“সত্যি, বাবা, মানুষ যে কিভাবে এতো অগোছালো হতে পারে তা এই লোকটাকে না দেখলে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না।”
টেবিলে ছড়ানো বইগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে মনে মনে গজগজ করছিল চৈতি।হঠাৎ হলদে রঙের মলাটের বই থেকে একখানি ফোটো মাটিতে পড়ে গেল।ছবিটা তুলে নীচের তারিখটা দেখতেই মনে পড়ল, আজ থেকে প্রায় আটবছর আগে তোলা ফোটোটা।কিন্তু এই ছবিটা যে কোনোদিন সত্যি হবে, তা চৈতি নিজেও আন্দাজ করতে পারে নি।শুধু চৈতি কেন, রক্তিমও হয়তো ভাবতে পারেনি।কিন্তু যে ওর আর রক্তিমের এই ছবিটা তুলেছিল, সে বলেছিল,
“দেখে নিও তোমরা, এই ফোটোটার মতোই আরো অনেক ফোটো তুলব আমি।” কথাটা মনে হতেই আপনমনে হেসে উঠল চৈতি।অজান্তেই মনটা অতীতের অ্যলবামের পাতাগুলো অনেকবছর পর আবার ওল্টাতে শুরু করল।
একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হয়ে ওঠা চৈতির।
বাবা সরকারি কর্মরত হওয়ায় অফুরন্ত না হলেও স্বচ্ছলই ছিল ওদের পরিবার।তখন সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস্টার্সের জন্য তৈরি হচ্ছে চৈতি।কিন্তু হঠাৎ যেন এক দামাল ঝড় এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গেল ছোট অথচ সুখী পরিবারকে।চৈতির বাবা অফিসে কাজ করতে করতে হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করতে থাকায় সহকর্মীরা পাশের হাসপাতালে নিয়ে যায়।চৈতিরা যতক্ষণে ওখানে পৌঁছায়,সবকিছুই শেষ। ডাক্তারি রিপোর্টে জানা যায়,ম্যাসিভ হার্ট এট্যাক্ এর কারণ।সেদিন থেকেই চৈতির জীবনের হিসেব নিকেশগুলো ওলটপালট হতে শুরু করে।বাবার আকস্মিক মৃত্যু মা মেনে নিতে পারেননি, ক্রমশ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন।বাড়ির বড়ো মেয়ে হওয়ায় সংসারের গুরুদায়িত্বটা আপনাআপনিই যেন ওর কাঁধে এসে পড়েছিল। গ্র্যাজুয়েশনের মার্কস ভালো থাকায় একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি পেতে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি।কিন্তু সেইসময় যাকে পাশে পাওয়ার আশা করেছিল সে বলেছিল,
“চৈতি, বাড়িতে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বিয়ের পর তুমি দুটো পরিবারের দায়িত্ব একসাথে কিভাবে সামলাবে সেটা নিয়েই সবাই একটু টেনশানে আছে।”
অপলক দৃষ্টিতে মৃণালের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে শান্তস্বরে বলেছিল চৈতি,
“ঠিকই বলেছ।তবে বেশি টেনশন করোনা, আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি তুমি এমন কাউকে পেয়ে যাবে যে শুধুমাত্র তোমার সংসারের দায়িত্বটাই সামলাবে।” মৃণালের মুখটা দেখে মনে হয়েছিল কেউ যেন সপাটে একখানি চড় মেরেছে ওর গালে।
একদিকে অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা, অপরদিকে ছোটভাইয়ের পড়াশোনা, দুটোতেই কোনো খামতি রাখেনি চৈতি।শুধু যা পারেনি, তা ছিল নিজের জন্য সময়।সংসারের দায়িত্ব, কর্তব্যে নিজের চাওয়া পাওয়াগুলো যে কখন হারিয়ে গেছিল নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি ও।
টুংটাং আওয়াজে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে চৈতি।বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইলটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে ম্যাসেজ,
“সব ঠিক আছে তো ?”
আপনাআপনি ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্তির হাসি খেলে যায় চৈতির।এই লোকটা হাজার মাইল দূরে থাকলেও যেন ওর মনটা পড়তে পারে।হাসিমুখে রিপ্লাই অপশনে লিখল,
“আজ্ঞে হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।আপনি কখন ফিরছেন ?”
“আপনি হুকুম করলে এখুনি ফিরতে পারি।” তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই ওপর প্রান্তের উত্তর চলে এলো।
“বেশি না বকে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো।মনে আছে তো, বিকেলে আবার বেরোতে হবে।”
“ওহহহ্ বাবা, সেকি আর ভুলতে পারি!! কি দস্যি মেয়ে গো তোমার!! আগে থেকেই হুমকি দিয়ে রেখেছে, ওখানে পৌঁছতে দেরি করলে নাকি সাইক্লোন আসবে।তুমি চিন্তা করোনা, আমি ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাব।”
ফোনটা কেটে রক্তিমের বলা কথাটাই ভেবে হাসছিল চৈতি।মেয়েটার মাথায় গন্ডগোল তো আছেই, নইলে ওর মতো একজন অপরিচিতাকে এতো সহজে আপন করে নিলো কিভাবে !!
