দুপুর গড়িয়ে বিকেল । তখনও সুর্যের প্রখরতা কমেনি । সাজনা গাছের ফাঁক দিয়ে রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে সামনের বারান্দায় । প্রশ্নপত্র নিয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। যুক্তিবিদ্যার দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা শেষ হলো আজ। এটাই ছিল অভ্রর উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষা ।
– পরীক্ষা কেমন হলো অভ্র দা? দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাস করে লতা ।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই লতা প্রশ্নটি অভ্রুর হাত থেকে কেঁড়ে নিয়ে ভাঁজ করে সোজা অভ্রর শার্টের বুকপকেটে যত্ন করে ঢুকিয়ে দেয়। অভ্র দা তোমার সঙ্গে একটা জরুরি আলাপ আছে। শুনবে ? চলো ছাদে যাই।
অভ্র ভীষণ ক্লান্ত। পরীক্ষা শেষে আজ টিফিনও মুখে দেয়নি । এখনো ভাবছে যুক্তিবিদ্যার সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠিক-ঠাক মতো হলো কিনা। তার উপর লতার জরুরী আলাপের রেড এলার্টে অভ্র কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে ।
– এখুনি শোনতে হবে? এমন কী তোমার জরুরী কথা? কিছুটা বিরক্তির সুরে জবাব দেয় অভ্র।
-না,মানে একটা কথা তোমায় বলবো বলে অনকেদনি ধরইে ভাবছলিাম। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। বলাটা খুব জরুরী। আমিতো কালই হোষ্টেলে চলে যাব। থাক, শুনতে না চাইলে ……
– আরে কি বলবে বল না। এত ভাব নিচ্ছ কেন। অভ্র লতাকে কিছুটা হালকা করে দেয় ।
লতার লম্বা চুল কোমর স্পর্শ করে। ছাদে আসবে বলেই ভিজা প্যাঁচানো কাপড়টা চুল থেকে খসিয়ে নিয়েছে। ভেজা দীঘল চুলের একটি গোছা নিজের বুকের উপর টেনে নেয়। চুলের অন্য গোছাটি পিঠের উপর ছড়িয়ে রাখে। সদ্য গোসল করা শ্যাম্পুর একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগে অভ্রর । বুক ভরে টেনে নেয় একবার। লতা উদাস দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে। পাশেই সাজনা গাছের ডালে দুটো শালিক পরস্পরে ঠোঁট ছোঁয়। পাখীদের মিলানো ঠোঁট দেখে লতা আনমনা হয়ে পড়ে। খানিকটা দূরে শেফালীদের টিনের চালে একটা জালালী কবুতর আপন মনে পালকে ঠোঁট ঢুকিয়ে বসে থাকে। যেন কত নিশ্চিন্ত জীবন ওর ।
অভ্র অস্থরি হয়ে বলে — কি হলো চুপ করে আছো যে! এই তো বললে অনকেদনি ধরে একটা কথা বলবে বলে ভাবছিলে। তোমার মধ্যে কেমন একটা অন্যরকম ভাবও তখন লক্ষ্য করছিলাম। একটা উৎকণ্ঠা হাবভাব ছিল। আর এখন চুপ মেরে গেলে যে! প্লিজ, বল না কি বলবে। অভ্রর মধ্যে এক আকুলতা।
লতা চুপ করেই থাকে। কোন কথা বলে না। অভ্রর মধ্যে উৎকণ্ঠা আরো বাড়তে থাকে।লতা দূরে, অনকে দূরে দৃষ্টিহীন পথিকের মত তাঁকিয়ে থাকে। একসময় অস্পষ্ট স্বরে বলে — না, থাক। অভ্র চিত্কার করে বলতে থাকে প্লীজ বল কী বলতে চেয়েছিলে।
সাজনা গাছে বসে থাকা শালিক দুটো এখনো একে অপরকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে। নিশ্চিন্তে পালকে ঠোঁট ঢুকিয়ে রাখা জালালী কবুতরটিও বসে আছে।
দিন তিনেক পর অভ্র একটি চিরকুট খুঁজে পায় তাঁর ডায়রিতে। লতার নিজ হাতে লেখা –
প্রিয় অভ্র,
“তুমি কাছে এলেই উড়ন্ত ভাবনাগুলো জমাট বেঁধে হিমশীতল হয়ে যায় । ভয়ে তাই শুন্যে তাঁকিয়ে থাকি, না দেখার ভান করে। নিদারুন নিঃসঙ্গতা মেনে নিয়েছি অনেক আগেই । জানি তোমার যোগ্য আমি নই । হতেও পারিনি । জনস্রোতে হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস চিরচেনা কাঠ ঠোকরা পাখির মতো ঠক ঠক শব্দে হৃদয়ের কোঠরে গর্ত করে আঁটি বেঁধে রেখেছিলাম সারি সারি করে। আর দুঃখগুলোকে শর্তহীনভাবে ধরে রেখেছি নিপুণ প্রেমিকা হয়ে তোমায় ভালবাসবো বলে । ‘তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি’- মহাদেব সাহা’র এই কাব্যটি ছিল আমার বেশ প্রিয়। এইটি তুমি ভালো করেই জানতে। জেনেও না জানার ভান করেছ কতবার। যাক, মূল্যহীন ভালোলাগা আমাকে দুরে,অনেক দুরে ঠেলে দিয়েছে । জীবনের অন্ধ গলিতে আমি হারিয়ে যাচ্ছি নিঃসঙ্গতায়। ভালো থেকো অভ্র”।
-তোমার লতা