গলির সামনে কমিউনিটি সেন্টারের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। শীতকাল হলেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে। শহরে শীত তেমন একটা বোঝা যায় না, গোটা শীতকাল আমি টিশার্ট পরেই কাটিয়ে দেই। আজকের ব্যাপারটা অবশ্য ভিন্ন। বৃষ্টির কারণে বেশ শীত লাগছে, শীত বেশি লাগছে বলেই আজকে একটা ওয়াটার প্রুফ জ্যাকেট পরে বের হয়েছি।
শীত যত বেশি পরবে বিড়িখোরদের বিড়ি টানাও ততই বৃদ্ধি পাবে, এমনটাই হয়ে আসছে, পেটে দু’ দানা ভাত পরুক বা না পরুক সেদিকে এরা ভ্রুক্ষেপ করে না, এদের চিন্তা হচ্ছে পকেটে সর্বশেষ সম্বল দিয়ে হলেও একটা সিগারেট টানতেই হবে। টাকা-পয়সা না থাকলে, দোকানদার ভাইয়ের সঙ্গে ভাব জমাতেও বিড়ি খোরেরা কোন কার্পণ্য বোধ করে না। দোকান থেকে বাকিতে সিগারেট কিনতে গেলে সিগারেট খোরদের মুখে যেই মিষ্টি হাসি ফুটে ওঠে, সদ্য বিবাহিত জামাইরা নতুন বউয়ের সাথে আলাপের সময় ওমন মিষ্টি করে হাসতে পারে কি না সন্দেহ আছে।
আমার মুখের হাসি দেখেই আলামিন ভাই বলল-
—ভাই সিগারেট লাগব?
—হ্যাঁ ভাই।
—কয়টা?
—দুইটা দেন ভাই।
সিগারেট জ্বেলে গলির ভেতর দিয়ে সোজা কমিউনিটি সেন্টারের দিকে হাটা দিলাম। একটা টান দিয়ে ধুমা ছাড়ছি ঠিক সেই মুহূর্তে সানোয়ার আংকেল কোত্থেকে যে উড়ে এসে জুড়ে বসল, তার দৃষ্টি বরাবর আমার দিকে। এমন ভাবে তাকিয়েছেন ভাবলাম কিছু একটা জিজ্ঞাস করবে, খুব কষ্টে সিগারেট টা পেছন দিকে ছুড়ে মারলাম। এই লোক হচ্ছেন গিয়ে একজন গোয়েন্দা, ছোট থাকতে ইনার কারণে আব্বার হাতে কম ধোলাই খাই নাই। ইনি যদি কোনক্রমে বুঝতে পারে সিগারেট টানছিলাম, তবে নালিশটা যে বরাবর আব্বার নিকট গিয়ে পৌঁছুতে পাঁচ মিনিট সময়ও লাগবে না সেই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নাই।
আংকেল কাছাকাছি চলে আসছে, আমি সালাম দেয়ার জন্যে প্রস্তুত, কিন্তু বিধিবাম! তিনি আমাকে সালাম দেয়ারও সুযোগ দিলেন না দ্রুত পাশ দিয়ে চলে গেলেন। পেছন ফিরে দেখলাম অল্প একটু পিছে রউফ আংকেল দাঁড়িয়ে আছে, মানে হচ্ছে তিনি রউফ আংকেলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন, আমার দিকে বোধহয় কোন খেয়ালই ছিলো না। কিছু মানুষ আছে এদের দৃষ্টি যে কোনদিক থাকে বোঝা বড় দায়। সানোয়ার আংকেলের মতন ছিলো আমাদের অংক স্যার। পরীক্ষার হলে স্যার তাকিয়ে থাকতেন একদিকে আর নকল ধরতেন অন্যদিকের। আমাকেউ একবার ধরছে। ইংরেজী পরীক্ষার দিন দেখলাম স্যার একদম সামনের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে, আমি ছিলাম ২৩নম্বর বেঞ্চে, এতদূর থেকে মোটেও দেখার কথা না, তারপরও চোখ-কান খোলা রেখে নকল বের করে প্রশ্নের নীচে রেখে লিখতেছিলাম। রচনার অর্ধেক মাত্র লেখা শেষ করছি, স্যার কোত্থেকে যে রকেটের গতিতে এসে প্রশ্নের নীচের নকল বের করে ফেলল বুঝতেই পারলাম না।
আংকেল কিছুটা দূরে চলে যাবার পর পেছনের দিকে ফেলে দেয়া সিগারেট টা খুঁজতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত পেলামও তবে তাতে আর আগুন জ্বলবার কোন লক্ষণ দেখলাম না। বৃষ্টির জল পরে একদম ভিজে চুপসে গেছে। পকেটে এমনিতেই টাকা নাই, বাকিতে সিগারেট নিলাম তাতেও শান্তি নাই। খোদা সব ঠাডা কি গরিব মাইনষের মাথাতেই পরতে হইব?
একটা সিগারেট জলে গেল, আরেকটা জলে যেতে দেয়া যাবে না। গলিতে সিগারেট জ্বালতে গেলে কে না কে হুট করে সামনে এসে দেখে ফেলে তার কোন ঠিক নাই, তাই গলিতে আর সিগারেট না জ্বেলে হাটতে হাটতে কমিউনিটি সেন্টারের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। পকেটে কোন ম্যাচ নাই, বাসায় আম্মা ম্যাচ ছোঁয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তার ধারণা বাড়ির সব ম্যাচ আমিই চুরি করি। মুখ ফুটে বলতেও পারি না, সিগারেট কি শুধু আমিই খাই, তোমার জামাই খায় না? মুখ ফুটে বলতে না পারারও কারণ আছে, একবার বাড়ির ছাদে হাতে নাতে আম্মার কাছে ধরা খাইছি, সেই যে একবার দেখছে সেই থেকে তার মনে ঢুকে গেছে আমি যেহেতু সিগারেট খাই সেহেতু সব ম্যাচ আমিই সরাই।
ম্যাচ না থাকায় সিগারেট জ্বালতে পারছি না। অপেক্ষা করছি সিগারেট হাতে কেউ না কেউ একজন এই পথে আসার।
মিনিট পাঁচেক পর দূরে একজন লোককে দেখলাম বিশাল কালো ছাতি হাতে সিগারেট টানতে টানতে এইদিকে আসতেছে। লোকটাকে দেখতে ঠিক তামিল নাড়ুর লোকেদের মত দেখাচ্ছে। লুঙ্গীটা সে তামিল নাড়ুর লোকেদের মতন অর্ধেক ভাঁজ করে রেখেছে।
কাছাকাছি আসার পর, দ্রুত কাছে গিয়ে বললাম, চাচা সিগারেট টা একটু দেন, তিনি সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেই আমি সিগারেট ফালায়া পাগলা কুত্তার মতন দৌড় মারলাম। তিনি পেছন থেকে চেঁচাতে শুরু করলেন- কেরে ঐ দাঁড়া, দাঁড়া বলতাছি।
ব্যাপারটা বুঝলেন না?
আরে ভাই যেই লোকের কথা বললাম, তামিল নাড়ুর লোকেদের মতন লুঙ্গী ভাঁজ করে ছাতি হাতে কমিউনিটি সেন্টারের দিকে আসতেছিলো। কাছে আসার পর সিগারেট চাইলাম, সিগারেট দিতে গিয়ে ছাতাটা একটু সরে গেছিল, তখনই ছাতার ফাঁক দিয়া দেখতে পাইছি, এই তামিল হিরো আর কেউ না, আমার বাপজান।