পাঁচ টাকার বাতাসা

পাঁচ টাকার বাতাসা

(১)

বোসবাবুদের কাজের মেয়ে মালতী আজ ছুটি নিয়েছে।
– কোন একটা ছুতোনাতা পেলেই হলো, অমনি ছুটি চাই। বলি আমরা কি মুখ দেখার জন্য লোক রেখেছি গো? কথায় কথায় ছুটি নিলে বাসনের গোছা দু’বেলা মাজতে মাজতে আমার হাতের নোড়া ধরে যায়। কতজনকে বলেছি একটা ভালো কাজের লোক দেখে দেওয়ার জন্য। সবাই বলে, “কাজের লোক ছুটি নেবেই”। সব অসুবিধা আমাদেরই সহ্য করতে হবে। কাজের লোক রেখে ঘাট হয়েছে আমার। সারাদিন হেঁসেল ঠেলব, আবার গুচ্ছের বাসনও ধোব আমি। আমাকে তো আর মাইনে দিতে হয় না!

বোস-গিন্নি রান্নাঘরে কাজ করতে করতে গজগজ করেন। সকাল থেকে ভেবে রেখেছিলেন আজ বিকেলে একবারটি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যাবেন পূজো দিতে। সে আর হ’বার নয়। সবাই যাচ্ছে নতুন স্কাইওয়াক দেখতে। বোস-গিন্নির পোড়া কপালে সে আর লেখা নেই। এই কাজের লোকের জ্বালায় কোথ্থাও যাওয়ার যো নেই।

(২)
খাওয়া-দাওয়া মেটার পর বোস-গিন্নি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন একটা ঠিকে কাজের লোক খোঁজার জন্য।
ওই তো একজন হলুদ রঙের ছাপা শাড়ি পড়া সধবা বৌ আসছে, মাথায় চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। হুঁ হুঁ, মনে হচ্ছে কারো বাড়িতে কাজটাজ করে।
– এই শোনো, তোমার জানাশোনা কোন কাজের লোক আছে কি ? আমার একজন ঠিকে কাজের লোকের দরকার।
-আমিই পাঁচটা ফেলাটে বাসন ধুই। আর কাজ নিতে পারব না। তবে কেউ যদি কাজের কথা বলে তাহলে আপনাকে বলব।

– শোন, আজকে আমার বাসনগুলো ধুয়ে দেবে? নগদ টাকা দিয়ে দেব!
বসুধা যেন মরিয়া।
– না মাসীমা, আমি পারব না। আমাকে পাঁচ জায়গায় যেতে হবে, আমার সময় নেই।
অগত্যা বোস-গিন্নি নিজেই বাসনের গোছা নিয়ে বসলেন কলতলায় । মশার কামড় খেতে খেতে আর বাসন ধুতে ধুতে চোখে জল এসে যায় তাঁর। দাঁত কিড়মিড় করেন তিনি।
– হতচ্ছাড়ি, কাল একবার আসুক। দূর করে দেব ওকে। আমার কাজের লোকের দরকার নেই। খুব হয়েছে! ঢের শিক্ষা হয়েছে আমার! পূজোর বোনাস, শীতের চাদর, বাড়ির পুরোনো জামাকাপড়, আর দিচ্ছি তোমায়?

(৩)
– ওমা, তুমি এখানে একা একা গজগজ করছ কেন? আজ মালতীদি আসে নি?
মেয়ে কখন কলেজ থেকে ফিরে এসেছে, টের পান নি বোস-গিন্নি বসুধা। অবাক হয়ে বললেন,
– তুই ভেতরে ঢুকলি কি করে?
– দরজা তো ভেজানো ছিল। আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। তোমায় খুঁজতে খুঁজতে দেখি এখানে বসে আছো। কি কান্ড বলত? আমি ছাড়া অন্য কেউ যদি ভেতরে ঢুকে পড়ত?
বসুধা মনে মনে জিভ কাটেন । ছি ছি, তিনিই তো ওই কাজের বউটির সাথে কথা বলার জন্য দরজাটা খুলেছিলেন। কিন্তু বন্ধ করতে ভুলে গেছেন।

ধোয়া বাসনের একটা গোছা এগিয়ে দিয়ে মেয়েকে বললেন, “এগুলো রান্নাঘরে একটু উপুড় করে দে তো।”
মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল, “দাঁড়াও, এই তো বাড়িতে ঢুকলাম! অমনি একটা কাজ দিয়ে দিচ্ছ? হাতমুখটা একটু ধুই?”
– হ্যাঁ, তোমরা তো আমাকেই দাসিবাঁদি দেখেছ? সব তো আমিই করব। তোমাদের কাউকে কিছু করতে বললেই সব পা ভারী হয়ে যায়!

