সীমাবদ্ধ

সীমাবদ্ধ

আলো আঁধারি পরিবেশ, নীল লাল আলোর ঝলকানি, কোথাও বাড়ছে, কোথাও কমছে। টেবিল গুলো সব কানায় কানায় পূর্ণ। উপচে পড়ছে যৌবনের অনিয়ন্ত্রিত উচ্ছাস। গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা গাউন পরিহিত মেয়েটি বসে আছে পাবের এক কোণে, দু চোখে ভয়, উৎকণ্ঠা। মাথায় সাদা একধরনের বিশেষ টুপি, অনেকটা চার্চের সন্ন্যাসিনীদের মত। হাবেভাবে যেনো অপেক্ষারত, ক্ষণিকের বিলম্বই যেনো বছরের হিসাব।

পুরো পাব এর চারদিক খুঁজে, শেষে এক অন্ধকার কোণে চোখ পরলো সাইমনের, কেটি বসে আছে হাত দুটো জড়ো করে, অনুসন্ধিৎসু চোখে। মুখে ছুঁয়ে থাকা সামান্য বিরক্তি, আলগা হাসিতে চাপা। বোধ হয় অনেকক্ষণ বসে বেচারি, সাইমনের জন্য। দুদিন হলো আলাপ সাইমনের সঙ্গে কেটির। প্রথম দর্শনেই খুব অন্যরকম লেগেছিল মেয়েটিকে, পেনসিলভেনিয়া র একটা পার্কে। জুলাই মাসের চূড়ান্ত গরমে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাপড়ে মুড়ে মেয়েটা ভীষণ সন্তর্পনে হেঁটে হেঁটে দেখছে পার্কের এমাথা থেকে ওমাথা। ছোটো ছোটো পোশাক পরিহিত আমেরিকান ছেলেমেয়েদের দিকে চরম বিস্ময়ে তাকাচ্ছে আর মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে লজ্জায়।

তার চেয়েও অবাক হচ্ছে প্রেমিক প্রেমিকাদের গাঢ় চুম্বন আর শারীরিক ঘনিষ্ঠতা দেখে। সাইমন সেদিন পার্কে গাছের ছায়ায় বসে মনোনিবেশ করেছিল একটা বই তে। কেটির আচরণ আর পোশাক, বই এ বেশিক্ষণ মন বসাতে দেয়নি। সাইমন নিউ ইয়র্ক এর ছেলে। গরমের ছুটিতে বেড়াতে গেছিল কাকার বাড়িতে। ও কলেজে পড়ে, লাজুক প্রকৃতির। তথাকথিত আমেরিকার বড়ো শহরের তরুণদের মত পার্টি, হই হই পছন্দ করেনা তেমন। বন্ধু বান্ধব বেশি নেই, বিশেষ বান্ধবীও নেই। একাই বসে সেদিন খেয়াল করছিল মেয়েটার হাবভাব। খুব উৎসাহিত হয়ে নিজের থেকেই যেচে আলাপ করেছিল কেটির সঙ্গে। কেটি জানিয়েছিল, যে ওরা আসলে সুইস – জার্মান, “অ্যামিশ” বলে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের। পেনসিলভেনিয়ার ল্যাঙ্কষ্টারে কয়েকশ একর জায়গা জুড়ে ওদের গ্রাম, ওদের কলোনি। অ্যামিশ রা সাধারণ আমেরিকান দের মত জীবন ধারণ করেনা, খুব গোঁড়া ও বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়, নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। আমেরিকা তে জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশুনো সব হলেও, এই সম্প্রদায়ের কথা কখনও সেভাবে শোনেনি সাইমন। এদের সংস্কারের বিষয়ে কোথাও সেভাবে আলোচনাও হয়না।

কেটিরও বেশ লাগে, আপাত উশৃঙ্খল আমেরিকান যুবসমাজের মধ্যে একজন শান্ত, ভদ্র, মার্জিত ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পেরে। সেদিন অনেকক্ষণ পর্যন্ত দুজনে পার্কে বসে গল্প করেছিল। সেদিন ও শুধুই শুনেছিল সাইমনের কথা। সাইমনের বাড়ি, ওর শহর নিউ ইয়র্ক এর কথা, আকাশ ঢাকা কংক্রিটের জঙ্গলের কথা, ব্যস্ততম শহরের কথা, যে নাকি কখনও ঘুমোয় না!

