়ে বাইরে তাকাল । সত্যি সুন্দর । সবুজ মাঠ , নীল আকাশ । গাছের ছায়া । বাস থেকে নামতেই এক বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এল ।
– মা , ইনি হলেন শ্রীয়া ।
পিছন থেকে লোকটা বললেন ।
মহিলাটি শ্রীয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন – খুব সুন্দর দেখতে তোমাকে । আমার ছেলের পছন্দ এত ভালো হবে আমি তো ভাবতেই পারিনি ।
শ্রীয়া কিছুই বুঝতে পারলো না । হা করে তাকিয়ে রইল । সময় পেয়েই ধরলো লোকটাকে …
আপনার মা কি বললেন ? কেন বললেন ?
– মা আমার বিয়ে দেবে বলে মেয়ে দেখছে রোজ ।আর আমার ওদের পছন্দ নয় । তাই মা আপাতত চুপ করলাম আপনাকে পছন্দ বলে ।
– এটা কি মজা চলছে ? আপনি এত বড় মিথ্যে বলেন কি করে ? আর আমার নাম নিলেন কি করে ?
– আরে আমার পছন্দের মেয়ে পেয়ে যাই । আমি নিজে মা কে সব বলে দেব । হয়েছে ? এখন বাচ্চাদের নজরে রাখা যাক ?
শ্রীয়া একটু অস্থির ভাবেই মাথা নাড়ল । অর আসাই উচিত হয়নি ।
– কি হল চুপ করে গেলেন যে ?আপনি এক কাজ করুন আমার জন্য একতা মেয়ে খুজে দিন । তাহলে আপনার সমস্যা আর আমার সমস্যা দুটোরই সমাধান হয়ে যায় ।
-আপনি তো আবার রাজপুত্র ।সব মেয়ে নাকি পছন্দ নয়।
-তা বলতে পারেন । আমার তো এমন মেয়ে চাই যে রাস্তায় দাড়িয়ে আমার সাথে ঝগড়া করতে পারে তাও আইস ক্রিম এর জন্য ।
– শ্রীয়া এবার একটু গম্ভীর গলাতেই বলল -আপনি কি মজা করছেন ? আমার একটুও ভালো লাগছে না ।এই ধরনের…..
– যদি বলি মজা করছি না ।
শ্রীয়ার চোখ ভিজে আসছে এবার । কেমন একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে ভিতরে । বেশ তো সামলেছে নিজেকে আবার একটা ঝড় নিতে পারবে না ও । এখন বাঁচার একটাই উপায় এই লোকটার মা ।
এই ভেবেই শ্রীয়া , রিনাদেবীর কছে গেল – আপনি আমায় ভুল বুঝছেন । আমি ডিভোর্সি । আমার আগে একবার বিয়ে হয়ে গেছে । আপনার ছেলে এসব কিছু জানে না । তাই ভুল করে …
– আমি ওসব কিছু জানি না । আমার ছেলের তোমায় পছন্দ হয়েছে । তুমি আবার শুনলাম স্কুলে পড়াও ।আমার N.G.O এর বাচ্ছাদের পড়াতে পারবে ।আর কি চাই !!!
শ্রীয়া চুপ হয়ে রইল । কিছু মাথায় আসছে না ।বুকটা কেমন ভারী হয়ে আসছে । কেন এরম হচ্ছে ? কেন এত ভয় হচ্ছে ওর ?
– কি ভাবছেন? পিছন থেকে সেই গলাটা ।
শ্রীয়া তাড়াহুড়ো করে পিছন ফিরে চিৎকার করল -কতটুকু চেনেন আমাকে? আপনার কি মনে হয় জীবনটা রূপকথা ? আপনি জানেন আমি ডিভোর্সী ?
– এত কথার কি আছে? আপনার পছন্দ নয় আমাকে সেটা বলে দিলেই হয়। সেটা আপনি বলছেন না। তার মানে… এবার আপনি বলুন আপনি জানেন আমি কে? কি কাজ করি? আমার নাম কি? তারপরেও আমার সাথে দাঁড়িয়ে। তাই যা জানি না তা না জানাই থাক।
-তা হয় না । আমি কিছু জানি না । আপনি অত্যন্ত ছেলেমানুষের মত কথা বলছেন । ভাললাগা আর ভালবাসা আলাদা ।
– অতকিছু জানি না । আমার মার বৌমা চাই ,আমার ঝগড়া করার লোক চাই । আপনাকে চাই , আপনাকে চাই ।
শ্রীয়া অনমনেই বলে উঠল – ওটা তোমাকে চাই ।
– তাই ?
শ্রীয়ার হুশ ফিরল -না ।
– একটা কথা বলব। সময় নিন ।নিজেকে চেনার ।আমাকে চেনার ।আমি আছি , থাকব।
শ্রীয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ।কিছু যেন ভাঙছে ,কিছু যেন গড়ছে । কিছু যেন চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে । কিছু যেন মুখে হাসি আনছে।
আবার সেই গলা – একটা কথা বলব ?
শ্রীয়া যেন হালকা লজ্জা পেয়েই বলল
– কি ?
-আমার নাম সৃজন।
শ্রীয়া আবার কি বলবে বুঝতে পারল না । তবে হয়ত এবার রাগে নয় ।