গজ গজ করতে করতে বসুধা নিজেই বাসনের গোছাটা তুলে ধরতে গিয়ে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যায়।
– আহঃ, তুমি যে কি কর না, মা। একটা কাজ ঠিক করে পারো না।
– হ্যাঁ, তা তো বলবিই। সারাদিন সব কাজ আমি করব আর উনি বাইরে থেকে হাওয়া খেয়ে এসে আমাকে উপদেশ দেবেন, কথা শোনাবেন।

কলি দেখল মায়ের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে, সে আর কথা না বাড়িয়ে টুক করে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
বসুধা এক নাগাড়ে নিজের মনে বক বকর বকর করতে করতে বাসন নিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। হাঁটু আর কোমড় ব্যাথায় টনটন করছে।

(৪)
বোসবাবুদের বাড়িতে দুটি টি. ভি. – একটা বসার ঘরে। আর একটা কর্তাগিন্নীর শোয়ার ঘরে। মেয়ে বসার ঘরে বসে টি. ভি.-তে নিউজ দেখছে, অথচ শোয়ার ঘর থেকে তারস্বরে সিরিয়ালের আওয়াজ নেই দেখে বোসবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– হ্যাঁ রে, তোর মা কোথায় গেল রে?
– ওই তো, ঘরে শুয়ে আছে।
বোসবাবু ফিসফিস করে জানতে চাইলেন,
– তোর সাথে ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়েছে না কি?
– না না, সেরকম কিছু নয়।
ঘর অন্ধকার। বোসবাবু সন্তর্পণে ঘরে ঢুকলেন। গিন্নী খাটে শুয়ে আছেন ।
– কি গো, শরীর টরীর খারাপ না কি?
– হুঁ।
– ও, তা কি হয়েছে?
– হাঁটু আর কোমড়ের ব্যাথাটা খুব বেড়েছে। তুমি আজ ভাতটা বসিয়ে দিতে পারবে?
– আমি? এই তো সবে অফিস থেকে ফিরলাম। মেট্রো আর বাসে যা ভীড়!
বসুধা উল্টো দিকে মুখ করে পাশ ফিরে শুলেন।
বোসবাবু আরো একটু নরম সুরে বললেন, “এক কাপ চা পেলে ভালো হতো। তুমি একটু উঠতে পারবে না কি?”
সঙ্গে সঙ্গে বসুধা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,”তোমরা আমাকে কি ভেবেছ, অ্যাঁ? বলি, মানুষ বলে মনে করো, না কি? আমি কোমড়ের যন্ত্রণায় উঠতে পারছি না আর তুমি আমার সাথে রসিকতা করছ? আমি নাটক করছি? ইচ্ছা করে শুয়ে আছি? কাজের লোক আমাকে দাসিবাঁদি ঠাউরেছে, তোমরাও তাই।

কলি বলল, “বাবা, তোমার কি দরকার ছিল মায়ের সাথে কথা বলতে যাওয়ার? দেখছ, আজ পরিস্থিতি ভালো নয়। চলো, আমি তোমাকে চা বানিয়ে দিচ্ছি।”

– রাতে হোমসার্ভিস থেকে খাবার আনিয়ে নিই বল?
– দাঁড়াও না, আগে ফ্রিজটা খুলে দেখি কি কি তরকারি আছে। আমি বরং ভাতটা বসিয়ে দিচ্ছি। তুমি বরং ফ্যানটা ঝড়িয়ে দিও।
– কিন্তু চাল কতটা নিতে হয়, জানিস কি?
– না জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করব?
– না থাক। দাঁড়া, আমি মোটামুটি আন্দাজ করে মেপে দিচ্ছি। তুই হাঁড়িতে জল ভরে ওভেনে বসা।

(৫)
সকালে উঠে বসুধা দেখলেন হাঁটু আর কোমড়ের ব্যাথা – দুটোই বেশ কম। রাতে বাম মালিশ করে হট-ওয়াটার ব্যাগের সেঁক দিয়ে দিয়েছিল কলি। তাই হয়তো ব্যাথাটা কমেছে। নাহ, হাঁটতে গেলে গতকালের মতো কষ্ট হচ্ছে না। বসুধা দেওয়ালে হাত না রেখেই বাথরুমে গেলেন। নীচু হয়ে এঁটো বাসনের গোছা তুলতে গিয়ে দেখলেন, কোন ব্যাথা লাগছে না। বাহ, বেশ তো! বাম লাগিয়ে সেঁক দিয়ে বেশ লাভ হয়েছে। জয় মা ভবতারিণী!
হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। এত সকালে আবার কে এল? দরজা খুলেই মাথা গরম হয়ে গেল বসুধার। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। কিন্তু এখন মাথা গরম করলে চলবে না। আগে একটা লোক জোগাড় হোক। শুধু শুকনো মুখে বললেন, “ভেতরে এসো।”

– রাগ করেছ বৌদি?
-নাঃ, রাগ করে আর কি করব? আমার কথা কে আর ভাবে!
– আমি ভাবি গো বৌদি। কাল আসতে পারি নি বলে খুব রাগ করেছ, তাই না? কি করি বলো? হঠাৎ করে আমার বোন আর ভগ্নীপতি এসে হাজির হল। ওদের ইচ্ছা দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পূজো দিতে যাবে। মুখের উপর না বলা যায় না। তাই ওদের নিয়ে যেতে হল। ছেলেটাকেও সাথে নিয়ে গেলাম, তাই তোমায় খবর দিতে পারি নি গো। তোমার জন্যও পূজো দিয়েছি। তোমার কোমড়ের ব্যাথাটার জন্য মাকে পাঁচ টাকার বাতাসা মানত করেছিলাম। এই নাও প্রসাদ।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত