সারাটাদিন ব্যস্ত শহরের ক্লান্তি কাটিয়ে হাতে কফির কাপ নিয়ে ছাদের কোনে দাঁড়ায় তৃষ্ণা.
ডিউটি আর মনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে এই নেশাতুর শান্ত পরিবেশের জুড়ি মেলা ভার
‘আজ আকাশ টা বড্ড উদাস, যেনো কোনো বিরহতে বৃষ্টি হয়ে নামবে আজ’- তৃষ্ণা আনমনে বললো।
‘আজকাল মেয়ের মুখে এতো অনুভূতির খেলা, কি ব্যাপার’- পাশ থেকে টিপ্পনি কাটে চিরদিনের সব চেয়ে ভালো বন্ধু মা।
‘তোমার না সবেতেই অনুভূতির গন্ধ খোঁজা, ছোটোবেলায় কি ফেলুদার প্রেমে পড়েছিলে!’- হাসতে হাসতে বলে ডাঃ তৃষ্ণা বোস,
‘ফেলুদা তো ভালোলাগা, আর বোমকেশ বক্সী অনুভূতি’
‘উফ্ মা তুমিও না, যাও এখন’
‘তাড়াতাড়ি আয়, আমি নীচে গেলাম’
সত্যি ভালোলাগা আর অনুভূতি কি সমান্তরাল নাকি ভালোলাগারা চিরকালীন বাউন্ডুলে আর অনুভূতিরা পরাধীন, মনে মনে ভাবে সে।
হালকা স্নিগ্ধ বাতাস, আলো আবছায়া পরিবেশ তাকে নিয়ে যায় কিছু বছর আগের কোনো এক দিনে……
‘excuse me, adimission কোথায় চলছে একটু বলতে পারবেন?’-
‘admission বাস না ট্রেন যে চলবে, কাউকে বলুন, দেখিয়ে দেবে’-রাগী ভাবে জবাব দেয় তৃষ্ণা, কলেজের প্রথম দিনেই মেজাজ বিগড়ে গড়ের মাঠ হয়ে যায়
‘ছেলেটা বেশ হ্যান্ডু আছে বুঝলি তো’ পাশ থেকে বলে রিয়া
‘চুপ কর হ্যান্ডু না ছাই’
‘তোর দিকে তো ফ্যালফ্যাল করে দেখছিলো’
‘কিছু বলুক দেবো এক ঘুষি’ জবাব দেয় চিরকালের ডাকাবুকো স্বভাবের সুন্দরী তৃষ্ণা, কলেজের প্রথম দিনেই ঝড় তোলা সুতন্বীটি.
এক একটি দিন পেরোতে থাকে কলেজ লাইফে, সাথেই নিজেদের উদ্দীপনার দিকে নতুন ভাবে মেলে ধরতে থাকে তারা, সাথে জানা হয়ে যায় কলেজের প্রথম দিনে সেই প্রশ্নর্তার নাম আকাশ চৌধুরী।
চু্ম্বক যেমন লোহাকে তীব্র ভাবে আকর্ষন করার লক্ষে ছুটে চলে, তেমনি আকাশের বুকে বৃষ্টির ধারাতে তৃষ্ণা নিবারন আকর্ষিত হতে থাকে.
ঝগড়া থেকে শুরু দিয়ে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব খুনসুটি তে চলতে থাকে তাদের জীবন।
‘ওই গাধা নন্দন যাবি”- তৃষ্ণা বলে
‘তুই কি সিনেমা করছিস যে দেখতে নিয়ে যাচ্ছিস!’- আকাশের সহাস্য উত্তর
‘ওর মতো মাথামোটা কে বলে হবেনা, চল’
‘কেনো ?’
‘চলনা হনুমান, দেখাবো মজা’
হাঁটতে থাকে দুজন জানা গন্তব্যে আজানা পথের দিশাতে.
‘আকাশ একটা কথা বলবো?’
‘কথা বলতে ডাকাতের অনুমতি, ভাবা যায়’
‘উফ শুনবি!’
‘আচ্ছা বল’
‘তোর সাথে এভাবে সারাজীবন হাতে হাত রেখে হাঁটার অধিকার দিবি’, সহসা হাতের আলতো ছোঁয়া জানান দেয় মাদকতা আকাশের হাতে,
কিছুক্ষন নীরবতার মধ্যে আকাশ বলে ওঠে-
“ইচ্ছে করে সাঁঝবিকেলে
থাকবো বসে তোর পাশেতে
নাই বা পাবো রামধনু রঙ
তোর সাথে স্বপ্ন নীড়
তোর চোখেতেই তেপান্তর”
কখন যে দুটি হাত একে অপরকে আবৃষ্ট করেছে অঙ্গীকারে তার সাক্ষী শহরের রাজপথে লিপিবদ্ধ।
মন তার নিয়মে ভেসে চলে, না মানে পরিবেশ , না কোনো বাঁধন।
আজ তৃষ্ণার মন ভেসে চলেছে সেই বাঁধনহীন আকাশে।
ছাদ থেকে নেমে সবার সাথে কথা বললেও মনের গুমোট পরিবেশ থেকে রেহাই মেলেনি।
ঘরে এসে আধখোলা জানালায় চাঁদের আলোর সাথে নিজেকে মাখিয়ে বিছানায় মেলে ধরে সে।
‘আজ সব কিছু শেষের পরেও কেনো এই সর্বনাষা সীমাহীন আকর্ষন’- মনে মনে ভাবে সে।
‘আজ বৃষ্টিতে শহর টা কি সুন্দর লাগছে দেখেছিস!’- আকাশ বলে, সন্ধেতে গঙ্গার পাশে হাঁটতে হাঁটতে।
হঠাৎ শীতল বাতাসে তৃষ্ণার এলোমেলো সুবাসিত চুল নিজের অস্বিত্ব জানান দেয় আকাশের মুখে।
‘তোর কাছে উন্মাদ মাতাল এক নেশা আছে’- আকাশ বলে
বৃষ্টি ভেজা সন্ধেতে তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণাতে চাতকের মতো ভেসে আকাশ, ভেজা হাতে ছুঁয়ে যায় হাত, যেন এক মাদকতা ভর করে মনে.
‘হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়
তোর চোখেতে, তোর ঘন কেশে
বৃষ্টি কনা হয়ে ঝরে পরবো তোর মনেতে প্রানেতে
তীব্র এক ঘ্রান নেবো বন্য এক ছোঁয়াতে’- নেশাতুর দৃষ্টিতে আকাশ বলে তৃষ্ণার ঝলসে ওঠা চোখের দিকে চেয়ে, যেন কোনো পতঙ্গ অমোঘ টানে নিজেকে সমর্পিত করে আগুনে।
অনুভূতির উদ্দীপনে সিক্ত ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় নিজেকে অন্য ঠোঁটের প্রগাড় আবেশে।
‘কিরে ওঠ, অনেক বেলা হল’ – মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তৃষ্ণার।
সকালটা আজ অনেক স্নিগ্ধ, পাখিদের কলরব তাতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে।
‘আজ তোর বাবার ছোটোবেলার এক বন্ধু বাড়িতে আসছে’
‘কখন?’
‘দুপুরে’
ফিরে যায় মন সেই বিচ্ছেদের মুহূর্তে এমনি কোনো এক দুপুরে।
‘শোন তৃষ্ণা আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো’
‘যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো? বিয়ে করার প্ল্যান করছিলাম আমরা’
‘তুই একটু বোঝ’
‘আমি আসছি, আমার সাথে যোগাযোগ করবিনা’
মরুভূমির মরীচিকার মতো মিলিয়ে গিয়েছিলো সে।
‘কি রে তুই এখানে আমাদের বাড়িতে?’ আকাশ কে দেখে অবাক মনে প্রশ্ন তৃষ্ণার
‘তোর বাবাই আমার বাবার ছোটোবেলার বন্ধু’
‘ভালোই তো তোরা তাহলে ওপরে গিয়ে গল্প কর’- মা বলে তৃষ্ণা কে
নীরবতার পাহাড় ভর করে দুজনের মধ্যে
‘কিছু তো বল’ হাতের আলতো ছোঁয়ায় তৃষ্ণাকে বলে আকাশ
‘কোনো তো কথা নেই’
‘এরকম কেনো করছিস, আমি আমার সেই ডাকাবুকো মেয়েটাকে যে ফেরত পেতে চাই’
‘ছুঁবিনা আমাকে, দূরে যা’
গত কয়েকমাসের তীব্র ছাই চাপা বিরহের আগুনের সমাপ্তি হতে থাকে দুজনের তীব্র আঙ্কাক্ষায়, পুরানো বৃষ্টি ভেজা নেশা ফিরে আসে চোখে।
নতুন স্বপ্নে তেপান্তরে যাযাবর হয়ে ওঠে দুটি মন।