বকুল তলায় বসে আমি ও আবন্তী মালা গেঁথেছি, গলা বদল করেছি, কখন কখন খেলাঘরে’র সংসার পেতেছি। এরকম মধুর স্মৃতি জড়িত বকুল গাছটি এখনও মাথা উচু করে আগের মতই গন্ধ ছড়িয়ে চলেছে। শৈশবস্মৃতি বেদনাকাতর সত্য তবে তার আশ্বাদন বিষনাষীর মত যা গড়লকেও অমৃত করে। তাইতো বুঝি কারনে অকারনে মনের মধ্যে শ্রাবনের মেঘের মত সে উঁকি মারে। তখন বাবা রাজি ছিলেন, আবন্তীর বাবাও রাজি ছিলেন, দুই পরিবারের মধ্যেকার সম্পর্কটা আরও একটু মজবুত হয়েছিল। বাবা এবং আবন্তীর বাবা এরা দুজনে ছিলো চাচাতো ভাই। বাবার দাদুর বাবা এবং আবন্তী বাবার দাদুর বাবা একই জন ছিলেন।
দুটি পরিবারের সুখ -দুঃখ যেন একই। এক পরিবারের অসহায়ত্বে অন্যটি ছায়ার মত পাশে এসে দাড়াতে দেখেছি সেই ছোট বেলা থেকে। আবার খুব মনে আছে আমি তখন প্রাথমিক পাশ করে পাশের গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বাড়িতে মোটামুটি সকলেই শিক্ষিত, ফলে সকাল- সন্ধা পড়া, পড়া আর পড়া। আমি যখন “অ পড়ি ষরাবং রহ ধ ংযবফ একটি গরু গোয়ালে বাস করে, অ ংযববঢ় রহ ধ ঢ়বহ একটি ভেড়া খোয়াড়ে বাস করে, অ ফড়ম ষরাবং রহ ধ শবহহবষ একটি কুকুর গুহায় বাস করে” নিয়ে ব্যস্ত আবন্তী তখন ক এর সাথে ল তার সাথে আ কার যুক্ত করে কলা, ভ এর সাথে আ কার তার সাথে ত যুক্ত করে ভাত বানান করতে শিখেছে। এ বিষয়ে আমি একটু বেশিই গৌরব করতাম, আবন্তী তা নিরবে সহ্য করতো। তবে মাঝে মাঝে সে আমার স্থান অধিকার করায় আমাদের সংসারে মাঝে মাঝেই ঝগড়া বিবাদ বাধত। মাঝে মাঝে আমি আবন্তীর রাগ ভাঙানোর দায়িত্বে যখন হার মেনে আবন্তীর উপর রাগ দেখাতাম তখন মা বলতেন, সংসারে এমন অল্প সল্প ঝগড়া হয়, তা কি মনে করে রাখলে চলে! সে ঝামেলা আমি মনে রাখি নি। জানিনা আবন্তীরও মনে আছে কিনা। কিছুদিন ধরে আমাদের দু’পরিবারের মধ্যে একটি সুপ্ত ফ্যাসাদ শুরু হয়েছে। আমাদের বাড়ির জমির ভিতরে নাকি আবন্তীদের জমি আছে।
বাবা জমিজমার হিসাব ভালো বোঝেন। তিনি বললেন, না আমার জমির ভিতরে কারো জমি নেই। কিন্তু আবন্তির বাবা মানতে নারাজ। তিনিও জমিজমার ব্যাপারে খুব ভালো বোঝেন। তিনি বললেন, না না তা বললে হবে না, আমার দেড় কাঠা জমি তোমার বাড়ির জমিতে আছে। বাবাও জেদি তিনি বললেন, তবে যদি তাই মনে হয় তবে মহুরি দিয়ে মাপিয়ে নে। – হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই নেব, তাই নেব। শ্রাবণের শ্রান্ত বিকেল যেন প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দিতে দিধাবোধ করছে। কিসের ভয়ে কি লজ্জায় যেন বার বার নিজেকে আড়াল রাখতে চাইছে। মাথার উপরে একরাশ কালো মেঘ জমাট বেধেছে অথচ বৃষ্টি নেই। সে মুহুর্তে বকুল তলায় আবন্তী একা। চুলগুলো মাঝে মাঝে ঝাপটা বাতাশে দোল খাচ্ছে। বকুল বার বার তাকে সাজিয়ে দিয়ে নিরবে মাটির বুকে ঝরে পরছে। অথচ কিসের একটা অপূর্ণতা যেন সেই মুহুর্তে আমার হৃদয়টাকে চুর্ণ বিচুর্ণ করে দিল। তরুলাতার একটি গুচ্ছ যদি মাটিচুত্য করা হয় ঘন্টা দুয়েক পরে যেমন বিমর্ষ হয় তার বর্ণনা দেওয়াটা বড় শক্ত।
আমার কাছে আবন্তীকে সেদিন এই মাটিচূত্য একগুচ্ছ তরুলতা ব্যতিত কিছু মনে হয় নি। মৃদু পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ও আমার দিকে তাকাল না। অথচ অন্যদিন বারবার বলতো অরুণ কি কবিতা লিখেছ আজ ? আমি মাথা নাড়তাম, নাতো আজ কোন কবিতা লিখিনি। ও নারাজ, না লিখেছ, না, বাবা লিখিনি। এভাবে বেশ কিছুক্ষন ধস্তাধস্তির পর পকেট থেকে ভাজকরা একটি কবিতা যখন তার সামনে ধরতাম তখন নিজের আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। যুবতী মেয়েই হোক কিংবা স্বর্গের অপ্সরাই হোক এই জাতী বলতে আমার জীবনে এমন নিবিড়ভাবে এই মৃণময়ী ছাড়া আর কাউকে কখন দেখিনি। তাই মানস-সুন্দরী জাতীর প্রতি আমার জ্ঞানটা ছিল সীমাবদ্ধ। কিছুক্ষণ পর বললাম, তরু। একটা অস্পষ্ট শব্দ পেলাম। আমার পাশে বসা এ ষোড়শী বালিকার নাম এটি নয়। তবুও আমার দিকে ফিরলো। যেন তরু তার আপন নাম, যে নামে পৃথিবীর কারো কোন অধিকার নেই এই নামের উপর। একটি জন্মের অংশিদারীত্ব নিয়ে তরু নামটি তার কাছে এসেছে। ফুলদানীতে কাটা ফুলের কষ্ট মানুষ জাতির পক্ষে বোঝা দুরুহ বিষয়। কেননা এ জাতিটা মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন হলেও মানবিক গুণ সম্পন্ন নয়।
কিন্তু এই মানস-ফুলের কষ্টটা আমার হৃদয়ে শিলের মত বিধল। বাতাশের আবেগে এলোচুলগুলো বার বার দোল খাচ্ছে। চোখের নিচে কালো দাগ ক্রমশ গাঢ় হয়েছে মুখবিবর্ণ ফ্যাকাশে। বুঝতে পারলাম গতরাত নির্ঘম কেটেছে। অনেকটাই বিষ্মৃত কন্ঠে বললাম, আবন্তী ! মেঘধারী আকাশ তখনও তার সবটুকু প্রচেষ্টায় মেঘকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কিন্তু মেঘনয়নার আকাশ হতে শ্রাবণধারা বর্ষিত হলো। নিজের মনের মধ্যেকার কথাগুলো বারবার মনের মধ্যেই অস্পষ্টস্বরে বলে চলেছে, কেঁদনা আবন্তী, আমি তোমার কান্না সহ্য করতে পারছিনা, তুমি কেঁদনা, প্লিজ। কিন্তু ভিতরের আবহতা বাইরের আবহতায় শূণ্য, ভিতরের পূর্ণ ভিতরেই নিরবদ্বীপে চাতকিণীর বিলাপ, চাতক নির্বাক হয়ে নিরবে নিশেঃষ হয়ে গেল। ।
এভাবে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। আবন্তী বলল, কেমন আছো তুমি ? সবাই বলতো কথার পিঠে কথা লাগাতে আমি অনেকভালো পারি। কিন্তু এ মুহুর্তে কি বলবো বুঝতে পারলাম না। বললাম, একটি কবিতা লিখেছি শুনবে ? – না, তোমার কথা বল। নিরবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ তারপর ধিরে ধিরে দুজনা আলাদা হয়ে গেলাম। অনেক আলাদা যা কখনই এক করা সম্ভব নয়। এখনও জমির সে বিবাদ মেটেনি। অথচ ছোটবেলার বকুলতলায় খেলার সে সংসারের বিবাদ খুব সহজেই মিটিয়ে দিয়ে আবন্তীর বাবা ধুমধাম করে বাড়িটা সাজালেন। অনেক আত্মীয় স্বজন আসলো বহুদূর থেকে, কিন্তু কে জানত নিজের সবচেয়ে কাছের এ আত্মীয়’র বাড়িটা সেদিন অনেক দূরে থাকবে! পৃথিবী’র দুটি অংশ। এক অংশে বিষাদভরা আনন্দ আর অন্যপাশে শুধুই বিষাদ। আবন্তীর বিয়ের দিন মার কোলে মুখ লুকিয়ে অনেক কেঁদেছি, মা সেদিন বলেনি, সংসারে এমন অল্প সল্প ঝগড়া হয়, তা কি মনে করে রাখলে চলে! বরং আমিই বলেছিলাম, মা তুমি ভূলে যাও যে আবন্তী নামে আমাদের জীবনে কেউ ছিল। তবুও মা কথা বলেনি। তার দু’চোখে আমাবশ্যার পূর্ণিমায় সিন্ধুতরঙ্গ। গভীর মেঘ ফোটা ফোটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে আরম্ভ করেছে। মায়ের মেয়ে নেই আমিই একমাত্র ছেলে।
আবন্তী জন্মের পর থেকেই মায়ের কাছে বড় হয়েছে। একদিন আবন্তীর বাবা মাকে ডেকে বলেছিলেন, ভাবি মেয়েতো আমার না, তোমার। আবন্তীর মা ওকে পেটে ধরলে কি হবে, তুমিইতো ওকে মানুষ করছো। আবন্তী এখন থেকে তোমার মেয়ে, আমার কোন দাবি রইল না। কিন্তু তোমার ছেলেটা আমাকে দিতে হবে। মা’তো সেই সেদিন থেকেই আমাকে দিয়ে দিয়েছে, কখন কোন অভিযোগ করেনি। কিন্তু আজ সামান্য বিষয়ে মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেওয়ার দাবি উঠছে! এতদিনের এ বন্ধন সামান্য একটি ঝড়ে ছিড়ে গেল! এই সে বকুলতলা আগের স্থানেই দাড়িয়ে আছে। দুই পরিবারের জমিজমার বিবাদ মিটে গেছে। আমিও নিয়োমিত বকুলতলায় বসি। বকুল ফুল আগের মতই ঝড়ে পড়ে। প্রকৃতির বুকে যত বড় ঝড়ই আসুক না কেন তা সে সংবরণ করে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জোগায়, কিন্তু মানুষ সেটি পারে না।
মানুষের প্রকৃতি বড় রুক্ষ একবার নষ্ট হলে আর শ্যামল হয় না। আমি আকাশে দিকে তাকিয়ে আছি, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। বকুল ফুলের গন্ধ আছে কিন্তু মন মাতাতে পারছি না। হঠাৎ পাশে একটি চিরচেনা পদশব্দ শুনতে পেলাম। পাশে এসে বসলো। নির্দিধায় আগের মতই হাতে হাত রাখলো। আমার মতই সেও আকাশে দিকে তাকিয়ে প্রকৃতিকে চিনতে লাগলো। আজ যেটি আপনার কাল সেটির উপর কোন দাবি নাও থাকতে পারে! এত কাছাকাছি তবুও যেন কত দূর! নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আবন্তী বললো, নতুন কবিতাটি পড়। ধীরে ধীরে পকেট থেকে কাগজটি বের করে পড়তে থাকলাম- তুমহিীন আমি সম শূণ্যপুষ্প মালি। আজি হৃদয় মম শুষ্ক মাল্যসম। মম বফিল স্বপন, মম নরিাশ ভূবন, মম অন্তরখানি শ্রান্ত, নরিাশ, বকেুলী। তব বহিনে কুসুম কানন ধারে আঁধার মাঝারে হরেছিি ডুবি, আজি নস্তিজে, নীরব সকলি। আঁধার সম্মুখ, ব্যথ্যাতুর বুক নরিাশার রাশি অন্তরে উঠছিে ত্রাসি, পরান তব বরিহে পুড়ছিে আকুলী ॥ ৪ আষাঢ় ১৪২১