বন্ধন

বন্ধন

জানলার ফাঁক দিয়ে মুখের ওপর ভোরের আলো এসে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল মণিশঙ্করের।প্রতিদিনই রাতটা ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুমে কেটে যায়।ভোরের দিকে ঘুমটা একটু গাঢ় হয়। চুড়ির রিনরিনে শব্দ তুলে,চাবির গোছা ঝনাৎ করে পিঠে ফেলে সুরমা তখন সবে মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়।

”কে সুরমা?এসেছো?এসো! রাতে ভাল ঘুম হয়নি আমার।”

মণি বলে ক্লান্তি মাখা চোখে।খালি পেটে আমলকীর রস খাওয়ার তার বহুদিনের অভ্যেস।কষ্টিপাথরের খলে আমলকীর রস বানিয়ে ছোট সাদা পাথরের বাটিতে করে সুরমা মণিশঙ্করকে বলে-

”নাও রসটুকু খেয়ে নাও।ভোরবেলা হাওয়া লাগিও না।তোমার তো ঠান্ডা লেগে যায় একটুতে।”

আবছা স্মৃতির তরঙ্গগুলো রোজকার মতই মণিশঙ্করের চোখের ওপর কাঁপতে থাকে।আগে-আগে এরপরই কিছুক্ষণ কাগজ পড়ে,চা প্রাতঃরাশ খেয়ে, স্নান সেরে, বাবার সাথে কাজে বেরোতো মণি।বিরাট ব্যবসা, সামলাতে হিম সিম অবস্থা।এখন সবই অন্ধকার কুয়াশার আস্তরণে আচ্ছন্ন।বিরাট সোনার দোকান বিক্রি করে দিয়েছে একমাত্র ছেলে তন্ময়।তার মতে দশটা পাঁচটার চাকরি অনেক শান্তির।এখন একাকীত্বের করাল ছায়া আস্তে-আস্তে গ্রাস করেছে মণিকে।একদিন গাছের ছায়া দিয়ে মণির জীবনটা আগলে রেখেছিল সুরমা।তারও আগে জ্যোৎস্নার নরম আলোর মত মণির জীবনটা ভরে রেখেছিল দীপু।এখনও প্রতিদিনই সুরমা আসে,দীপু আসে।তবে স্বপ্নে, ভোরের আলো ফুটলেই কোথায় যে চলে যায়!অসহ্য যন্ত্রণা হয় বুকে।অব্যক্ত যন্ত্রণা! মণি ভাবে এ কষ্ট যেন অতি বড় শত্রুরও না হয়।

”ভালো লাগে না আর আলো! উফ্ অসহ্য !সুপ্রিয়া ,সুপ্রিয়া জানলাটা বন্ধ করে দে। আবার খুলে গেছে।বলেছি না এত আলো ভালো লাগে না আমার।”

”এই যে দাদু যাচ্ছি।তুমি বসো একটু।”

সুপ্রিয়া বলে মেয়েটি নীচের স্টেশনারী দোকানে বসে।মাইনে করা কর্মচারী বৈ তো নয়! তবু মণিশঙ্করের ওপর বড় মায়া সুপ্রিয়ার।

”আমার বাবা থাকলে—-! কি করে পারে এরা একটা বৃদ্ধ মানুষকে এত কষ্ট দিতে।যার সবকিছু, তাকেই এত কষ্ট দেয়?ভগবান এদের মাপ করবে না।”

সুপ্রিয়া ভাবে মনে-মনে।একতলার পিছনের সিঁড়ির পাশের ঘরটাতে মণিশঙ্করের আস্তানা।অন্ধকার ঘুপচি,ময়লা,দুর্গন্ধ ঘরটাকে ভরে রেখেছে।বহুদিনের চাপ-চাপ ধুলো অসহায় ব্রাত্য হয়ে ঘরের কোণে পড়ে আছে।কারো এসব দিকে নজর নেই।কোনোরকমে যাহোক খাবার ছুঁড়ে দিয়েই সকলে কৃতার্থ করে দিচ্ছে যেন মণিকে।সকলে বলতে কাজের দুজন লোক আর রকি।বড়-সড় একটা ল্যাব্রাডর।নাতনী রিনির খেয়ালে পোষা হয়েছিল একসময়।সে বিদেশে চলে গেছে।এখন রকি হয়ে গেছে মণির একমাত্র সঙ্গী।অনেক নিষেধ সত্ত্বেও রকির এঘরে আসা কেউ আটকাতে পারেনি। কাজের লোক দুটো মণির থেকে রকিকে বেশী যত্ন করে।তবে রকি বড্ড বোঝে মণিকে।মানুষ বেইমান হয় কুকুর নয়।গা হাত পা চেটে কত আদর করে।মুখে করে চাদর টেনে মণির গায়ে চাপা দিয়ে দেয়।চারটে বিস্কুট দিলে দুটো রেখে দেয় মণির জন্য।মণি বিস্কুট খেয়ে খাইয়ে দিলে তবে খায়।নয়তো মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে।এজন্য কাজের লোকেরা কত কথা শোনায় মণিকে।