স্কুলের চাকরিতে ঢুকেই রিনিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল চৈতির।ভীষণ প্রাণবন্ত আর মিশুকে স্বভাবের ক্লাস টু এর মেয়েটা প্রথমদিন থেকেই ওর নজর কেড়েছিল। সংসারের যাঁতাকলে আর স্কুলের চাপে যখন মনটা হাঁসফাঁস করত, তখন রিনিতাই ছিল ওর কাছে একমুঠো অক্সিজেন।স্কুলের টিফিন আওয়ার্সে ওর অফুরন্ত বকবক্,কঠিন অঙ্ক বুঝিয়ে দেওয়া, পড়াশোনার ফাঁকে ওর ছোট্ট হাতের করা ড্রইংগুলো, সবকিছুই চৈতিকে অনাবিল আনন্দ দিত।সেই মেয়েটি যেদিন ওকে সরলমনে জিজ্ঞেস করেছিল,
“আচ্ছা মিস্, স্কুলে তো সবার মা আসে, শুধু আমার মা নেই কেন গো ?” সেদিন এক অবোধ্য মমত্ববোধে শিশুটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল চৈতি।আসলে নারীচরিত্রটা বড়ই অদ্ভুত!! মাতৃত্ববোধটা যেন ওদের সহজাত প্রবৃত্তি, যা কখনো শিখিয়ে দিতে হয়না।
ডাক্তারের পরামর্শে মাকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই পার্কে অল্প পায়চারি করতে যেতো চৈতি।সেরকমই এক বিকেলে রিনিতা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর বাবার সঙ্গে।হঠাৎ রক্তিম আর চৈতিকে ভীষণ অপ্রস্তুত করে এই ফোটোটা তুলেছিল রিনিতা।ফেরার পথে নিভৃতে একবার বলেছিল চৈতি,
“যদি সম্ভব হয়, রিনিতাকে একটু মায়ের যত্ন দেবেন।”
“সম্ভবপর হলে নিশ্চয় দিতাম।” অসহায় গলায় বলেছিল রক্তিম।
পরবর্তীতে অনেকটা রিনিতার মুখের দিকে চেয়েই রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা করতে বাধ্য হয়েছিল ওরা।নাহ্,এবার আর ওকে একা দুটো পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে হয়নি।নতুন পরিবেশে চৈতি যখন নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল তখন রক্তিম পাশে এসে বলেছিল,
“সব সম্পর্কের সূচনা ভালোবাসা দিয়ে হয়না, কিছু কিছু সম্পর্কের হাতেখড়ি বন্ধুত্ব দিয়ে হয়।আমাদের সম্পর্কটাও বন্ধুত্বের হাত ধরে চলুক।”
কথা রেখেছে রক্তিম।জীবনের চলার পথে যখনই হোঁচট খেয়েছে চৈতি, শক্তহাতে ওকে আগলে রেখেছে রক্তিম।সময় সব পরিস্থিতি বদলে দেয়।ওদের বন্ধুত্বটাও ওদের অজান্তে অন্যখাতে বইতে শুরু করেছিল।প্রথমবার মিসক্যারেজের পর ডাক্তার যখন বলেছিল আর রিস্ক না নেওয়াটাই ভালো তখন স্বাভাবিকভাবে ভেঙে পড়েছিল চৈতি।সেইসময় রক্তিম ওর চোখের জল মুছিয়ে বলেছিল,
“রিনি কি শুধু আমার মেয়ে, তোমার সন্তান নয় ?”
সেদিন রিনিতাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল চৈতি।সত্যি তো, রিনিতা তো ওর সন্তান।শুধু জন্মদাত্রী হলেই যে মা হওয়া যায় না, তা তো রিনিতাই ওকে শিখিয়েছে।
কলিংবেলের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বিছানায় গুছিয়ে রাখা কাপড়গুলো তাড়াতাড়ি আলমারিতে রাখতে রাখতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল চৈতি,
“এইরে্…চারটে তো প্রায় বাজতে চলল।”
অনেককষ্টে গাড়িটা পার্ক করেই দুজনে ছুটল প্ল্যাটফর্মে।কিন্তু বেশিদূর আর এগোতে হলোনা।পিঠে রুকস্যাক ব্যাগ ঝুলিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে সামনেই বিদ্যালয় প্রমোদভ্রমণ ফেরত ষোড়শী কন্যা দাঁড়িয়ে।ওদের দেখেই বলল,
“ঠিক জানতাম, বাবা অফিস থেকে বেরোতে দেরি করবে,তাই আমি আগেই ছোটমামাকে ফোন করেছিলাম।ভাগ্যিস মামু এসেছিল, নইলে তো এতক্ষণ আমি প্ল্যাটফর্মে বসে বাদামের খোসা গুনতাম।”
চৈতি অবাক হয়ে ছোটভাইকে জিজ্ঞেস করল,
“তোর না আজ অফিসে জরুরী মিটিং ছিল ?”
“ছিলতো।কিন্তু আমার ভাগ্নি থেকে মিটিং বেশি জরুরী তা তোকে কখন বললাম রে দিদি !!”মুচকি মুচকি হেসে আড়চোখে জামাইবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল পরাগ।
“এমনি এমনি কি লোকে তোদের শালা বলে!!যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ করেছে।”কটমট করে পরাগের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল রক্তিম।