আমার স্ত্রীর নাম অপরাজিতা। আমি ভালোবেসে অপু বলে ডাকি। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে কোনটা!! আমি চোখ বন্ধ করে বলে দেবো সেটা আমার স্ত্রী। আমার অপু। বিয়ে করবো না পণ করা আমি শুধুমাত্র ওকে একবার দেখেই বিয়ের জন্য হ্যা করেছিলাম। বয়সে আমার চেয়ে ১৬ বছরের ছোটো। দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম আমার সাথে ও মানিয়ে নিতে পারবে কিনা। কিন্তু বিয়ের পর আমার এই ধারনাটাকে সম্পূর্ন ভুল প্রমান করে দিয়েছিলো। আমি জানতাম পৃথিবীতে কোনো মানুষের মাঝে পারফেকশন থাকেনা। কিন্তু আমি হয়তো ঈশ্বরের অনেক প্রিয় বান্দা ছিলাম। তাই আমার জীবনে এমন একটা মেয়ে কে আমার জীবন সঙ্গীনি হিসেবে পেয়েছি যার নামের পাশে পারফেক্ট কথাটা না বসালে পাপ হবে। এক কথায় রূপবতী,, গুনবতী,, বুদ্ধিমতী এসব কিছুর একটা প্যাকেজ বলা যায়। আমার বউটাকে আমি যথেষ্ট ভালোবাসি। কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারিনি।
অপুর সাথে আমার পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়েছিলো।
আমার মামা এই সম্বন্ধ করেছেন। অনেকটা জোর করেই ওকে শুধুমাত্র দেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, প্রথমবার যখন ওকে দেখতে গিয়েছিলাম ও ঠিক কচি কলাপাতার রঙের সাথে দুধ মেশালে যে রঙ টা হয় সে রঙের একটা শাড়ি পড়েছিলো। রঙটার নাম আমি স্পষ্ট করে বলতে পারবোনা কিন্তু সেই দিনটা থেকে ওই রঙটা আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা রঙ হয়ে গেছিলো। ফরসা, হাল্কা পাতলা ছিপছিপে গড়ন। কোয়ার্টার হাতার একই রঙের ব্লাউজ।মনে হচ্ছিলো যেনো ঘোমটা দেয়া একটা জীবন্ত পুতুল আমার সামনে বসে আছে। চোখ তুলে তাকালেই বুঝি আমি জ্ঞান হারাবো। সেদিন প্রথমবারের মতো হয়তো আমি আমার বুকের বামপাশের হৃদস্পন্দন শুনতে পেয়েছিলাম।আচ্ছা একটা মেয়ে এতো মায়াবতি কি করে হয়? যে জিনিসটা আমাকে ওর প্রতি সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিলো সেটা হলো ডান গালের তিলটা। আচ্ছা শুধুমাত্র একটা তিল কি কখনো একটা মানুষের সৌন্দর্য বিশ্লেষন করতে পারে? জীবনে কোনোদিন কোনো মেয়েকে দেখে আমি এতোটা আনমনা হবো ভাবতে পারিনি।
আমাদের পরিবারে আমি আর আমার দুই ছোটো ছোটো ভাই বোন। অর্পিত আর আকাশ। আমার যখন ১৬ বছর বয়স তখন ব্রেন স্ট্রোকে আমার মা মারা যান। তারপর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ভাই বোন দুটো পরের মায়ের। দুটোই যময। ওদের বয়স যখন ৭ মাস তখন বাবা একটা এক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হয়েছিলো। তাই পড়ালেখা আর বেশিদূর এগোয় নি। মাথার ওপর পরিচিত কিছু মামা চাচা দের হাত থাকায় ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাই। দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিলো। বছর চারেক পর আমার ছোটো মায়েরও মৃত্যু হয়। সব কিছু একা হাতে সামলাতে গিয়ে প্রায় হাপিয়ে উঠেছিলাম। আমার চাকরি,, ঘরের কাজ,, ভাই বোন দুটোর দেখাশোনা সব মিলিয়ে আর পেরে উঠছিলাম না। আমার দু:সম্পর্কের এক মামা ঠিক তখনই এই সম্বন্ধ টা নিয়ে এলেন। অনুর বাবা মা নেই। চাচা চাচীর কাছে মানুষ। শুধুমাত্র আমি ভালো ইনকাম করি সেটা দেখেই তাদের রাজি হতে সময় লাগলো না।
অল্প বয়সী মেয়েগুলোকে ঘরের বউ করে আনলে তাদের অর্ধেক সময় সাধারণত বসে থেকেই চলে যায়। হয়তো তারা বুঝতে পারে না কখন কোন কাজটা তাদের করতে হবে নতুবা নতুন বউ বলে তারা গুছিয়ে কোনো কাজ করতে পারে না। কিন্তু আমার অপু প্রথম দিন থেকেই একদম পাকা গিন্নীর মত সবটা গুছিয়ে নিয়েছিলো।সকালের নাস্তা,, আমার দুপুরের খাবার,, ভাই বোন গুলোর দেখাশোনা সব একা হাতে সামলাতো।আমি অবাক হতাম দেখে। সারাদিন ঘরের কাজ সামলাতো আর রাতে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে থাকতো যেনো কচি একটা খুকি।আর আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতাম। ও সবসময় বলতো আমার এই কাজটা নাকি ওর সবচেয়ে পছন্দের মানে ওই চুলে হাত বুলিয়ে দেয়া টা।
বিয়ের দু বছরের মাথায় ও কন্সিভ করে। আমার ভাষায় প্রকাশ করার মত ক্ষমতা নেই সেদিন কতটা খুশি হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো খুশিতে হয়তো আমি পাগলই হয়ে যাবো। কত কি যে কল্পনা করতাম সারাদিন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি।আমার অপুর যখন চার মাস চলে হঠাৎ একদিন রান্নাঘরে পা পিছলে পড়ে যায়। আর আমাদের স্বপ্নটা একটা দু:স্বপ্ন হয়ে রয়ে যায়। ডাক্তার বলেছিলো পড়ে যাওয়ার কারনে ওর জরায়ু ফেটে গিয়েছিলো। সেই বিষ যাতে পুরো শরীরে না ছড়ায় তাই পুরো জরায়ুটাই বের করে ফেলতে হয়েছে।ও আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। একজন মায়ের কাছে তার সন্তান কতটা দামী সেটা ভালো করেই জানতাম। কিন্তু সেই কঠিন সময়েও মেয়েটা আমাকেই সান্তনা দিয়ে যেতো। ও বলতো এতো ভাবছো কেনো,, আমাদের কাছে তো অর্পিতা আর আকাশ রয়েছে। ওরাতো আমাদের সন্তানের মতোই। ওদের নিয়েই না হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো।
তারপর দেখতে দেখতে অর্পিতার বিয়ে হয়ে গেলো। আমাদের আকাশের জন্য চাঁদ মুখখানা একটা বউ নিয়ে এলাম। সব কিছুই আমার অপুর একা হাতের কাজ। আমার শুধু বাজার করা আর টাকা খরচ করা ছাড়া আর কোনো দিকই দেখতে হয়নি। আকাশের যখন একটা ছেলে হলো সেদিন আমার অপুর চোখে জল দেখেছিলাম। খুশির, আনন্দের জল ছিলো সেদিন ওর দু চোখ জুড়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো সেদিন,, আচ্ছা আমি কি এবার মা ডাক শুনতে পাবো। প্রচন্ড আর্তনাদ ছিলো ওর কথাটায়। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে ওর স্বপ্নটা সত্যি হয়েছিলো। আকাশের ছেলে ওকে বড় মা বলেই ডাকতো। আর ও তার নতুন ছেলের ছোট্ট ছোট্ট গাল দুটো চেপে ধরে বাচ্চাদের মতোই বায়না করে বলতো আরেকবার বল সোনা। আরেকবার মা বলে ডাক। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক হয়তো এটাকেই বলে।
জীবনে অনেকটা পথ একসাথে কাটিয়েছি। অনেক ঝড় ঝাপটা, অনেক সুখ দু:খ এসেছে। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে।কিন্তু অপুকে সবসময় সবটা শক্ত হাতে সামলাতে দেখেছি। কখনো কোনো অভিযোগ,, কোনো কারনে অভিমান করা ওর স্বভাবেই ছিলো না।একটা মানুষের হাতে সবসময় তিনটা অপশন থাকে। হয়তো সে কাউকে ভালোবাসবে,, ঘৃনা করবে বা ভুলে যাবে। আমার অপুকে একবার যে দেখেছে তার দ্বিতীয় কোনো অপশন হয়তো মাথাতেই আসেনি। ঠিক এমনটা ছিলো আমার অপু। যাকে ভালবাসা ছাড়া আর কোনো ভাবে প্রশ্রয় দিতে আমি পারিনি।