নাঃ! ঝগড়া করে বেরিয়ে ঠিক করিনি। সন্ধে হয়ে আসছে, এদিকের রাস্তাঘাটও চিনি না তেমিন। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভ্যেসও নেই তেমন। মুশকিলে পড়লাম।
জায়গাটার নাম বনপাহাড়ি। পারফেক্ট নাম। বন, পাহাড় সবই আছে। লোকজন কমই থাকে এখানে। জায়গাটা এত সুন্দর হওয়া সত্বেও লোকজন এত কম থাকার কারণ হলো, এখানে প্রচুর সাপ। সব বিষধর। কিছু কিছু হোটেল আছে, ট্যুরিষ্ট আসে মাঝে মাঝে, তবে তাদের মধ্যেও সাপের কামড়ে মারা যাওয়ার খবর প্রচুর। সাপের ভয়ে অনেকেই আসতে চায় না এখানে। তবে আমার বাবা একটা পিকিউলিয়ার পিস। অগাধ টাকা, জীবনে টাকা ছাড়া আমাকে বা মাকে কিছু দিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এখানে বাংলো বানিয়ে মাঝে মাঝেই এখানে এসে থাকে বাবা। পেশা লেখালেখি। রাইটার বলেই যে এমন কিছু ভালো মানুষ তা কিন্তু না। বাবার মতো অত নিষ্ঠুর মানুষ খুব কম দেখেছি আমি। মায়ের জায়গায় আমি থাকলে কক্ষণো এত অত্যাচার, অবহেলা নিতে পারতাম না। যাই হোক, কলেজের পরীক্ষা শেষ বলে কাল বাবার কাছে বেড়াতে এসেছি। আসার ইচ্ছে খুব একটা ছিলো না, মা বললো তাই। বুঝতে পারিনা এত খারাপ ব্যবহার সত্বেও মা এখনো কী করে বাবাকে ভালোবাসে!
এখনো কী করে চিন্তা করে ওই লোকটার ব্যাপারে! বাবাকে যখন বললাম আমি আসবো, বাবা খুশিই হলো মনে হলো। তখনই বলে দিয়েছিলাম বাবার কুকুরগুলো যেন বাঁধা থাকে। হ্যাঁ, ওই একটা শখ বাবার। কোনো মিষ্টি লোমওয়ালা কুকুর না, বাবার কাছে বড় বড় অ্যালসেশিয়ান আছে গোটা চারেক। ভীষণ ভয় পাই আমি। একজনের নাম ডেভিল, একজনের নাম হেল, একজনের নাম স্যাটান, একজনের নাম লুসিফার। যেমন নাম, তেমনি চেহারা, তেমনি তাদের স্বভাব। কাল থেকে এসে অব্দি ওদের চেঁচামেচি শুনেছি অনেক। আজ দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভাঙলো হাড় হিম করা একটা ডাকে। বাবার স্যাটান ঠিক আমার দরজাতেই দাঁড়িয়ে। আর যাই কোথায়! সেই নিয়েই ঝগড়া। রাগ হয়ে গেলে মানুষ অনেক কথা বলে ফেলে। আমিও বলে ফেলেছি। বাবার উপর রাগ, কুকুরের জন্য ভয় সব মিলেমিশে বাবার সাথে ঝগড়া করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু এখন ভয় লাগছে। সন্ধে হতে যাচ্ছে, যদি ফিরতে না পারি! তার উপর এত সাপখোপের ভয় এখানে!
গাড়িটা ঘোরাতে হবে। জায়গা নেই ততটা। দাঁড় করালাম গাড়িটা। ফোন…ফোনে নেটওয়ার্ক আছে কি! গুগল ম্যাপ থেকে কি হেল্প হবে কিছু! গাড়ি থেকে নামলাম। চারদিক কী সুন্দর চুপচাপ। ভীষণ ভালো লাগছে। বরাবর শহরে থেকেছি। এত চুপচাপ পৃথিবী হতে পারে ভাবতেই পারি না আমি। দূরে একটা ঝর্ণা। কী সুন্দর। পাহাড় হলেও খুব একটা উঁচু নয় জায়গাটা। গরম বেশ ভালোই আছে। তবে হাওয়া দিচ্ছে এখন বেশ। সূর্যাস্তের অল্প অল্প আলো লেগে আছে এখনো। অদ্ভুত সুন্দর! আমি ছাড়া আর কেউ নেই। অবাক হয়ে দেখছি, হঠাৎ ফোঁস করে একটা শব্দে ঘুরে তাকালাম। সোনালী একটা বিদ্যুতের ঝলক লাগলো মনে হলো হঠাৎ। আমার সামনে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে একটা সাপ! সাপখোপ অতটা চিনিনা আমি। কিন্তু এটা যে নেহাত নিরীহ সাপ নয় তা এর চোখের দিকে দেখলেই বোঝা যায়। নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখের পলক ফেললেই মৃত্যু। আস্তে আস্তে বুজে আসছে চোখ। যে মুহুর্তে হার মানবো সেই মুহুর্তে মৃত্যু ছোবল মারবে। এক একটা সেকেণ্ড এক একটা বছর মনে হচ্ছে। আর কি কোনো উপায় নেই বাঁচার?
পেছনে একটা শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গেই মির্যাকলটা ঘটলো। সাপটা মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। তখনো বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠিনি, পেছন থেকে গম্ভীর গলায় কেউ বললো-” কে তুমি?”
চমকে তাকালাম পিছনে। বাবার বয়সী একটা লোক, গায়ে ময়লা একটা পাঞ্জাবী, হাতে একটা লাঠি।
-“আমার নাম তৃষা। এখানে বেড়াতে এসেছি। ”
-“বেড়াতে এসেছো তো এখানে কেন এসেছ? এতদূর তো কেউ আসে না!”
রাগ করে আবোলতাবোল গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছি তা তো বলা যাবে না। ভেবে বললাম-” আসলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। রাস্তা ছিলো, চালাতে চালাতে চলে এসেছি।”
-“ফিরে যাও। এখানে আর এসো না।”
-“আপনি? না মানে আপনি চাইলে আমি আপনাকে নামিয়ে দিতে পারি, আপনাকেও তো নামতে হবে! আমার গাড়িতেই আসতে পারেন!”
-পুরোপুরি যে লোকটার কথা ভেবে বলছি তা না, আমার নিজেরও স্বার্থ আছে। রাস্তাঘাট চিনি না তেমন। কোথায় ঘোরার জায়গা পাবো জানি না, তাছাড়া কয়েক জায়গায় টার্নিংও আছে। ভুলভাল দিকে চলে গেলে মুশকিল।
-“না। আমি যাবো না। তুমি ফিরে যাও।”- লোকটা হাত তুলে বললো। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালো। থাকতে পারলাম না, ছুটতে ছুটতে গিয়ে বললাম-“আরে! চললেন কোথায়! ওদিকে জঙ্গল! এক্ষুণি কত বড় সাপ বেরিয়েছিলো দেখলেন তো! যাবেন না, আরে, দাঁড়ান দাঁড়ান। ”
ফিরে তাকালো লোকটা। -” তুমি ফিরে যাও। সব সাপ আমার কথা শোনে না, যখনতখন বিপদ হতে পারে তোমার।”
লোকটার কথাটা খট করে কানে লাগলো। সাপে কথা শোনে না!!
-“মানে? সাপেরা আপনার কথা শোনে?”
-এবার ভালো করে তাকালো লোকটা। -“তোমার কী মনে হয় ওই সাপটা তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে চলে গেল?”
হোয়াট!!! এমনি করে ক্রেডিট নিতে চায় মানুষ! তার মানে ও বলতে চায় ও আমাকে মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছে! আচ্ছা ভণ্ড তো! আমার মনের কথা বুঝে ফেলে লোকটা বললো-“বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশীদূর যেতে হবে না, এখানে এসো।”
লোকটার সাথে কয়েক পা হেঁটে একটা গর্তের সামনে এলাম। লোকটা আমাকে অবাক করে দিয়ে মাটিতে পা আর লাঠিটা ঠুকলো দু’বার! হাঁ করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি লোকটা কী করতে চাইছে হঠাৎ দেখি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে কালচে একটা সাপ। গায়ে সাদা সাদা গোল গোল দাগ। একলাফে অনেকটা সরে এলাম। এত বড় সাপ আমি দেখিনি আগে। মা গো! লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাপটা পোষা কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসলো। আমি দূর থেকেই চেঁচিয়ে বললাম-“বেশ বেশ! আমি বিশ্বাস করছি। আপনি ওটাকে সরান।”
লোকটা এবার লাঠিটা সাপটার গায়ে ঠেকালো। সঙ্গে সঙ্গে সাপটা আবার নিজের গর্তে ঢুকে গেল। লোকটা সরে এল আমার কাছে। অবাক হয়ে দেখছি আমি। সন্ধে হয়ে আসছে। অল্প আলোয় কেমন মায়াবী লাগছে লোকটাকে দেখতে। এমনও সম্ভব! হতে পারে এমন!
-“হ্যাঁ, হতে পারে।”
লোকটা থট রিডিং করতে পারে বোধহয়। বললাম-“আপনার বাড়ি কোথায়?”
-“এই তো, এখানে! এদের সাথে!”
-“আপনার বাবা মা?”
-“ছিলেন। এখন আর নেই।”
চুপ করে আছি। আমার ঘোর কাটেনি এখনও। যা হচ্ছে সব কি সত্যি!
-“তুমি বোধহয় অবাক হচ্ছো আমাকে দেখে! আমি সন্ন্যাসী বলতে পারো। সন্ন্যাসী মানেই যে ছাই মেখে ঘুরে বেড়াতে হবে তা তো না! যারই বন্ধন নেই, মায়া নেই, মোহ নেই সেই সন্ন্যাসী। আমিও সন্ন্যাসী। আমারও জাগতিক কোনো বন্ধন, কামনা বাসনা কিছু নেই। তবে আত্মীয় আছে। আমার আত্মার আত্মীয়। মানুষরা নিজেদের এত বড় ভাবতে ভাবতে নিজেদেরই ছোট করে নিয়েছে। মানুষ ছাড়া আর কেউ আপন হয় না মানুষের। অবশ্য তাই বা হয় কই বলো! এত এত মানুষ চারদিকে, অথচ ক’জন যে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে খুঁজে দেখতে হবে। ”
এতদূর বলে থামলো লোকটা। অন্ধকার নেমে আসছে। আমি চুপ করে শুনছি।
-“ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারতাম আমি অনেক কথা বুঝতে পারি। গাছে যে পাখিটা বসে থাকতো সে তার মতো কথা বলতো, সব না বুঝলেও কিছু বুঝতাম। ওদেরও দুঃখ আছে, আনন্দ আছে, ভয় লাগা, ভালো লাগা সব আছে। কুকুরগুলো চিৎকার করতো, সব কথা বুঝতে পারতাম আমি। অথচ ওদের ভাষা শেখাতে পারিনি কাউকে। আমি নিজেও শিখতে পারিনি। শুধু বুঝতেই পারতাম, নিজে কিছু বোঝাতে পারতাম না। শেষে একদিন বুঝলাম আমার সঙ্গে সত্যি যদি কিছুর সম্পর্ক থেকে থাকে তো সেটা হলো সাপ। হ্যাঁ। ঠিক যতটা স্পষ্টভাবে তুমি আমার কথা শুনছো, বুঝছো- তার চেয়েও বেশী স্পষ্ট করে আমি সাপেদের কথা শুনতে পাই। এমনকি নিজের কথা বোঝাতেও পারি । বাবা মা দু’জনেই চলে গেল পরপর দু’বছরে। তারপর আর মন টেঁকেনি সংসারে। এখানে এসেছি আজ বছর আটেক হলো। বেশ আছি, ভালো আছি বরং। জামাকাপড় লাগে মাঝে মাঝে, সেগুলো আনতে যেতে হয়, খাবারের অভাব নেই। টুকটাক ফলমূল খেয়েই কেটে যায় আমার। ”
এতক্ষণ এত কথা বলে থামলো লোকটা। চারদিক চুপচাপ। এখানে এই পরিস্থিতিতে বিশ্বাস না করার কথা মাথাতেই আসে না। ভাবছি চুপ করে। হঠাৎ লোকটা বললো-” একদম নড়বে না, তোমার পাশ দিয়ে একটা গোখরো আসছে।”
বুকের ভেতর ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। শুকনো পাতার উপর সরসর শব্দ হচ্ছে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি না কিছু, উনি বুঝে গেলেন কী করে! শব্দটা আমাদের পেরিয়ে মিলিয়ে গেল।
-“আর না। তুমি জানতে চাইছিলে খুব করে তাই বললাম এত কথা। তুমি এসব কাউকে না বললেই খুশি হব আমি। এখন যাও।আর একটু এগোলে গাড়ি ঘোরানোর মতো জায়গা পাবে। সেখান অব্দি গিয়ে ফিরে যাও।”
-“আপনি?”
-“আমি যেমন আছি, তেমনই থাকবো। ”
-“আপনার কোনো বিপদ হলে?”
-“বললাম না, আমি সন্ন্যাসী! আমার ভয় নেই, মোহ নেই, লোভ নেই- কিছু নেই। বিপদ হলে কী হবে? খুব বেশী তো প্রাণটাই যাবে! প্রাণের মায়াও নেই আমার। যাও এখন তুমি।”
আর কথা বাড়ালাম না। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম।
পথ হারাইনি। ঘরে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় আটটা। নিজের ঘরের দিকে এগোচ্ছি, বাবা আমাকে দেখেই বললো-“কুকুরগুলোকে বেঁধে রেখছি বারান্দায়। স্যাটান তখন কীকরে বোধহয় ছাড়া পেয়ে গেছিলো। তোমাকে নতুন দেখে চেঁচামেচি করেছে। আর অসুবিধে হবে না বোধহয়।”
বাবা কি সত্যি অতটা খারাপ!? কেজানে! অনেকবার মনে হয়েছে বাবার মধ্যে একটা পশু লুকিয়ে আছে, কিন্তু পশুরাও কি খারাপ সবসময়? তাদেরও তো মায়ামমতা আছে! ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলাম বারান্দার দিকে। সবকটা কুকুর বাঁধা আছে চেন দিয়ে। আস্তে আস্তে গিয়ে স্যাটানের চেনটা খুললাম। ওদের ভাষা বুঝতে না পারলেও মনে হলো স্যাটান যেন পায়ে মুখ ঘষে কৃতজ্ঞতা জানালো। জীবনে এই প্রথমবার কোনো কুকুরের মাথায় হাত বোলালাম। ও আমার হাতটা চেটে দিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। হেসে বাকি চেনগুলো খুলতে এগিয়ে গেলাম আমি।
(এই গল্পের সমস্ত নাম, চরিত্র, ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনো মিল নেই।)