রাস্তায় দাঁড়িয়ে দোতলার বারান্দায় চিঠি ছুড়ে মারার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম না, এর আগেও অসংখ্যবার সুজনাকে চিঠি দিয়েছি। মাঝেমধ্যেই রাগ করে সে ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দেয় তখন বাধ্য হয়ে বাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে চিঠি পাঠিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে তার রাগ ভাঙ্গাতে হয়।
গতকাল রাতে সুজনা রাগ করেছে। রাতে কয়েকশবার তাকে কল করেও কোন লাভ হয়নি, অসংখ্য ম্যাসেজ পাঠালাম তাতেও কোন প্রতিউত্তর পেলাম না। শেষ পর্যন্ত চিঠি লিখে সকাল সকাল দাঁত ব্রাশ করতে করতে সুজনাদের বাড়ির সামনে চলে আসছি। ভুলবশত চশমাটা বাসায় রেখে চলে আসছি। চশমা ছাড়া আমি আবার দূরের জিনিস ঘোলা দেখি, তবে কোনটা কি রঙ তা বুঝতে তেমন সমস্যা হয় না।
সুজনার বারান্দায় আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। বারান্দায় ওর কিছু ফুলের গাছ আছে, ঘন্টায় অন্তত একবার সে বারান্দায় এসে ফুলগাছ দেখে যায়। বারান্দায় এলেই চিঠিটা ছুড়ে মারব এই হচ্ছে গিয়ে পরিকল্পণা।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর সুজনার দেখা পেলাম। গত সপ্তাহে যেই নীল রঙের জামা পরে দেখা করতে আসছিলো আজকেও ঠিক একই জামা পরেছে। চশমাটা চোখে না থাকায় সুজনার চেহারা ঘোলা লাগছে, মনে হচ্ছে সুজনা আর আমার মাঝখানে একটা অস্পষ্ট গ্লাস আছে। চিঠিতে ছোট একটা ইট বেধে রেখেছি ছুড়ে মারতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তেই বারান্দা থেকে সুজনা ভেতরে চলে গেল।
এখন শীতকাল। সূর্যের তাপে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক ভিটামিন ‘ডি’ গায়ে লাগিয়ে নিয়েছি। শীতকাল হলেও কতক্ষণই আর সূর্যের তাপে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? খুব গরম লাগছে, পশমের গোরায় গোরায় শরীরের ঘাম চিকচিক করছে।
ইতিমধ্যে সুজনা চারবারের মতন এসে চলে গেছে। এতক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমার জন্যে তার কোন মায়া দয়া আছে বলে মনে হচ্ছে না, একবার শুধু আমার দিকে তাকিয়ে লাজুক একটা হাসি দিয়েছে। এই মূহুর্তে সুজনার লাজুক হাসিও মনে তীব্র ভৎসনা দিচ্ছে। সে বার বার এসে দ্রুত আবার ভেতরে চলে যাচ্ছে। একবার এসে গাছে পানি দিচ্ছে, একবার কাপড় শুকিয়ে দিচ্ছে, একবার ঝাড়ু দিচ্ছে, আমার দিকে তার কোন খেয়াল নাই।
মাঝখানে লাল রঙের জামা পড়া একটা মেয়ে আসছিলো, এইটা নিশ্চয়ই সুজনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে, কি জঘন্যভাবে ভেংচি কেটে গেল। ইতিমধ্যে সেও বোধহয় জেনে গেছে তার দিদিমনির কাছে পাত্তা না পেয়ে বাড়ির নীচে দাঁড় কাকের মতন দুইঘন্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। চেহারা স্পষ্টভাবে না দেখতে পেলেও ওকে যে একদম চিড়িয়াখানার বানরের মতন লেগেছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।
সুজনাদের বাড়ির পাশের গলিতেই একটা চায়ের দোকান আছে, কাজের মেয়ে কীর্তি দেখে মেজাজটা একদম খারাপ হয়ে আছে। সুজনাকে বিচার না দিয়ে আর পারছি না।
চায়ের দোকানে বসে চিঠিতে নতুন কিছু লাইন যোগ করে, নালিশ লিখে দিলাম-
“তোমাদের বাড়ির এই কাজের মেয়েটা একদম বেহায়া, সে আমাকে বানরের মতন ভেংচি কেটে গেছে, শুধুমাত্র তুমি আমার উপর রেগে আছো বলে কিছু বললাম না, নয়তো ঠিক একে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় ঢুকিয়ে রেখে আসতাম, রাগ কমলে এর একটা বিচার কিন্তু তোমাকে করতেই হবে”।
চিঠি আগের মতন ভাঁজ করে এক কাপ চা শেষ করে আবার সুজনাদের বাড়ির নীচে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই সুজনা এসে বারান্দায় দাঁড়াল। নীচ থেকে মুখের আকার দেখে মনে হচ্ছিলো সুজনার মুখে স্যরি সুলভ হাসি ফুটেছে। তার রাগ ভাঙ্গতেই আমার বুকে অভিমান ঝরে পড়ল, ভাবছিলাম চিঠিটা দিব না, কিন্তু কষ্ট করে লিখেছি জন্যে না দিয়েও আর পারলাম না, সই করে উপরে ছুড়ে মারলাম। অল্পের জন্য চিঠিটা সুজনার গায়ে লাগল না, চিঠি গিয়ে পরল ফুলের টপে। টপ থেকে চিঠি তুলে সুজনা এক দৌড়ে ঘরে চলে গেল।
মিনিট দশেক পর সুজনা রেগে-মেগে আগুন হয়ে নীচে এসে চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাস করল-
—এইসব কি?
—কি মানে? চিঠি।
—তাতো বুঝতেই পারতেছি, আমি দেখতে বানরের মত? আমাক চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচায় ঢুকাইয়া রাইখা আসবি?
—ছিছি, আমি তোমার কথা বলিনাই।
—আমি বানর? ওই আমারে তর বানরের মত লাগে?
—আরে কি বলছ? আমিকি তোমার কথা বলছি?
—মিথ্যা বলস তুই আমারে? কাজের মাইয়ারে প্রেমের চিঠি দিয়া এখন কাহিনী করতেছিস? তর মনে এই ছিলো? এইজন্যে পুরুষ মানুষ বিশ্বাস করতে নাই। এরা যার তার উপরে যখন তখন হোচট খায়।
—দেখো, এইটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, চিঠিটা আমি তোমাক দিছি।
—তাইলে চিঠিতে ‘প্রিয় বেলী’ লেখছস কেন?
—ওটাতো আমি ভালোবেসে লিখছি।
—ভালোবাসা! তুই আমারে আগেই বলতে পারতি তুই বেলীরে ভালবাসিস, তাইলে এমনেই আমি সড়ে যাইতাম।
—বেলী তো ফুলের নাম, আমি তোমাক বেলী ফুলের সাথে তুলনা করছি। বুঝতেছ না কেন?
—একদম কাহিনী করবি না, বেলী আমাদের বাড়ির কাজের মাইয়া, তুই ওর দিকে নজর দিছিস। যা গিয়া ওর সাথেই প্রেম করগা।
—আহহা শোন, আমিতো জানি না ওর নাম বেলী।
—তুই ভাল কইরাই জানিস, কাহিনী করিস না।
—দেখ, আমি যদি জানতাম তাইলে বেলী না লিখে জবা লিখতাম।
—তুই বেলীর বোনের দিকেও নজর দিছিস, তুই যে এত্তো খারাপ আগে বুঝি নাই।
—তোমাদের বাড়ির সব কাজের মেয়েদের নামই কি ফুলের নামে নাকি? দেখ আমি বেলী, জবা কাউরেই চিনি না।
—তাইলে তুই বেলীরে চিঠি দিছিস কেন? আমি যে কতক্ষণ দাঁড়ায়া থাইকা আসলাম তখন দিলি না কেন?
এই প্রথম মাথায় এলো, সুজানা লাল রঙের জামা পরে আছে। তার মানে ভুলটা আমারই হয়েছে কাজের মেয়েকে সুজনা ভেবে চিঠি….. ছি ছি।
—দেখ আমি যে চশমা ছাড়া দূরের জিনিস কম দেখতে পাই তাতো তুমি জানোই, তুমি গত সপ্তায় যেই জামা পরে আমার সাথে দেখা করছ, ওই জামা তো ওই মেয়ে পরে আছে, আমি ভাবলাম ওইটাই তুমি।
—তুই ভন্ড, প্রতারক একটা, ছলনা তো ভালোই শিখছোস।
—এতবার বলতেছি যে আমি চিঠিটা তোমাকেই লিখছি, এরপরেও বিশ্বাস হইতেছে না? ঠিক আছে, আর বোঝা লাগব না, গেলাম আমি।
মেজাজ খারাপ করে বাসায় চলে আসছি। বাসায় আসার পর থেকে সুজনা কল দিতে শুরু করছে। আমি ঠিক করছি ২৪ঘন্টা পার না হলে আর ফোন রিসিভ করব না।
ফোন ঘরে রেখে ছাদে গিয়ে আকাশ দেখতেছি। আকাশ দেখতে দেখতে আব্বা ফোন হাতে ছাদে এসে উপস্থিত। ছাদে এসেই তিনি বলতে শুরু করছে-
—ফোন ঘরে রাইখা ছাদে আইসা হাওয়া খাইতেছিস, কলের জ্বালায় তো আর ঘরে থাকা যাইতেছে না।
—(সুজনা ছাড়া আর কে কল করবে) বলে দাও আমি বাসায় নাই।
—জানস কে কল করছে??
—কে?
—বেলী নামের কোন একটা মাইয়া, কি ভাষায় যে কথা কইল, কিচ্ছু বুঝলাম না। কি সব মাইয়াদের সাথে মেশা শুরু করছস?
—(নিশ্চয়ই সুজনা বেলীকে আমার ফোন নম্বর দিয়ে ইন্ধন যোগাচ্ছে) আরে নাহ রং নম্বর।
—ওই রং নম্বর হইলে তর নাম জানে কেমনে? যাই হোক বাপ এমন কাউরে বিয়া কইরা আনিস না যার ভাষা বুঝমু না।
ফোন হাতে দিয়ে আব্বা চলে গেল। মেজাজটা এমন বিগড়ে গেছে সুজনার উপর, এমনিতেই বাড়ির কাজের মেয়েকে চিঠি দিয়ে মনে মনে অপমানবোধ করছি, পৃথিবীতে এত নাম থাকতে সুজনাদের বাড়ির কাজের মেয়ের নামই বেলী হতে হলো, ভুল হয়েছে হয়েছে কিন্তু সুজনা যা শুরু করেছে তাতে আর চুপ করে থাকা যায় না।
সুজনাকে কল করলাম। ফোন রিসিভ করে কি সব বলতে শুরু করল কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সুজনা ইচ্ছা করে বেলীকে দিয়ে ফোন ধরিয়েছে, রাগের মাথায় বললাম-
—ওই কি বলতেছেন এইসব? ভাল করে কথা বলেন।
—খিতা খোবাম, তুই খইলাও।
—মানে কি? বললাম না ভাল করে কথা বলতে? কে আপনি?
—বেলী খই, বেলী।
—ওই ফাইজলামী করেন? আপনে ফোন ধরছেন কেন? সুজনারে দেন।
—খা, বেলী ভাল্লায়নো?
—ধুত তারিকার কোন পাগলের পাল্লায় পরলাম, আল্লাহই জানে।
লাইনটা কেটে দিয়ে ফোনটা আছাড় মারতে গিয়েও মারলাম না। এমন রাগ উঠছিলো, তীব্র মাত্রায় রাগ উঠলে আমি ছাদের এপাশ থেকে ওপাশ হাটাহাটি করি, ফোন পকেটে রেখে হাটতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পরই সুজনার নম্বর থেকে কল এলো। ফোন ধরলাম, ওপাশ থেকে আবারও কিছু অদ্ভুত শব্দ আসতে থাকল-
—খিতা খরোরে?
—ওই আপনারে না বলছি ভাল করে কথা বলতে?
—খিতা খোবাম, তুই খইলাও।
—ধ্যাৎ তারিকার, ওই আর কল করবিনা আমারে।
লাইনটা কেটে দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় সুজনা কথা বলতে শুরু করল-
—কেন চিঠিতে না বেলী বলছ ভালোবেসে? এখন বেলীর কথা ভাল লাগে না?
—তুমি কাজের মেয়েরে ফোন ধরায়া দিছো কেন?
—ওইটা কাজের মেয়ে বেলী না, ওইটা তোমারই বেলী ছিলো।
—কিহ?
—জ্বী।
—তুমি এইসব কথা কোত্থেকে শিখলা?
—কেন বেলী আছে না বেলী?