সাইমনের মত কেটি ও খুব উৎসাহ পেয়েছিল ওর নতুন এবং ওদের সমাজের বাইরের একমাত্র বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাতে। অ্যামিশ দের মত সীমাবদ্ধ সমাজের মানুষদের, বাইরের জগতে সমস্যা হলো গ্রহণ যোগ্যতা। বাইরের জগতের মানুষ এদের সহজে গ্রহণ করতে পারেনা আর পারলেও এদের সঙ্গে অবাঞ্ছিত দের মত ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে কখনও যেমন দায়ী এই সম্প্রদায়ের মানুষদের গোড়ামি, অদ্ভূত রীতি নীতি, সংকীর্ণতা; আবার কোথাও দায়ী শহুরে মানুষ গুলোর অনমনীয়, উন্নাসিক মনোভাব। সেকারনে এদের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমবর্ধমান। সাইমন এমনই এক ছেলে, যে কেটির সঙ্গে মিশেছে মন উজাড় করে, প্রাণ খুলে, কেটির মত করে। তাই প্রথম দিন পার্কে আলাপের পর ওরা পরেরদিন আবার একটা অন্য পার্কে যাওয়ার মনস্থির করে, যেখানে বিভিন্ন রকমের নাগরদোলা, নানান খাবার দোকানের সারি। সারাটাদিন ওদের ওখানেই কেটে যায় প্রাণ খুলে আনন্দে, হাসিতে। সেভাবে নিজেদের কথা বলার কোনো সময় ই হয়নি ওদের। তৃতীয় দর্শন আজ পেনসিলভেনিয়ার একটা পাবে। সাইমন ইচ্ছে করেই আজ আসতে বলেছিল কেটি কে এই পাবে। সাইমন চায় বিভিন্ন ধরনের বাইরের জগতের সঙ্গে কেটির পরিচয় করাতে। প্রথম দিন কথা প্রসঙ্গে কেটি জানিয়েছিল যে, রমস্পৃঙ্গা (rumspringa) বলে একটা বিশেষ ব্যাবস্থার মধ্যে ও আছে। এটি ওদের অ্যামিশ সংস্কারের এক বিশেষ অধ্যায়। এতে নাকি যখন ছেলেমেয়েদের ১৬ বছর বয়েস হয় তখন ওদের আবদ্ধ সমাজের বাইরে পাঠানো হয়, বাইরের জগতের সবরকম প্রলোভন যেমন নেশা, জুয়া, প্রেম, পার্টি এইসব আপাত চাকচিক্য তে গা ভাসিয়ে শেষে বেছে নিতে, হয় বাইরের জগৎ না হয় নিজেদের শিকড় অ্যামিশ সম্প্রদায়। কেটির ও ষোলো পেরিয়েছে, সেই হিসাবেই এখন ওদের পৃথিবীর বাইরে এক অন্য পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছে।

“অনেকক্ষণ নাকি কেটি? দুঃখিত, একটু দেরি হয়ে গেল। তো এত অন্ধকারে এসে বসে আছো কেনো?”

“না বেশীক্ষণ নয়। আর কোথাও তেমন জায়গা ছিলোনা। আর থাকলেও আমার অত আলো সহ্য হয়না, আওয়াজও। আসলে অভ্যাস নেই তো।”

“আলো সহ্য হয়না মানে? বলো এত আলোর ঝলকানি চোখে লাগছে, সে হতেই পারে।”

“না সাইমন, আমাদের ঘরে তো আলো জ্বলেনা, নিয়ন আলো দেখার কোনো অভ্যাস নেই আমার!”

“দাঁড়াও দাঁড়াও, কি বলছো? ঘরে আলো নেই মানে?”

“হ্যাঁ, আমাদের সমাজে কোনোরকম বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার নেই।শুধু আলো কেনো, কোনোরকম বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি নিষিদ্ধ। তাই ঝলকানি তো দূর, এমন আলোই কখনও দেখিনি।”

“চলে কিভাবে? আমি তো অবাক হচ্ছি। তুমি ঠাট্টা করছো নাতো?”

“না, বাইবেলের ১২:২ নম্বর অংশে আছে কৃত্রিম বিদ্যুতের ব্যবহার মানে বাইরের পৃথিবী কে আপন করা। ঈশ্বর যেভাবে আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমরা যেন সেভাবেই থাকি প্রাকৃতিক আলো হাওয়া, শক্তি ব্যবহার করে। বৈদ্যুতিক জিনিস যত আমরা ব্যবহার করবো তত আমাদের নিজেদের ক্ষমতা এবং একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীলতা কমে যাবে। তাতে সামাজিক ঐক্য নষ্ট হবে, বন্ধন অটুট থাকবেনা। এই আমাদের সমাজের সংস্কার।”

“বাপরে, বলো কি! তোমাদের ধর্ম কি? খ্রীষ্টান তো তোমরা কেটি?”

“হ্যাঁ, তবে একটা বিশেষ ভাগ আমাদের। ষোড়শ শতকে, আনাবাপটিস্ট (Anabaptists) নেতা জ্যাকব আমান এই মতবাদের প্রবর্তন করেন। তার নামের সঙ্গে মিলিয়েই আমাদের সম্প্রদায়ের নাম অ্যামিশ। আমাদের মতবাদের প্রধান মন্ত্র : বাইরের পৃথিবীর থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ভাবে সরল জীবন যাপন। আমাদের ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ, কোনোরকম ধর্মীও সভা, জাঁকজমক কিছুই নেই।”

“আনাবাপটিস্ট এর কথা শুনলাম মনে হলো, তার মানে তোমরা দীক্ষিত (baptised) নও?”

“না তো, তোমাদের মত ছোট্ট বয়েসে আমাদের দীক্ষা দেওয়া হয়না। আমাদের সংস্কার বলে, দীক্ষা যেমন দেওয়ার বয়েস আছে, তেমন তার ওজন বোঝার বা বহন করার প্রকৃত সময় ও বয়েস আছে। তাই একজনের ১৬ বছর বয়েসে রম্পসৃঙা র পর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ঠিক করে যে তার দীক্ষিত হওয়ার সময় এসেছে কিনা। যদি সে পূর্ণ মাত্রায় সমাজে প্রত্যাবর্তন করে বাইরের জগৎ থেকে, তবেই তার দীক্ষা হতে পারে।এর পর সে আর কোনোদিন বাইরের জগৎ এ মেশে না”

“আচ্ছা, সেতো বুঝলাম। কিন্তু এই যুগে বিদ্যুৎ ছাড়া চলে কিভাবে? কম্পিউটার, ইন্টারনেট ছাড়া পড়াশুনো করাও দুষ্কর। প্রয়োজনীয় মেল কিভাবে করো তোমরা কেটি?”

“এটা মজার প্রশ্ন।সাইমন তুমি দেখছি আমাদের, অ্যামিশ দের ব্যাপারে কিছুই জানো না।কি অদ্ভুত, একই দেশে থাকি অথচ আমাদের গল্প কোথাও শোননি? আমরা যেটুকু পড়াশুনো করি, তাতে ইন্টারনেট, কম্পিউটার কেনো ক্যালকুলেটর ও লাগেনা। আমাদের বিদ্যার দৌড় ক্লাস ৮ পর্যন্ত। তবেই বলো..মেল করবো কাকে? আর বিদ্যুতের ব্যবহার না থাকায় সুবিধে কোথায় জানো লোডশেডিং এর ভয় নেই। বিদ্যুৎ অপরিহার্য নয় বলে, ঝড়, জল দৈনন্দিন জীবনে আমাদের সেভাবে প্রভাবিত করেনা, কারণ প্রকৃতির মধ্যেই বড়ো হই, যেকোনো দুর্যোগ আমরা সহজেই সামলে নিই।”

“আমি আর নিতে পারছিনা। তোমরা ক্লাস ৮ এ পড়াশুনো শেষ করে দাও। ওইটুকু পড়ে কার কি হয়? এ যুগে তো এক্কেবারে অচল!”

“অচল ভাবলেই অচল। আমাদের সংস্কার মনে করে একটি ছেলে ১৬ বছর বয়েসী হলে পর তার প্রধান কাজ সংসারের দেখভাল, বাবা কে পরিবার প্রতিপালনে সাহায্য করা । চাষবাস, বা অন্য রোজগারের ব্যবস্থা করা, যদিও সেটা আমাদের সীমানার মধ্যেই। আর ওই বয়েসে একটি মেয়ের কাজ পুরোটাই সংসারে। প্রথমে তার মা কে সাহায্য করা, তার পর বিয়ে হলে স্বামীর ঘরে নিপাট গৃহবধূ হয়ে থেকে সংসার ধর্ম পালন। আর এই দুটির জন্যই ক্লাস ৮ পর্যন্ত শিক্ষা যথেষ্ট।
আর এই যুগ…আমাদের সমাজে যুগের কোনো পরিবর্তন হয়না সাইমন। একটাই যুগ আমাদের, যেটা চলে আসছে, চলবে চিরন্তন।”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো কেটি, যদি কিছু মনে না কর?”

“নিশ্চই, বলোনা, তুমি তো বন্ধু আমার।”

“তুমি এইরকম নান দের মত বেশ করে থাকো কেনো? আগের দুদিন ই দেখলাম তুমি একই পোশাকে, তাই কৌতূহল হলো। গলা থেকে পা পর্যন্ত মোটা এক রঙা একটা গাউন, মাথায় নার্স দের মত টুপি। যেখানে এই গরমে, সাধারণ মেয়েরা রীতিমত খোলামেলা পোশাকে, সেখানে তুমি… এও কি তোমাদের সংস্কার?”

“ঠিক ধরেছো, যেরকম খোলামেলা পোশাক এখানে মানুষ পড়ে, আমাদের সমাজে এমন পোশাক কোনো বয়েসের কোনো মেয়েই কল্পনা করতে পারেনা।
বিয়ের আগে মাথায় সাদা আর পরে কালো স্কার্ফ পড়ার রীতি আমাদের মহিলাদের। আর পোশাক, সেতো হয় ফুল স্লিভ গাউন নয় ফুল হাতা জামা, আর হাঁটুর নিচ হতে মাটি পর্যন্ত যে কোনো উচ্চতার স্কার্ট। চামড়া দেখানোর জো নেই…!”

“এত পুরো কস্টিউম এর মত, একঘেঁয়ে লাগেনা!”

“কিচ্ছু করার নেই সাইমন। এটাই আমাদের সংস্কার, আমাদের একান্ত আমাদের সভ্যতা, আমাদের আভিজাত্য এতেই। আমরা বিশ্বাস করি, এমন পোশাক আমাদের কস্টিউম নয়, বরঞ্চ আমাদের রীতি র প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভরসা আর বিশ্বাস প্রদর্শন, বাইরের পৃথিবীর থেকে যে আমরা আলাদা সেটা প্রতিষ্ঠা করা।”

“আর ছেলেদের, তাদের কিছু নেই বিশেষত্ব?”

“আছে বৈকি, বিবাহিত ছেলেদের দাড়ি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু গোঁফ এক্কেবারে নিষিদ্ধ। তাছাড়াও কালো বা সাদা রঙের ছোট বড়ো বিভিন্ন আকারের টুপি পরা টা আমাদের প্রচলন।

“সব তো বুঝলাম, কিন্তু গোঁফ এর ব্যাপারটি কি হলো, রাখা চলবেনা কেন?”

“আমাদের ধর্মে হিংসা, লড়াই ভীষণভাবে বিরোধী। সে জন্য আমাদের ছেলেরা সেনাবাহিনী তে চাকরি নেয়না। আমাদের সমাজে কোনো পুলিশ নেই, কারণ কোনো চুরি নেই, ডাকাতি নেই, সমাজবিরোধী কাজকর্ম নেই, তাই প্রশাসনের বালাই নেই। সমাজের যে কোনো স্তরেই, আমরা অন্যায় করলে আমাদের বড়রা আমাদের শাসন করে। ”

“কিন্তু এসবের সঙ্গে গোঁফ টা ঠিক মিলল না…”

“ওহো, কথায় কথায় ভুলেছি, আমাদের সম্প্রদায়ে গোঁফ হলো সেনাদলের প্রতীক, তাই গোঁফ রাখা চলবেনা। বুঝলে এবার?”

“হুম..তোমার ছুটি কতদিনের? কবে ফিরে যাবে আবার তোমাদের জগতে, যদি তুমি আদৌ ফিরতে চাও তো…!”

“সাতদিনের, আর দুদিন আছি। ফিরে যাবো তো বটেই, এখনও পর্যন্ত হয়তো তেমন কিছুই পাইনি তোমাদের পৃথিবীতে, যেটা আমায় ফিরে যাওয়ার থেকে বিরত করতে পারে। আর যদি না ফিরি এখন..পরে হয়তো চাইলেও আর পারবোনা।”

“হয়তো মানে?”

“কিছুনা, সাইমন… এমনি বললাম।”

“তোমার বাড়ি, তোমার পরিবার, যখন ইচ্ছে ফিরতে পারবেনা কেনো?”

“আমাদের ordung এ নেই। একবার যদি তুমি স্বেচ্ছায় গোষ্ঠী থেকে বেড়িয়ে যাও, তাহলে আবার ফিরতে গেলে তোমায় আমাদের প্রধানের কাছে প্রার্থনা করতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে আরও কতকি।”

“তাহলে আর কি, চলো শেষ বেলায় একটু আনন্দ করে নিই, এত সুন্দর গান হচ্ছে, মিউজিক হচ্ছে, একটু নাচবে নাকি আমার সঙ্গে? আশা করি নাচ গানের নিয়ম আছে? আর এখানে দেখছেই বা কে! ”

“দেখবেনা কেউ ঠিকই, তবে সংযম টা তোমার নিজের। আমাদের গোষ্ঠী তে গান, বাজনা, যন্ত্রসঙ্গীত সব নিষিদ্ধ। যন্ত্র সঙ্গীত পার্থিব জিনিস। আর পার্থিব যেকোনো জিনিস আমাদের “গেলেশেনহাইট” (gelessenheit) এর পরিপন্থী।”

“গেলেশেনহাইট!!! সেটা কি?”

“ওহ, ওটা জার্মান শব্দ, খ্রীষ্টান ধর্মে কথিত আছে, ঈশ্বর যেভাবে পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন, সেখানে সঙ্গীত মানুষের অনুভূতি কে, স্থির সত্ত্বা কে, নাড়িয়ে দেবে, চঞ্চল করে দেবে। মানুষ স্থিতিশীলতা থেকে সরে আসবে। তবে আমি যাবো নাচতে… নিয়ম ভাঙতেই তো আমি এসেছি, আর আমায় দেখছে কে!”

প্রথম প্রথম কেটির সাইমনের শরীরের কাছাকাছি এসে নাচতে একটু সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। উদ্দাম মিউজিক, আলো আঁধারির ঝলকানি একে অপরের কোমর জড়িয়ে ধরে হাজার যুবক যুবতীর ভিড়ে। ক্ষণিকের জন্য হলেও ওরা হারিয়ে যায় দুজনের দুই আলাদা পৃথিবীর মাঝের এক স্বাধীন জগতে, সুরার নেশায় মিশে, রিমিক্স গানের তালে, ছন্দে, হেলে দুলে। সেদিনের মত ওরা ফিরে যায় একে অপরের বাড়ি। ঠিক করে আবার দেখা করবে ওরা ডিনারে মাঝে একদিন ছেড়ে, শেষ বারের মত, যে যার নিজের দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার আগে।

“কেমন কাটল গতকাল, কি করলে সারাদিন কেটি?”

“তোমায় কিছু বলার আছে আমার সাইমন, গতকাল সারাদিন ধরে খালি নিজের সঙ্গে টানাপোড়েন চালিয়েছি। মীমাংসা করতে পারিনি, তোমার সাহায্য ছাড়া পারবও না।”

“বলো…তবে তার আগে চলো কোনো এক রেস্তোরাঁ তে যাই, খিদেতে কঠিন অবস্থা!”

“বেশ, তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে সাইমন? নিশ্চই আছে, তোমাদের জগতে তো তোমার বয়সি একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড নেই সেটা অসম্ভব।”

“না কেটি, নেই তবে হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“এমনই জিজ্ঞেস করলাম।”
রেস্তোরাঁতে খাওয়ার টেবিলে বসে, দুজনে নিভৃতে পরস্পরের মুখোমুখি।

“সেদিনও একটা অদ্ভুত কথা বললে, আজও জিজ্ঞেস করলে আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা। কিন্তু কারণ কিছুই বললেনা। কেন? তোমাদের সম্প্রদায়ে কি প্রেম করা মানা?”

” ঠিক মানা নয় তবে, আমাদের সম্প্রদায় খুব সীমাবদ্ধ নিজেদের মধ্যে। আমাদের সম্প্রদায়ের ছেলে রা আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যেই প্রেম করে, বিয়ে করে, তারা সম্পর্কে একে অপরের তুত ভাই বোন, মাসি, পিসি কাকা যা খুশি হতে পারে। আমাদের সমাজের বাইরে বিয়ে করা যায়না।”

“সেকি, বাইরের কারোর প্রেমে পড়লে? বিয়ে করলে কি হবে?”

“সমাজচ্যুত। সেকারণেই বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ থাকেনা। যদি এই ষোলো বছর বয়েসে কারোর সঙ্গে সম্পর্ক হয় তবে প্রথমেই সমাজ থেকে বেড়িয়ে যায়, আর ফেরেনা, কিন্তু একবার ফেরার পর আর কোনো সম্ভাবনাই থাকেনা। একবার আমাদের গ্রামের এক টুরিস্ট গাইড এক বাইরের মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, লুকিয়ে বিয়েও করে নিয়েছিল। কিন্তু জানাজানি হতে, শাস্তি “মাইডুং” (meidung)। এর ফলে ছেলেটি আর কোনোদিন সমাজে ফিরতে পারেনি। সমাজের সকলে ওর পাশে বসে খেতে, চার্চ এ প্রার্থনা করতে, অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করতে অস্বীকার করে। একেবারে ব্রাত্য।”

“কিন্তু কেটি এভাবে নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ে করে, বংশ বৃদ্ধি করলে তো তোমাদের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র আসবেনা, তুমি হয়ত বুঝবেনা কিন্তু জিন গত সমস্যা হতে পারে।”

“জিন কি জিনিস আমি জানিনা, তবে এটুকু জানি আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বংশ বৃদ্ধির। আমাদের সমাজে এক এক জনের ছয় থেকে সাত খানা করে বাচ্চা হয়। তবে শুনেছি একটা বিশেষ ধরনের অসুখ আছে আমাদের মধ্যে, যেটা কেবল আমাদেরই হয়।”

“সেটাই বলছিলাম, খুব সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে তোমাদের জিনগত বিন্যাস। যাইহোক, এটিই তোমাদের সংস্কার, তুমি আমি পাল্টাবার কেউ নয়। তে চেয়ে, আমাদের খাওয়া হলে চলো একটু বাইরে গিয়ে একসাথে হাঁটি, যাবে আমার সঙ্গে কেটি।”

কেটির সম্মতি নিয়ে ওরা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো সোজা ফুটপাত ধরে কখনও কাঁধে কাঁধ, কখনও হাতের পিঠের ঘষাঘষি। একপাশে ব্যস্ত গাড়ির রাস্তা আর অন্যপাশে সবুজ নরম জমি, যেটা নেমে গিয়ে মিশেছে সবুজ এক উপত্যকায়। কিছু যুবক যুবতী সেখানে বসে প্রেমালাপ এ মগ্ন, কিছু বাচ্চা ছুটোছুটি করে নিজদের খেলায় মেতে। পাখি গুলো উড়ে যাচ্ছে আবার এসে বসছে মাঠের মাঝে ছোট্ট জলাশয়ের ধার টায়, কে জানে কিসের টানে। রাত হয়ে আসছে, পড়ন্ত আলোয় ব্যস্ত শহরের বুকে এমন নির্জন স্থানে দুজনের একটু বসার ইচ্ছে হলো, আর বেশিক্ষণ নেই, বিদায়ের সময় আসন্ন।

“একটু বসলে হয়না, চলো না সাইমন।”

দুজনে একটু নিভৃতে পশ্চিমে ঢলে যাওয়া সূর্যের আলো মুখে মেখে বসলো। কেটির মুখে লালচে আলোর আভা, সাইমনের মুখে আবেশ। বেশ খানিকক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে কাটিয়ে দিল। কেটির হাতে ধরা লম্বা ঘাস ফুলের ডালের অন্য প্রান্ত সাইমনের হাতে ধরা, এভাবেই একে অন্য কে ছুঁয়ে রইল মনে, আপাত শরীরে। ওই কচি সবুজ ডাল ই যেনো ওদের দুই পৃথিবীর মধ্যের যোগসূত্র, মেল বন্ধন।

“নিশ্চয়, কি বলবে বলছিলে…”

“তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি আমি, কিন্তু জানি তা সম্ভব নয়। তোমার মত করে কেউ কোনোদিন মেশেনি আমার সঙ্গে, কথা বলেনি, জানতে চায়নি আমার কথা। আমাদের সমাজে ছেলেরা আমাদের তাদের সংসারের ভার চাপিয়ে ক্ষান্ত। ওরা মনে করে আমরা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার যন্ত্র। সারাদিন কাজের পর বাড়ী ফিরে ওদের একমাত্র বিনোদন বা ফুর্তি ওই সেক্স। আমি আমার মা, দিদি, মাসি এদের দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি এমন জীবন চাইনা। গতকাল নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি বিরত করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছুতেই তোমার থেকে নিজেকে ফেরাতে পারছিনা সাইমন!”

“আমারও তোমায় খুব ভালোলেগেছে কেটি, তোমার মধ্যে এক অদ্ভুত শুদ্ধতা আছে, সততা আছে যেটা আমায় খুব আকর্ষণ করে।
তোমাদের সমাজের ছেলেরা কি কাজ করে? সত্যি ওটাই ওদের একমাত্র বিনোদন!”

“আমাদের সমাজে টিভি নেই, সিনেমা নেই, মিউজিক নেই, তাই একমাত্র বিনোদন হলো গ্রামের সব ছেলে, বুড়ো মিলে মাঝে মধ্যেই কাঠের বড় বড় ব্রান (বিশেষ ধরনের বাড়ি) তৈরি আর কিচ্ছু নয়। ওই সময় ছেলেরা হই হই করে, বাড়ির মেয়েরা ঘরের খাবার বানিয়ে আনে যেটা সকলে মিলে ভাগ করে খায়। একটা পিকনিকের মত। ওটাই আনন্দ। বছরের পর বছর ধরে এই চলে আসছে।”

“কখনও কখনও তো তোমরা মুখ পাল্টাতে, লং ড্রাইভে ও যেতে পারো নিজের পরিবারের সঙ্গে। তাতে নিশ্চই আপত্তি নেই..?”

“হা হা! যেটা বললে, সেটার জন্য গাড়ি লাগে। মোটর চালিত গাড়ি। আরো অনেক কিছুর মত এটারও আমাদের সমাজে প্রচলন নেই। আমাদের যানবাহন বলতে, কেবল ঘোড়ায় টানা গাড়ি।”

“চাষবাস করো কিভাবে, মোটর ছাড়া? তারমানে সেটাও ঘোড়ায় টানা লাঙ্গল, ঘোড়ায় টানা জলের সেচ এইসব ব্যবহার করে, তাইতো ঠিক বলেছি?”

“একশো ভাগ ঠিক সাইমন। এইতো বুঝতে পারছ আমাদের সংস্কার। অ্যামিশ সংস্কার”

“কেটি, তোমরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করো না, গাড়ি ব্যবহার করো না, মানে পেট্রোল, ডিজেল কিচ্ছু না, সরকারি কাজ করোনা, তোমাদের সমাজের বাইরে বেরিয়ে সরকারি রাস্তা, জল কিচ্ছু ব্যবহার করো না, তো আমেরিকা তে থাকো, সরকার কে কর দাও?”

“দেশীও কর ছাড়া আর কোনো কর দিইনা আমরা। কেনো দেবো আমাদের খাবার, ভুট্টা, গম, যব, বার্লি, আলু, সব্জি আমরা নিজেরাই আমাদের জমিতে ফলাই, জল আমরা মাটি খুঁড়ে বের করি, আমাদের খামারের হাঁস, মুরগির ডিম, মাংস আমরা পেয়ে যাই, আর গরুর দুধ আমরাই দুয়ে নিই। তো আমেরিকা সরকারের কোনো সাহায্যর ই আমাদের প্রয়োজন নেই, তাই কর ও দিই না।”

“কিন্তু অসুখ করলে, বাচ্চা প্রসব করার সময়, ডাক্তার, হাসপাতাল? সেটা নিশ্চই সরকারি, কারণ তোমাদের মধ্যে ডাক্তার হওয়া তো সম্ভব নয়, ক্লাস ৮ পড়াশুনো করে!”

“কিছু পুরোনো পন্থী অ্যামিশ মানুষ এখনও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আপন করেনি, এরা ঘরের টোটকায় কাজ চালায়। আর বাচ্চা প্রসবের জন্য দাই তো আছেই। তবে নতুন পন্থী মানুষ মনে করে, ঈশ্বরের দেওয়া শরীর সুস্থ রাখা কর্তব্য। তাই এরা ডাক্তার দেখায়, হাসপাতালে যায়। পয়সা দিয়ে ডাক্তার দেখায়। আমাদের কোনো বীমা করা নেই, তোমাদের মত, কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই।”

“আমাদের কি হবে কেটি, তবে আমরা কি কোনোভাবেই মিলিত হতে পারবোনা?আমাদের পরস্পরের প্রতি এই অনুভব কি কেবল ভ্রূণ স্তরেই থেকে যাবে, ফোটানো কি সম্ভব নয় কিছুতেই?”

সাইমন, নিভৃতে কেটির হাত ধরে, জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে। কেটি ও শুরুতে কিঞ্চিৎ বাধা প্রদান করলেও, ক্ষণিকের ফারাকে নিজেকে সঁপে দেয় সাইমনের বাহুপাশে। ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে যায়, সাইমন, বাঁধা দেয় কেটি, দুজনের ঠোঁটের মাঝে হাতের বাঁধ নির্মাণ করে সজ্ঞানে।

“তুমি কেমন মিলনের কথা বলছো সাইমন? আমি সাত দিনের ছুটিতে পৃথিবী চিনতে বেরোলেও, আমার সংস্কার আমি এক লহমায় ভুলতে পারবোনা। আমাদের সমাজে, ছেলে মেয়েরা মিশতে পারে, প্রেম করতে পারে,কিন্তু সামাজিক বিয়ের আগে ছুঁতে পারেনা, চুম্বন তো ভুলেই যাও। আমি সেই সংস্কারে বড়ো হয়েছি সাইমন, ভালোবেসেছি তাই ছুঁতে পেরেছি, কিন্তু তার বেশী…একটু তো সময় লাগবে।”

“আমি দুঃখিত কেটি, আমি তোমার ভাবনায় আঘাত করতে চাইনি। এটা হয়তো বয়েসের, পারিপার্শ্বিকের দোষ। আমায় ক্ষমা করো। কিন্তু তোমাদের সমাজে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রেম করবে, না ছুঁয়ে এটা কি সম্ভব?”

“সমাজে কড়া নিয়ম থাকলেই সম্ভব, শাস্তির ভয় থাকলেই সম্ভব। যাই হোক, আমাদের সমাজে বিয়ের আগে, বিয়ের ঠিক হওয়া যুগলকে বেশ কিছুদিন এক ঘরে শুতে দেওয়া হয়, এক খাটে, একই চাদরের তলায়, কেবল দুজনের মাঝে একটা ছোটো কাঠের বেড়া থাকে। ওদের সারারাত গল্প করে কাটাতে হয়, না ছুঁয়ে। এটাই সংযমের পরীক্ষা। কিছু বেচাল হলেই কড়া শাস্তি। আর অদ্ভুত ব্যাপার কখনও কিছু বেচাল হয়ও না।”

“বিয়ের পর সব চলবে, তখন সাত টা আট খানা করে বাচ্চা করো, জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই, তাতে দোষ নেই… অদ্ভুত তো!”

“হম..এমনই। এমনকি আমাদের গোষ্ঠী তে বিয়ে হয় চার্চে, ধর্মীয় নেতার সামনে। স্বামী স্ত্রী একে অপরকে কে আংটি, ফুল কিচ্ছু দেয়না, কেবল শপথ পাঠ করে। আংটি, ফুল নাকি আমাদের রীতি তে অহংকার, বৈভব প্রদর্শন করে। তাই বন্ধ। আমাদের তো তোমাদের মত কোনো বিশেষ চার্চ ও নেই। চক্রাকারে এক মাসের, তিন মাসের জন্য এক এক পরিবারের ঘরেই চার্চ বসে । সেই মাসে, চার্চের, সব দায়িত্ব সেই পরিবারের।”

“এই নিয়ম টা ভালো।আমাদের চার্চের মত বিভ্রান্তিকর মতবাদ নেই, সহজ, এক মুখী, জাঁকজমক হীন ঈশ্বরের প্রার্থনা ঘর। এটা খুবই ভালো। ”

“যাক সাইমন, কিছুতো ভালো লাগলো তোমার আমাদের অ্যামিশ সংস্কারের!!”

“না, সত্যি বেশ কিছু সংস্কার, রীতি খুব সেকেলে, যুক্তিহীন, তবে এটাই তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের পরিচয়, যা তোমরা বহন করছো বিগত পাঁচশ বছর ধরে। আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রইলো তোমাদের প্রতি।
তবে, একটা জিনিস কে বললো ভালো লেগেছে, আর একটা জিনিস ও যে খুব ভালোলেগেছে, বরং বলতে পারো ভালোবেসে ফেলেছি…”

“কি সাইমন…?”

সাইমনের নীরব হাসি, কেটির কোলে মাথা রেখে। অন্ধকারে চোখের কোণে জলটা কেবল সাইমনের ই জানা। আর কেটির চোখের জল টা, ওর গাল গড়িয়ে সাইমনের চোখের ওপর পড়ার অপেক্ষা। সে কি সাইমন কে বিদায়ের নাকি অ্যামিশ সংস্কারের মধ্যে ফিরে যাওয়ার…! নোনা জলবিন্দু ই জানে তার গভীরতা, তার গোপনীয়তা।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত