কন্ঠস্বর

কন্ঠস্বর

কদিন ধরে কি যে রোগ ধরেছে নির্মলবাবুর! সারাদিন একটা অসন্তুষ্টি জাঁকিয়ে বসে আছে ঘাড়ের উপর। এমনিতে ওনার কোনকিছুর সমস্যা নেই, মধ্যবিত্ত জীবন কাটাতে যা কিছু যতটা দরকার সবই ঠিকঠাক আছে। মোটামুটি স্বচ্ছল সংসার, মোটামুটি সুস্থ শরীর, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে এক কথায় ভালো-মন্দ মেশানো একটা মধ্যবিত্ত স্বাভাবিক জীবন আর কি! কিন্তু এই সহজ সরল জীবনে হঠাৎই এক আগন্তুক কণ্ঠস্বরের উদয় হয়েছে কয়েক দিন হল। প্রথমটায় ভেবেছিলেন, স্বপ্ন! এখন এটুকু বুঝেছেন, এ স্বপ্ন নয়, তবে এটা যে কি তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। আর এতেই যত অসন্তোষ। তা না পারছেন গিলতে, না পারছেন ভুলতে। কোন বিষয় পুরোপুরি বুঝে গেলে যেমন কোন সমস্যা নেই, তেমনি একেবারে না বুঝলেও কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এই “শুনতে পাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না”- এরকম হলে যে কি ঝামেলা, তা নির্মল বাবুর মতো অবস্থা না হলে বোঝা দুষ্কর। ব্যাপারটা কি সেটাই তো বলা হয়নি।
কয়েক দিন আগে মাঝরাতে নির্মলবাবুর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।

রোজ রাতেই একবার অন্তত ঘুম ভাঙ্গে বাথরুম যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন ঘুম ভাঙ্গার কারণ ছিল অন্য। তিনি প্রতিদিন রাত ১১ টায় শুয়ে পড়েন, ওঠেন ওই ৬ টা নাগাদ। ঠিক সিনেমার ইন্টারভ্যালের মতো সাধারণ ভাবে রাত আড়াইটের সময় ওনার বাথরুম যাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু সেদিন ঘড়ি দেখলেন, রাত সাড়ে বারো টা। কে যেন কানের কাছে বলে উঠেছিল, “কাজটা কি ঠিক হলো?” একদম তড়াক করে চমকে উঠে বসেছিলেন বিছানার উপর। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন খানিকক্ষণ, ঘরে স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। ঘরের দরজাও ঠিকঠাক বন্ধই আছে। তবে কে কানে কানে ওই কথা বলল! অগত্যা কোন যুক্তি খুঁজে না পেয়ে মেনে নিয়েছিলেন, স্বপ্নই হবে! তারপর থেকেই আরো কয়েকবার হঠাৎ হঠাৎ ওই একই কথা শুনেছেন। সেগুলো অবশ্য সব ঘুমের মধ্যে নয়। রীতিমত সজাগ জাগ্রত অবস্থায়। কন্ঠস্বরটা খুব চেনা চেনা। কিন্তু নিশ্চিত করে বুঝতে পারছেন না কার! আর প্রকাশ্য দিবালোকে ঘাড়ের কাছে ভূত নিশ্চয়ই ঘুরে বেড়াবে না। ঘটনাটা বারবার ঘটতে থাকছে। ভাবছেন ডাক্তার দেখাবেন, মনের রোগ হয়ে গেল নাকি কে জানে!

ধীরে ধীরে রোগটা বাড়তে শুরু করলো। আগে মাঝে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ হচ্ছিল। এখন খুব ঘন ঘন হচ্ছে।
এমনিতেই অফিসের জন্য তাড়াহুড়ো লেগেই থাকে সকালে। কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়লেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছেন। একটাও রিক্সা নেই। ঠিক দরকারের সময় পাওয়া যায়না। সিগারেট শেষ হলো তবু রিক্সার দেখা নেই। অগত্যা সিগারেট টা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে হাঁটতে উদ্যত হলেন, এমন সময় কানের কাছে, “কাজটা কি ঠিক হলো?” অসহ্য তো। কি কাজ, কোন কাজ ঠিক হলো না! আর বলছেই বা কে! বিরক্তিতে ভরে উঠল মনটা। উপদ্রবকারীকে দেখা গেলেও না হয় কিছু প্রতিকার করা যেত কিন্তু এ যে অদৃশ্য। আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন।

স্টেশনে পৌঁছে দেখলেন ট্রেন ঢুকছে, অসংখ্য যাত্রী অপেক্ষা করছে প্ল্যাটফর্মে। মান্থলি টিকিট টা দিন তিনেক হলো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু রোজই দেরি হয়ে যাচ্ছে স্টেশনে পৌঁছাতে। আজও কাটা হলো না। এখন টিকিট কাটতে গেলে ট্রেন মিস হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই অনন্যোপায় হয়ে দৌড় লাগালেন। ওনার থেকে বেশি শক্তিশালী লোকজন ওনাকে আর উনি ওনার থেকে কম শক্তিশালী লোকজনকে গোত্তা মারতে লাগলেন। মধ্য মানের স্বাস্থ্য আর শক্তিসম্পন্ন হওয়ায় ট্রেনের কামরার মাঝামাঝি সেঁধিয়ে গেলেন। কিছু স্থূলকায় আর কিছু শীর্ণ লোক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্ল্যাটফর্মে। ভিড়ের মাঝে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছেন। সহ্যের একটা সীমা আছে। একজন লোকের কনুইয়ে মাথা টা ঢুকছে ক্রমাগত। মৃদু প্রতিবাদ জানালেন। ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, “Sorry দাদা”; কিন্তু তাতে ঠিক মন ভরলো না তাঁর। লোকটার মুখ দেখেই বিরক্ত লাগছে। ঠেলা গুঁতো মেরে তাকে আরো ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেন। লোকটা নিজের কুৎসিত মুখ আর বিরক্তিকর কনুই একদিকে আর পা দুটো আরেকদিকে করে কিছুটা ঝুলন্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো। নির্মল বাবু একটু থিতু হলেন বটে, তবে ভিড়ের কোলাহলের মধ্যে হঠাৎ কানের কাছে আবার সেই কথা, “কাজটা কি ঠিক হলো?”

এমনিতেই মাথা গরম ছিল, তারপর রোগের প্রকোপ বাড়ায় আরো বিরক্ত হয়ে পড়লেন নির্মলবাবু। অফিসে এসেও কাজে মন বসছে না। পাশের টেবিলের দত্ত বাবুর সাথে একথা সেকথা শুরু হলো। কিছুক্ষণ পর দাস বাবুর দিকে নজর গেল। গলায় তুলসীর মালা, কপালে তিলক, স্বল্পভাষী, শান্ত শিষ্ট স্বভাবের মানুষ দাস বাবু। মাঝে মাঝে ওনার এই ধার্মিক বেশ ভূষা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করলেও কখনো বিদ্বেষ করেননি নির্মল বাবু। আজ নিজের মনে এই অদ্ভুত অশান্তির কারণেই কিনা কে জানে, দাস বাবুর এই শান্ত স্বভাব দেখে তাঁর মনে জ্বলন হলো। তিনি দাস বাবুকে শুনিয়ে শুনিয়ে, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ”, “বিড়াল তপস্বী”, “বক ধার্মিক”, “যারা বেশি ধর্ম ধর্ম করে সেই লোকগুলো পাকা শয়তান” জাতীয় নানারকম কটূক্তি করতে লাগলেন। উপযুক্ত সঙ্গত দিলেন দত্ত বাবুও। দাস বাবু অপমানিত বোধ করলেন, কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। দত্ত বাবু ফিসফিস করে বললেন, “ডোজ বেশি হয়ে গেল মনে হচ্ছে মশাই!” নির্মল বাবু নিজের সপক্ষে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তারপর আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলেন। ভাবলেন এবার কাজ শুরু করবেন, কিন্তু ঠিক তখনই আবার সেই কন্ঠস্বর, “কাজটা কি ঠিক হলো?” চুপ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে ফিরে এলেন। একটা কাজ কিছুটা শুরু করেছেন, এমন সময় ফোন। স্ত্রী ফোন করছেন। নিশ্চয়ই কিছু কিনে আনার কথা বলবে। ভালো লাগছে না এখন এসব। ধরলেন না। আবার ফোন। এবার ধরতেই হলো।
-“হ্যাঁ বলো!”
-“সর্বনাশ হয়ে গেছে। বিল্টুর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। খুব চোট লেগেছে। রক্ত বেরোচ্ছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না..তুমি কিছু করো।”
-“হ্যাঁ! সে কি! কাউকে বলো না একটা এম্বুলেন্স … পাশের বাড়ির বৌদিকে বলে … আচ্ছা আমি যাচ্ছি …”
বিল্টু ওনার ছেলে। এমন অঘটনের খবর পাবেন একটু আগেও ভাবেন নি। কতটা চোট লেগেছে ছেলেটার! কি হয়েছে কে জানে! হাত পা কাঁপছে। কোনরকমে একটা গাড়ি ডেকে বেরিয়ে পড়লেন। এম্বুলেন্স ডাকতে হবে। কাউকেই ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। বড় অসহায় লাগছে নিজের। নানারকম দুর্ভাবনা এসে ভিড় করছে তাঁর মাথায়। বেশ কিছুক্ষণ পাগলের মতো একে ওকে ফোন করার চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিলেন। এমন সময় আবার ওনার স্ত্রীর ফোন, -“বিমলা বৌদি মুখার্জীদাকে বলে গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। তুমি নার্সিংহোমে চলে এসো।” বলেই কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিলেন নির্মলবাবুর স্ত্রী। তিনি নার্সিংহোমে পৌঁছানোর আগেই বিল্টু কে ভর্তি করা হয়ে গেছিল।

একটা ঝড় বয়ে গেল ক’দিন। ডাক্তারবাবু আশ্বস্ত করেছেন আর তেমন ভয়ের কিছু নেই। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। বিপদের সময় মুখার্জীদা আর বিমলা বৌদি যা করলেন, তা সত্যিই ভোলা যায় না। কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন, সেটা বুঝতে পারছেন না নির্মলবাবু। মনে পড়লো, কয়েক মাস আগের এক রাতের কথা। এই মুখার্জীদা বারবার ফোন করছিলেন মাঝ রাতে। ফালতু ঝামেলা ভেবে ফোন ধরেননি নির্মলবাবু। কিছু বিপদ হতে পারে সে কথা মনে এলেও পাত্তা দেন নি। কেবল মনে হয়েছে, “দরকার ছাড়া কথা বলে না,” “বড়লোক, টাকার অহংকার,” “যা হয় হোক, কাল বলে দেব ঘুমিয়ে গেছিলাম, ফোন সাইলেন্ট ছিল, বুঝতে পারিনি” ইত্যাদি। পরেরদিন জানতে পারেন, বিমলা বৌদি খুব অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে কাল রাতে। একা মানুষ মুখার্জী বাবু সেই জন্যই হয়তো সাহায্য চাইছিলেন ফোন করে। একটু খারাপ লেগেছিল নির্মলবাবুর, কিন্তু তারপর ভেবে নিয়েছেন, যা হবার তো হয়েই গেছে। আর কি! সেই মুখার্জীদা আজ ঠিক সময়ে এভাবে এগিয়ে না এলে হয়তো কোন অঘটনও ঘটতে পারতো। খুব খারাপ লাগছে আজ নির্মলবাবুর। নিজেকে বড্ড সঙ্কীর্ণ আর স্বার্থপর মনে হচ্ছে। লজ্জায়, অনুশোচনায় দুচোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। অন্যের কাছে বড় হবার আনন্দের চেয়ে নিজের চোখে ছোট হয়ে যাওয়ার কষ্ট টা অনেক বেশি, এটা আজ ভীষণ ভাবে বুঝছেন নির্মলবাবু। এখন এও মনে পড়ছে, সেই রাতের ঘটনার পর মাঝে মাঝেই তাঁর ফোন না ধরার কথাটা মনের মধ্যে তোলপাড় হয়েছে, কিন্তু জোর করে তাকে অগ্রাহ্য করেছেন। নাহলে বড় অশান্তি হচ্ছিল যে!

বিল্টু বাড়ি ফিরলো। এখন অনেক সুস্থ সে। নির্মল বাবু অফিসের জন্য তৈরী হলেন। খেতে বসে বললেন, “কুমড়োর তরকারী টা বড় ভালো হয়েছে।” স্ত্রী হাসলেন। নির্মল বাবুও। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে অফিসের জন্য বেরোলেন। একটাও রিক্সা নেই। সিগারেটটা ধরিয়ে একটু অপেক্ষা করলেন। তারপর অগত্যা হাঁটা দিলেন। সিগারেট টা নিভিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন নির্মল বাবু। একটা অর্ধনগ্ন বাচ্চা হাত বাড়িয়ে পয়সা চাইলো। ঘড়িতে দেখলেন, অনেক সময় আছে। কাছাকাছি একটা খাবার দোকানে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন বাচ্চাটাকে। আজ সময়ের আগেই স্টেশনে এসেছেন। ট্রেন আসতেই ধস্তা ধস্তি করে উঠতে হলো। সামনে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ভদ্রলোককে বললেন, “আপনি এই জায়গাটায় হাত রাখতে পারেন, একটু সুবিধা হবে।” ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, “thank you দাদা।” অফিসে সময়ের আগেই পৌঁছলেন। দাস বাবু ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। নির্মল বাবু ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে দাস দা।” দাস বাবু শিশুর মতো হেসে উঠলেন। অফিসে join করেই নির্মল বাবু ওনার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন সেদিনের ব্যবহারের জন্য কিন্তু মুখার্জীদার কাছে এখনও ক্ষমা চাইতে পারেননি। মনে মনে ভেবে রেখেছেন, কোনদিন যদি কোন উপকারে লাগেন, তবে নিজেকে ধন্য মনে করবেন।

না, আর সেই কন্ঠস্বর তিনি শুনতে পাননি। এখন কিছু করার আগে নিজেই নিজেকে বোঝান, “কাজটা ঠিক হচ্ছে তো?” এখন এও বুঝতে পারছেন কন্ঠস্বরটা আগন্তুক ছিল না! এখন দাসদার মত তিনিও বড় শান্তিতে আছেন। শুধু পথ চলতি অগণিত মানুষের দিকে তাকিয়ে ওনার মনে হয়, এত কোলাহল চারিদিকে, এত শব্দ, এত ব্যস্ততার মাঝেও একটা কন্ঠস্বর কিন্তু ভেসে চলেছে প্রতিনিয়ত; কেউ সেটা শুনতে পায়না, কেউ আবার শুনতে চায় না। এমন সময় পেটে একটা কনুইয়ের খোঁচা খেলেন নির্মলবাবু। সামলে নিয়ে একটু সরে দাঁড়ালেন। কনুইয়ের মালিক জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু কি বললেন?” তিনি হেসে জবাব দিলেন, “কই না তো!” ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে বিড়বিড় করে বললেন, “কে যে বললো!” মনে মনে হাসতে থাকেন নির্মলবাবু, তবে কি উনিও শুনলেন সেই কন্ঠস্বর, “কাজটা কি ঠিক হলো?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত