অনেক জ্বালিয়েছো আমায়। এবার একটু মুক্তি দিতে পারো?
খুব আর্তনাদ করে তনয় কথা গুলো আমার সামনে বলে দিলো৷ প্রায় হাত জোর করে বলছিল। বুঝতে পারছিলাম না, সম্পর্কের ৬ বছর পর হঠাৎ আজ এই ভাবে এই কথা বলছে কেন? বার বার বলছি, তনয় একটু থামো। মাথা টা ঠিক করো। শান্ত হও।
কিন্তু না, কিছুই হচ্ছে না। সব সম্পর্কের মত তো আমাদের সম্পর্ক নয়। তাহলে আমি কি এমন করলাম, যার জন্য সে মুক্তি চাচ্ছে! আমি এক রকম হতবাক হয়ে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি৷ সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ৩৫ মিনিট। হঠাৎ করে ৭ টা বাজে কল দিয়ে বাইরে আসতে বললো। তখন বাবার জন্য চা বানাচ্ছিলাম। তনয় কখনোই ওভাবে ইমার্জেন্সী হয়ে ডাকে নি। আজ ডাকার সুর টাই যেন কেমন ছিল। খুব তাড়াহুড়ো করে বের হই। ভাবলাম কোনো বিপদ হলো না তো! প্রচণ্ড ভালোবাসি তনয় কে। তা সে ভালো করে জানে। সম্পর্ক টা ছিল বিশ্বাসের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এক চিলতে মিথ্যে ছিল না। ছিল না স্বার্থপরতা। আমার তাড়াহুড়ো দেখে বাবা বলেই উঠলো, কি রে মা এতো সন্ধ্যায় জাচ্ছিস কই? আমি ব্যাগ টা হাতে নিয়ে বললাম, বাবা একটু বাইরে যাচ্ছি। তুমি চা টা খেয়ে নাও আমি এক্ষুনি চলে আসবো। পায়ের জুতো টা পড়ছিলাম, জলদি কাজের সময় আরেক পায়ের জুতো পাচ্ছি না।
সেটা খুজতে খুজতে গেলো দেরি হয়ে। ওহ এক বাটি পায়েশ ফ্রিজে রেখেছিলাম তনয় কে দিবো বলে, খুব পছন্দের খাবার ওর। তাও ব্যাগে করে নিলাম। যতবার দেখা করতাম ততবার ওর জন্য এটা সেটা রান্না করে নিয়ে যেতাম। খুব মজা করে খেত। আর আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর মিটমিট করে হেসে বলতো, এই না হলে আমার প্রিয়তমা। এমন কয়জনের ভাগ্যে জোটে। হাত পুরিয়ে এতো কষ্ট করে রান্না করে নিয়ে আসে! তনয়ের মুখে প্রিয়তমা ডাক টা বেশ ভালো লাগে। ও যখন আমার হাতের রান্না করা খাবার গুলো খায় আমার তখন মনে হয় আমি সবচেয়ে সুখি মানুষ। সব সময় রান্নার প্রশংসা করতো। ঢাকায় একা থাকে, একটা ব্যাচেলর বাসায়। কি খায় না খায় আল্লাহ জানে। তাই দেখা হলে কিছু না কিছু নিয়ে যেতাম।
কত দেরি হয়ে যাচ্ছে! এদিকে তনয় দাঁড়িয়ে আছে, বাসার পিছন দিকের রাস্তার পাশে।
দেখা হওয়া মাত্র খুব উৎসাহের সাথে বলতে নিয়েছি! তনয়, এক বাটি….
ঠিক তখনই তনয় বললো, “আমায় একটু মুক্তি দিতে পারো!”
আমায় বলেই সে হাত দিয়ে চোখ টা মুছে জোরেসোরে হাটা শুরু করে। এতো ডাকছি৷ শুনছেই না। প্রায় হাপিয়ে গেছি। করবো টা কি? যার মন খারাপ থাকলে আমার অস্থিরতা তৈরি হয়। সে আজ কাদো কাদো চোখে বলে গেলো মুক্তি দিতে। আমি না হয় দিলাম, সে কি পারবে আমায় ভুলে থাকতে? আচ্ছা যাক, চলে এলাম বাসায়। পায়েশের বাটি টা বের করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। অনেক গুলো কল দিলাম। ধরছেই না।
সেদিনই তনয় কোথায় যে গেলো আর জানতে পারি নি। কত কথা জমা হয়েছিল বলার আর সুযোগ পেলাম না। অনেক খোঁজ করেছি, সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল।।ওর বন্ধুর কাছে পাগলের মত খোঁজ জানতে চাইলাম। পাই নি। আচ্ছা! সে যদি চলে গিয়ে ভুলে থাকতে পারে তবে আমি কেন পারবো না! প্রতিবছর ওর জন্মদিনে একটা করে সারপ্রাইজ দিতাম। খুব খুশি হতো। খুশিতে জড়িয়ে ধরে কাদতো। এবছর দিবো বলে সব কিছু রেডি ছিল। মাঝ দিয়ে তনয় কে আর পাওয়া যায় নি।
আজ ৬ বছর পর আবারও তনয়ের সাথে দেখা! এই বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে। আমার ছোট্ট মেয়েটা যখন তনয়ের শার্ট ধরে টানছিল, আর বলছিল, “আংকেল আমায় ওই খেলনা টা নামিয়ে দিবেন একটু?” তনয় তখন আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, হাটুগেরে বসে বলছিল, মামনি কার সাথে এসেছো?. আব্বু আম্মু আছে আশেপাশে?
–আম্মু এসছে। কিন্তু ওই দিকে আছে। সে খুব ব্যস্ত। আমি তো ছোট তাই খেলনা টা নামাতে পারছি না।
খুব রসিকতার সাথে মেয়ে কে খেলনা দেখাচ্ছে। আমি খুজতে খুজতে পাচ্ছিলাম না। মেয়ের নাম ধরে ডাকতেই সারা দিলো, মামনি আমি এখানে।
এসে দেখি তনয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তনয় আমায় দেখে হতবাক হয়ে গেছে। আমিও চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আজ তনয়ের সাথে আবার দেখা হবে। এক পর্যায় অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকি। অনেক পরিবর্তন হয়েছে তনয়ের। আমায়, ডাক দিলো ‘ইরা! তুমি? এটা তোমার মেয়ে!
–হ্যা, আমার মেয়ে ঝুমু। খেলনা কিনতে এসেছিলাম। আর এখানেই তোমায় সে পায়।
তনয় আমার কিছু কথা ছিল শুনবে?
তনয় আমার দিকে তাকাতে পারছে না, চোখ গুলো ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরবে। আমার ভিতর টা ছটফট করে যাচ্ছে। আজ কয়েকবছর পর তনয় কে দেখলাম, তার কণ্ঠে আমার নাম ধরে ডাকা শুনলাম।
বার বার বলছিলাম, তনয় একটা বার আমার কথা শুনো। একটা বার! আমার বাসা বেশি দূরে নয়, এই তো কাছেই। আমি শুধু একটু কথা বলতে চাই।
আমার অনুরোধে তনয় আমার বাসায় আসে। চুপচাপ বসে আছে। এই কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মেয়ের সাথে খুব ভাব জমা হয়েছে তার।
গতকাল রাতে, ঝুমুর বাবার জন্য পায়েশ রান্না করি। ফ্রিজে রেখেছিলাম, কিন্তু তার নাকি পছন্দের নয়। আমার মেয়েটা বেশ পায়েশ খেতে পছন্দ করে। অন্য সব কিছুর সাথে এক বাটি পায়েশ তনয়ের সামনে দেই, সে বাচ্চাদের মত খুশি হয়ে গপাগপ খেয়ে নিলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে সে খাচ্ছে, আর বলছে খুব স্বাদ হয়েছে। কত বছর পর খেলাম।
–তনয়?
–বলো কি জন্য ডাকলে?
–সেদিনের পর থেকে তোমায় অনেক খুজেছি। পাই নি। তোমার নাম্বার গুলো বন্ধ পেয়েছি। আর আমার সেই আগের নাম্বার টা এখনো খোলা রেখেছিলাম। যদি একটা কল আসে! কত মেসেজ দিয়েছি নাম্বারে।
তনয় চুপ করে বসে আছে, কিছুই বলছে না। পকেট থেকে পুরনো সিম কার্ড বের করে অন করতেই টুংটাং মেসেজের শব্দ ছিল।
আমার সামনে বসেই মেসেজ গুলো পড়ে যাচ্ছে । প্রতিবছর জন্মদিনের শুভেচ্ছে, এটা সেটা বলা। যেন আর শেষ হওয়ার নয়।
আমার গলা টা শুকিয়ে যাচ্ছিল প্রায়।
তনয় ফোন টা রেখে ঝুমুর দিকে তাকিয়ে বললো,
–মেয়ে টা অনেক কিউট হয়েছে। আর খুব দুষ্ট।
আমায় কিছুক্ষনের মধ্যে তার বন্ধু বানিয়ে ছাড়লো।
আর তোমার মত মিষ্টি হয়েছে ইরা! যাই হোক পায়েশ টা খুব মজার ছিল। অনেক বছর পর খেলাম। দেখে ভালো লাগছে তুমি ভালো আছো।
— এতো কিছু জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দিলে না?
— সেদিন চলে না গেলে আজ হয়তো তোমার সুখের রাজ্য টা দেখতে পেতাম না।
— আমি তো তোমায় পেয়ে ও সুখি হতাম। তবে হ্যা, যে মানুষটাকে পেয়েছি সে অনেক ভালো। কিন্তু তোমার মত প্রিয়তমা বলে ডাকে না, আমার হাতের সব রান্না পছন্দ করলেও তোমার মত পায়েশ তার পছন্দের নয়। আমার কি কিছু ভুল ছিল তনয়? যার জন্য কিছু না বলে মুক্তি চেয়ে চলে গেলে!
— ৬ টা বছরে আমি কোন ভালো অবস্থায় যেতে পারি নি। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে যত টা আগলে রেখেছিলে তত টা কেউ রাখে নি। কিন্তু দিন শেষে রাত পোহালে আমি একা! আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল নিজের জীবন টা অভিশপ্ত। সাথে তোমার জীবন টাও নষ্ট হতে যাচ্ছিল। অনেক কিছু করেছো। তার ঋণ শোধ করার মত ছিল না। তোমার বাসায় বিয়ের কথা চলতো। কোন মুখে যেয়ে তোমার পরিবারের সামনে দাড়াতাম বলতে পারো ইরা! তাই সব ভেবে চলে গেছি। আজ আমার সব আছে, কিন্তু তুমি নেই। কিন্তু তুমি ভালো আছো তা দেখেই ভালো লাগছে। ভালো থেকো।
কথা টি বলেই তনয় উঠে গেলো। দরজার পাশে এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ! দেখছিলাম, মানুষ টা আগের মতই আছে!