সন্ধ্যা বেলা বাহিরে মসজিদে আযান হচ্ছে । বাসায় বসে টিভি দেখছি এমন সময় মা চিৎকার দিয়ে আযান হচ্ছে নবাব জাদা । আমি টিভি অফ করব ঠিক তখনেই টিভি তে দেখাচ্ছে মাগরিবের আযান। আমি ও সাউন্ড বাড়িয়ে দিলাম । মা নিজে নিজেই হাসচ্ছে আর বলছে সাউন্ড কমিয়ে দেখ – আমি নামজ শেষ করে তোমার চা দিচ্ছি । কিছু ক্ষণ পড়ে মা চা নিয়ে এলেন আমার জন্য । “কয়টা বাজে রে ?” বলে দেয়াল ঘড়িটা দিকে তাকালেন । শুন তোর বাবার হাত ঘড়িটা নষ্ট । আমি শুনে না শুনার ভান করে রইলাম ।
কি রে শুনছিস জমিদার বাড়ী পুত্র। তোর আব্বার ঘড়ি নষ্ট। একটা নতুন ঘড়ি কিনতে বললাম , কিছু বলেনা। নষ্ট ঘড়ি পড়ে কেউ বাহিরে যায় ?
আমি চুপ করে চা খেতে লাগলাম আর বললাম মা তোমার ভাইয়েরা তো ভগ্নী পতিদের ভাল একটা ঘড়ী উপহার দিতে। মা হেসে বলল আমার শ্বশুর সাহেব যৌতূক দিয়ে কোন পুত্র বধু আনে নাই । আমার দিকে তাকিয়ে বলল তুমিও সেই আশা কর না । দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সিকো ঘড়ীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা অতীতের ফিরে আসা হলো মনে ক্লাস সিক্স তে পড়ি তখন । সবাই জাপান ক্যাসিও কালো ঘড়ি পড়ে স্কুলে যায় । আমার নাই । স্কুল থেকে ফিরে সন্ধ্যায় আব্বাকে বললাম “আব্বু , আমার জন্য একটা ঘড়ি আনবা ক্যাসিও , ঠিক আছে ? কালো ।”
“আচ্ছা এনে দিবো কালকে ।” আব্বার আশ্বাস । পরদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে ছটফট করছি আব্বা কখন আসবে ! নতুন ঘড়ি পড়বো , কি মজা ! আব্বা এলেন , কিন্তু ঘড়ি আনেননি । ভূলে গেছিলেন । আমি কান্নাকাটি শুরু করলাম। আমার জন্য কিছু মনে থাকে না। একা একা অনেক কান্না করলাম । আব্বু একটা ধমক দিয়ে বলল যাও ঘুমাও গিয়ে।মা বলল কাল যেভাবেই হোক কিনে আনবেন । আমি শুনছিলাম না। তিনি অপরাধীর মত মুখ করে বসে রইলেন । রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
পরদিন সকালে স্কুলে যাচ্ছি আমার মুখ কান্না কান্না । বন্ধুদের বলেছিলাম আজ নতুন ঘড়ি পড়ে যাবো । ঘড়ি তো নেই। আমি স্কুল গেইটে সামনে আসতেই দেখি আব্বু দাড়িয়ে । আমাদের স্কুল শুরু হতো ১১.৩০ মিনিতে । আব্বু খুব সকালে বাইতুল মোকারাম থেকে ঘড়ী কিনে নিয়ে এসেছে । আমি নাস্তা না করেই স্কুলে এসেছিলাম । আব্বু আমাকে নিয়ে স্কুল গেইট সামনে থেকে কেক কিনে দিল । আমি তো ঘড়ী পেয়ে মহা খুশী । কি ভাব – তখন একটা জাপানি ঘড়ী মানেই সেই রকম ভাব । সব বন্ধুরা আমার ঘড়ী এক বার একবার ঘরে হাতে দিল ।
পরে জেনেছিলাম , ঐরাতে আব্বা আবার বেরিয়ে গিয়ে অনেক খুঁজে ঘড়ি পাই নাই । দোকান পাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। প্রচুর কষ্ট হয়েছিল তার । পরের দিন আমাকে ঘুমে রেখেই সকালে আবার ঘড়ী আনতে যায় । অতীত থেকে ফিরে এলাম । আমার চোখেও কিছুটা পরিবর্তন । চোখটা ভেজা ভেজা !! বুকে কেমন একটা শূন্যতা। আম্মার হাতে আমার হাতঘড়িটা দিলাম ।
-এইটা আব্বাকে দিও । আমার কথা বইলোনা । আমি আরেকটা কিনে নিবো পরে । আমার থেকে ঘড়ির প্রয়োজন আব্বার বেশী । আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম । আম্মা কিছুটা অবাক ! কিছুক্ষণ পর , আম্মা আব্বাকে বলছে । আমি শুনছি ।
-নাও ঘড়ি ।
-কিসের ঘড়ি ?
-আমি তোমাকে দিলাম ।
-তুমি ঘড়ি পাইছ কই ?
-ঘড়ি এনে দেয়ার লোকের অভাব আছে ? বলে আম্মা হাসতে লাগলেন ।
ঘড়ি পেয়ে আব্বার কেমন লাগে , সেটা দেখতে পর্দার ফাঁক দিয়ে আব্বার দিকে তাকালাম। টিভির হালকা আলোয় দেখলাম বৃদ্ধ লোকটা ঘড়ির ডায়ালটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণে কিছু একটার ঝিলিক ! আনন্দ অশ্রু ! আমার মনটা ভরে উঠলো । এত অল্পতে মানুষ খুশী হয় ?! একটা সত্য উপলব্ধি হলো । শেষ বয়সে বাবা মায়ের শখ আহ্লাদ বলতে তেমন কিছু থাকেনা । একটি ঘড়ি , কয় টাকা আর সেটার দাম ? কিন্তু পরিবার থেকেই প্রাপ্তিটাই শেষ বয়সে তাদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ্য । তাদের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাগুলোই আমাদের সন্তানের জন্য পূণ্যের অবলম্বন ।