”বুড়োর ভিমরতি দেখ্।কুত্তার খাবারও খেয়ে নিচ্ছে।বুড়োর বড় নোলা!বহুদিন জ্বালাবে।ছেলে দেখে না বৌ দেখে না সে কি এমনি!”

মণি ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকায়।সে যেন ভার বোঝা হয়ে চেপে বসেছে সবার ওপর।এই ছেলেকেই নাকি বুকে করে মানুষ করেছে।ছেলে যখন বয়েসে বড় নিজের পছন্দের মেয়ে বিয়ে করেছে তাকেও সাদরে মেনে নিয়েছে।ভেবেছে-

”নিজে ভালবাসার মানুষকে কাছে না পেয়ে যা কষ্ট পেয়েছি বাবার জন্য, সে কষ্ট যেন আমার ছেলেটা না পায়।”

অথচ এই তার প্রতিফল!যদিও ফলের আশা করে কিছু করে না কোনো মা বাবা।তবু মনের কোণে কোথাও তো একচিলতে আশা থাকে। একমাত্র নাতনি,কাজের লোকেদের আর কি দোষ! যেমন দেখছে,শুনছে তেমনই শিখছে। তাই অর্ধেক সময় সুপ্রিয়াই মণির দরকারী কাজগুলো করে দেয়,মাঝে-মাঝে ঘরটা পরিষ্কার করে; সকলের আড়ালে।জানাজানি হলে অশান্তি হবে।মণির ছেলে তন্ময় আর ছেলের বৌ তনুজা থাকে ওপরের তলায়।সারাদিনই থাকে না।চাকরি, পার্টি সেরে মাঝরাতে মদ্যপ হয়ে ফেরা।গালিগালাজ, ঝগড়া, মারামারি।এই তাদের জীবন। নাতনী রিনি বিদেশে পড়াশোনা করে।যখন এদেশে আসে, সে ও আসেনা দাদুর কাছে।মা-বাবার বারণ।দাদুর রুচি খুব নিম্নমানের।তাদের সাথে মেলামেশার উপযুক্ত নয়।তাই সামনের বড় গেট দিয়ে যাওয়া-আসা করে ওরা।মণির এই পিছনের সিঁড়ির পাশে ঘরটাতে আসার তাদের প্রয়োজন পড়ে না।তবে কোনো কাগজ পত্রে সই করাতে হলে আসে,স্টেশনারী দোকানের টাকার কালেকশান নিতে আসে।এই বয়েসে ছেলে আর ছেলের বৌ এর কাছ থেকে এইরকম নিদারুণ অবহেলা আর সহ্য হয়না মণির।এক- এক সময় মণি ভাবে ঐ যে কথায় আছে না-

”সব ফল এখানেই ভোগ করতে হয়।পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি যেন আমি।এই বিরাট বাড়ীটা তিল- তিল করে আমার হাতেই বানানো।অথচ আজ আমি একলা পড়ে আছি বাড়ীর এককোণে।সবই মানুষের কপাল।দীপুর অভিশাপেই হল নাকি এমন?”

দীপু বলেছিল-

”মণিদা তুমি যেমন আমাকে কাঁদালে তোমাকেও তেমনি একদিন কাঁদতে হবে।”

তবে একথাগুলো বলতে-বলতে অনেক বেশি কেঁদেছিল দীপু। আসলে সত্যি করেই মণিকে কাঁদাতে চায়নি কখনো দীপু।শত দুঃখ, যন্ত্রণা, অবহেলা বুক পেতে সহ্য করতে-করতে কোথায় যে ছেড়ে চলে গেছিল এই বাড়ী ছেড়ে চিরতরে !বড় অভিমানী ছিল দীপু।সেই যে সেদিন চলে গেল আর ফিরল না।ও মুখ আর দেখতে পেল না মণি। মণি শুধু বলেছিল-

” বাবা এ বিয়ে মানবে না দীপু।মায়ের একার কি ক্ষমতা!”

বাবা দীপুকে সহ্য করতে পারতো না।খালি বলত-

”ঐ কলোনি কালচারের মেয়েগুলো খুব ঘাড়ে চড়া হয় মণি।তুমি রাতদিন ওর সাথে এত বকবক কোরোনা বলে দিচ্ছি।বিপদে পড়বে।এরা ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোয়।তোমার মায়ের সকলকে নিয়েই আদিখ্যেতা।তুমিও তোমার মায়ের মত।যেমন মা তার তেমন ছা।”

তবু তো প্রেম হল।শরীর দুটো এল কাছাকাছি।কি করে যে বলেছিল দীপুকে বাবা মানবে না তাদের সম্পর্ক!
এখন ভাবে মণি! কেন যে বলতে গেল!না বলেই বা কি করতে পারত মণি?কিছু করার ক্ষমতা তো ছিল না!সত্যিই কি কিছু করার ছিল না?মণি কি তবে প্রতারক?

ভাবতে-ভাবতে দমটা বন্ধ হয়ে যায় মণির! দীপুকে তো কষ্ট দিতে চায়নি মণি।তাকে কষ্ট দেওয়ার কথা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে!

”আমাকে ভুলে যাবে নাতো মণিদা?আমরা যে তোমাদের মত এত বড়লোক নই!”

দীপু মাঝে-মাঝেই বলতো।

”দীপু তোমাকে আমি কিছুতেই ভুলব না!”

কত শুনশান একলা দুপুরে দীপুর ঘন চুলের ঘ্রাণে মণির নেশা ধরে যেত।শাড়ীর আঁচল উড়ে এসে লাগত গায়ে।মণির ইচ্ছে হতো আঁচল টা ধরে কাছে টেনে নিতে দীপুকে।কতবারই তো তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছে।সেসব স্মৃতি তো আজও অমলিন।কিন্তু অবাক করা ব্যাপার টা এই যে,কেউ তো যত্ন করেনি দীপুকে।বরং সংসারে সকলের বিরক্তির কারণ হয়েছে।ভাল করে গুছিয়ে কেউ খেতেও তো দিতোনা ওকে।যেটুকু আবদার ছিল তা ঐ মণির মায়ের কাছে।এত অযত্নে এত অবহেলাতেও এই উথলে ওঠা যৌবনের জোয়ার কে আনল দীপুর ভেতর?ভগবানই বোধহয় সাজিয়ে দিয়েছিল ওকে। দীপু স্নান সেরে ভোরবেলা যখন ও বাড়ীর ছাদে কাপড় মেলত তখন দীপুর অনাবৃত ফর্সা পিঠটা দেখে মণির সারা শরীরে কে যেন দাপাদাপি করত।ইচ্ছে হতো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দীপুর পিঠে একটা চুমু খেতে।অপরূপ সুন্দরী নয় দীপু।কিন্তু দুধের মত ফর্সা চেহারাটায় মহুয়ার নেশার মত একটা মাদকতা ছিল।ক্রমাগত যুদ্ধ করে যাওয়া জীবন অথচ কোমল হৃদয়,হরিণীর মত ভীরুতা,আশ্রয় পাবার গভীর আকূতি।মণি বোঝাতে পারত না ঠিক।মন কেমন করতো মাঝে-মাঝে।ইচ্ছে হতো দীপুকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিতে।

কতদিন পূর্ণিমা রাতে ছাদের ওপর দীপুর কোলে শুয়ে থেকেছে মণি।কতদিন মণির মা দেখেছে কিন্তু কিছু বলেনি।বাবা যেদিন দেখল সেদিনই দীপুর এ বাড়ীতে আসা নিয়ে অশান্তি শুরু হল—। কত কথা বলে যেত দীপু তার কতগুলোর মানে ছিল কতগুলোর বা কোনো মানে ছিল না।তবু মণির শুনতে ভাল লাগতো।এমন কোনো কথা ছিল না যা মণি বলত না দীপুকে।লম্বা চাঁপাফুলের মত আঙুল দিয়ে মণির চুলে বিলি কেটে দিত দীপু।তখন দীপুর কতই বা বয়েস।ঘি আর আগুন পাশাপাশি থাকলে তো জ্বলবেই।সে জ্বলাটা ভালই তো লাগত মণির।দীপুও তো কখনও না বলেনি।যেন মণি দীপুরই সম্পত্তি।বিয়ের পরও কতদিন মণি খুঁজেছে দীপুর ঐ চেনা আদরটাকে।তখন ভাল লাগত না সুরমার গায়ের গন্ধ।সুরমার আদর করার ভঙ্গী।কিচ্ছু ভাল লাগত না।মুখটা বিস্বাদ হয়ে যেত।অথচ নিয়মের বশে দুজনকে মিলিত হতে তো হবেই।সবই অভ্যেস হয়ে গেল একসময়।সুরমা মণির মনে জায়গা করে নিল তার অসীম সহ্য আর মায়ার গুণে।

কিন্তু মণি কি সেদিন জানতো না দীপুর সঙ্গে তার এই ভালবাসার পরিণতি কি হতে পারে?কেন নিজেকে সংযত করেনি?কেন মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিল দীপুকে?অথচ কিই বা করতো মণি?ভালবাসার কাছে সকলেই যে বড় অসহায়! মণি তো তাদের থেকে আলাদা নয়। সে তো দীপুকেই চেয়েছিল শুধু গভীরভাবে।তবু কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল।সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কত কি পাল্টে যায়।মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। কতদিন আবেগের বশবর্তী হয়ে,ঘুমের ঘোরে,অসুস্থতায়, সুরমাকে দীপু বলে ডেকে ফেলেছে মণি।কিন্তু কি অসম্ভব মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সুরমার। কখনও একবিন্দু রাগ করেনি সে।দীপুর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ, কোনো রাগ প্রকাশ করেনি।কি অপরিসীম মায়া ছিল সুরমার মনে।,
সুরমা কেবলই বলত-

”আহা !কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।তোমাকে যে নিজের করে পায়নি।না পাওয়ার কত জ্বালা কি বুঝবে তোমরা পুরুষরা!যে না পায় সে ই জানে।কোথায় যে চলে গেল এখান থেকে।যদি একবার দেখা পেতাম।কি গভীর অভিমান।কত দুঃসহ বেদনা গো!আমি বুঝি!আমার জন্যই এমন হল।আমি যদি না আসতাম তোমার জীবনে।তোমাদের ভালবাসাটা নষ্ট করে দিলাম আমি নিজের হাতে।”

চোখ মুছতো সুরমা। মণি মনে-মনে ভাবত –

”কে বলল পুরুষরা কিছু বোঝে না?না পাওয়ার জ্বালা পুরুষদেরও হয় সুরমা।তোমাকে কি করে বোঝাব?তোমাদের কান্না দেখা যায়, আর আমাদের টা দেখা যায় না।হৃদয়ের ভেতর রক্তনদী বইতে-বইতে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।কিন্তু একথা কি করে বলব নিজের মুখে?তোমাকেও যে কষ্ট দিতে পারব না সুরমা!তোমার মত মহৎ হৃদয় দেখিনি যে আমি।সব জেনেশুনেও এত ভালবাসা দিয়েছো আমাকে।দীপুকেও ভালবেসেছো প্রাণ দিয়ে।”

দীপুকে না দেখেও দীপুর প্রতি কি অসম্ভব অনুভূতিশীল ছিল সুরমা, সে যে না দেখেছে বিশ্বাস করবে না।দীপুর কথা মণি সবটাই বলেছিল সুরমাকে।দীপুকে যে অসম্ভব ভালবাসতো মণি। ভালবাসতো না, এখনও ভালবাসে।মনের কোণে দীপু বসে আছে চুপটি করে।জলভরা চোখে তাকিয়ে দেখছে আর যেন বলছে-

”মণিদা কেন তুমি এমন করলে?”

দীপুর ভালবাসাকে অস্বীকার করার তো কোনো জায়গা নেই। তবে সুরমা ওকে এত কেন ভালবাসতো জানে না মণি।কিছুই তো পাওয়ার ছিল না দীপুর কাছ থেকে ওর।বরং যদি দীপু ফিরে আসতো সুরমা সব কিছু হারিয়ে ফেলত।তখন কি সুরমা পারতো দীপুকে মেনে নিতে?ঠিক এইভাবে ভালবাসতে?

উফফ মণি আর ভাবতে পারে না।একবার সুরমা, একবার মণি দোদুল দোলায় দুলে চলল ওর গোটা জীবন।কেন এরকম কাপুরুষের মত কাজ করল মণি?কেন সেদিন বাবার মুখের ওপর বলতে পারল না যে দীপুকেই সে বিয়ে করবে?তবে কি মনের গোপন চোরকুঠুরিতে বিরাট সম্পত্তির লোভ ছিল?নাকি সুরমার অপরূপ লাবণ্যে পুরুষোচিত আদিম ভোগের বাসনা জেগে উঠেছিল মণির মনে?ভেবেছিল নতুনের স্বাদটা পরখ করে দেখবে।পুরুষরা তাহলে সত্যিই বদল চায়?কেন জোর গলায় বলতে পারেনি সেদিন মণি?ত্যজ্যপুত্র হবার এত ভয় যে নিজের ভালবাসা ও মিথ্যে হয়ে যায়?বেশ হয়েছে।এই উচিত শাস্তি।সকলে আজ তাকে ব্রাত্য করে ফেলে রেখেছে।টাকা-পয়সা, নিজের হাতে গড়া সুরমার স্বপ্নের বাড়ীটা, সবই লিখিয়ে নিয়েছে একমাত্র ছেলে আর ছেলের বৌ।অসুখের সময় মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেছিল মণির।সুরমা অকালে চলে গেল তাকে একলা ফেলে।তারপরই অক্ষম মণিশঙ্করের হাত থেকে চলে গেল সবকিছু।যদিও অর্থ বিত্ত এসবের আর প্রয়োজন নেই মণির জীবনে।যে জীবনে ভালবাসা নেই,যার বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়াতে কারোরই কিছু এসে যায় না; তার আর অর্থ,বাড়ী, সম্পত্তিতে কিসের প্রয়োজন?বাঁচতে গেলে অর্থ লাগে।কিন্তু আর বাঁচতে চায় না যে মণি।তাই ইচ্ছে করেই বেছে নিয়েছে একবেলা আহার।একবেলা উপোস।

”কেন মরে যাইনা রে সুপ্রিয়া?খাওয়া তো বন্ধ করেছি প্রায়। তাও-তাও কেন আর বেঁচে আছি!সুরমাও কি অভিমান করে চলে গেল?তিলে-তিলে বুঝিয়ে দিতে যে আসলে আমি একজন মৃত মানুষ।অনেক আগেই মণিশঙ্করের মৃত্যু হয়েছে!”

কিন্তু সুরমা যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন কখনও তো মরবার কথা ভাবেনি মণি।মনের গোপন অন্দরে ছিল দীপু।সে ছিল নীরবে, নিভৃতে তার গভীর কালো চোখে অপলকে যেন তাকিয়ে দেখত মণি-আর সুরমার সাজানো সংসারের দিকে।হয়তো সেকথা সুরমা অনুভব করত।তবু সে নিয়ে সুরমা কিছু মনে করেনি।কখনও ভাবেনি দীপু তার প্রতিদ্বন্দ্বী।কতবার মণি ভেবেছে সত্যিই যদি কখনও দীপু ফিরে আসে?কি করবে তখন সুরমা?তবে কি মণি চাইতো আসুক-আসুক একবার অন্ততঃ দীপু আসুক।মরার আগে হলেও দীপুর অপূর্ণতাকে একবার পূর্ণ করবে তাহলে মণি! দীপুর প্রতি কেন এই সহানুভূতি সুরমার?তবে কি সুরমা মণিকে করুণা করে?তার আচরণে কোথাও তো কোনো ছেদ নেই।বরং বড় গভীর ভালবাসার নরম প্রলেপ।সে কারণেই সুরমার প্রতি শ্রদ্ধায় মণিশঙ্করের হৃদয়টা পূর্ণ হয়ে যেত।

মণিশঙ্করের বাড়ীর ঠিক পাশেই ছিল দীপাদের ভাড়া বাড়ী।অনেকগুলো ভাইবোনের মাঝে তেমন আদর পেত না দীপা বাড়ীতে।এদিকে মণির মায়ের মেয়ে ছিল না।তাই সেই ছোট্টবেলা থেকে বড় মায়ায় জড়িয়েছিল মেয়েটা। মণিশঙ্করের মায়ের বড় পছন্দ ছিল দীপাকে।

”তোকেই আমার মণির বৌ করব।”

এই ছিল মণিশঙ্করের মায়ের মুখের বুলি।কিশোরী দীপা যখন ছোট ছিল তখন এই বৌ হওয়ার মাহাত্ম্য টা ঠিক বুঝত না।কিন্তু মনের ভেতর সেজেগুজে বসে থাকা একটা মেয়ে,অনেক লোকজন,আনন্দ,সানাই এইসব মিলিয়ে একটা আবছা ছবি ফুটে উঠত।তারপর কিশোরী মেয়ের মনে ক্রমে-ক্রমে সূর্যের লালচে আভার রঙ লাগল।মণিকে দেখে লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে দীপার চোখমুখ।ছোটবেলার মণিদা স্বপ্নের নায়ক হয়ে ধরা পড়ল তার দুচোখে।কিন্তু মণির বাবা কিছুতেই এমন সাধারণ কলোনী থেকে উঠে আসা পরিবারে ছেলের বিয়ের কথা ভাবতে পারেন না।তাই মণির মায়ের কথাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন।মান, যশ, খ্যাতি কোনো অংশেই দীপারা তাদের সমকক্ষ নয়।তাই অন্য জায়গায় মণির বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে ফেললেন তিনি ভেতর-ভেতর।সেইমত আশীর্ব্বাদের কথা বার্তাও হয়ে গেল।আর মণির সাথে দীপুর ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়তে দীপুর এ বাড়ী আসা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।যদি মণি অবাধ্য হয়ে দীপুর সাথে আবার মেলামেশা করে তবে তাকে ত্যজ্যপুত্র করবেন মণির বাবা।মণির সঙ্গে সুরমার বিয়ের খবরটা দীপার কাছে এসে আছড়ে পড়ল।ঝড় উঠল দীপুর মনে।মণির মায়ের কাছে অনেক কান্নাকাটি করল দীপা।মণি তখন ব্যবসার কাজে কলকাতার বাইরে।এসবের কিছুই জানতে পারল না।বাবা মা নেই সুরমার। কিন্তু মামারবাড়ী তে রাণীর হালে বড় হয়েছে সে।তবু অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই।যেন লক্ষ্মী স্বয়ং নেমে এসেছেন স্বর্গ থেকে।

বাইরে থেকে ফিরে সব শুনল মণি।মেয়ে দেখতে গেলোনা মণি রাগ করে।বলল-

” বাবার কথা শুনে যখন বিয়ে করছি, যখন আমার কোনো ইচ্ছের কোনো দাম নেই তখন কানা হোক, খোঁড়া হোক বাবা যাকে পছন্দ করবে আমি তাকেই বিয়ে করব।”

সুরমা এল মণির জীবনে বৌ হয়ে।তারপর সব কিছুই সকলের জানা।মণির জীবনে দীপুর প্রভাব কতটা সুরমা সেটা বুঝতে পেরেছিল ক্রমে।তবু কঠিন না হয়ে খুব কোমল হাতে আর গভীর মমতায় মণিকে কাছে টেনে নিয়েছিল।দীপুকে ভুলতে না পারলেও এক মুহূর্তের জন্য সুরমাকে অস্বীকার করতে পারেনি মণি।আজ মণি একাকী ব্রাত্য। ভার বোঝার মত পড়ে আছে।আর হয়তো মাত্র কদিন।মণির অন্তিম দিন এগিয়ে এসেছে।শয্যাশায়ী মণির জন্য একজন আয়া এসেছে।সুপ্রিয়া ঠিক করেছে। সুপ্রিয়াদের বাড়ীর কাছেই নাকি থাকে।সুপ্রিয়ার মুখে মণির এই অবস্থার কথা শুনে কেন জানিনা ঐ আয়া কোনো টাকা পয়সা ছাড়াই মণির সেবা করতে রাজী হয়েছে।এতটাই ব্যাকুল হয়েছে যে সুপ্রিয়াও অবাক হয়ে গেছে।

মণি অনেক কষ্টে চোখ খুলল শেষবারের মত।দেখল সেই চোখ, সেই রঙ,সেই মাদকতা নিয়ে তার মাথার কাছে বসে আছে দীপু।পুলোনো কথাগুলো কুয়াশার ধোঁওয়ার মত ঘুলে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছে মণি।তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,বড় চেনা স্পর্শ।সেই পরিচিত সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে নতুন করে।পুরোনো পরিচিত আদরের ছোঁওয়ায় সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যাচ্ছে মণির।মণি বলতে পারছে না।শুধু অনুভব করতে পারছে।মণির চোখ দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে।দূর থেকে সুরমাও হয়তো দেখছে,জানলাটা খুলে দিল দীপা।এক পবিত্র আলোয় ভরে গেছে চারদিক।এই হয়তো ভালবাসার টান।পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে আটকে রাখতে পারে না।মণির চোখ আর খুলল না।দীপু আর মণির চোখের জলে সব মালিন্য মুছে যাচ্ছে ততক্ষণে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত