আমার সারাদিনের একাকিত্বকে ঘুছিয়ে অবশেষে কলিংবেলটা বেজে উঠে৷ রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গলায় ঝুলানো পাতলা গামছা দিয়ে মুখে জমে থাকা ঘামগুলো মুছে দরজাটা খুলি আমি৷ বৌ এর হাত থেকে অফিস ব্যাগটা নিয়ে সোফায় রাখি৷ তারপর যেই গামছা দিয়ে বৌ এর কপালের ঘাম মুছে দিব, বৌ চ্যাত করে উঠলো৷
বৌ এর হুংকারে আমি দু’কদম পিছিয়ে গেলাম৷ বৌ আমার সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে৷ আমি চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকি৷
আমার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বৌ হুংকার দিয়ে বলল,
-হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়!
বৌ এর হুংকারে কেঁপে উঠলাম একটু৷ বৌ এর মেজাজ খারাপ থাকলে অফিস থেকে এসে এভাবেই ঝাড়ে আমাকে৷
আমি চুপচাপ ঠান্ডা পানির গ্লাসটা বৌ এর দিকে এগিয়ে দিলাম৷ ঢকঢক করে পানিটুকূ গিলে বৌ আবার চোখ বন্ধ করে থাকে৷
আমি বৌ এর অফিশিয়াল শার্টটা খুলতে যেই এগিয়ে যাব৷ বৌ হাতের ঈশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-এতো সেবার দরকার নেই৷ যা রান্না ঘরে যা৷
বৌ এর এহেন কথা শুনে আবারো মন খারাপ হয় আমার৷
চোখগুলো টলমল করে উঠে৷ রান্নাঘরে ঢুকেই হুরহুর করে জড়ে পরে আমার চোখের পানিগুলো৷
পরে মনকে এই বলে শান্তনা দিলাম, সবার কপালে সুখ থাকে না রে পাগলা৷”
চোখের জলগুলো মুছে আবারো রান্নায় মনোযোগ দিলাম৷
কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পরলো৷ আমার বৌ ডাকছে৷
বেসিনে গিয়ে মুখ ধুঁয়ে বৌ এর সামনে গেলাম৷ ভেবেছিলাম ঝাড়িগুলোর বদলে একটু আদর করবে৷
সেই আশায় ঠান্ডা জল দিলো বৌ এর রাগি মুখখানা৷
হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে লম্বা একটা সুখটান দিলো বৌ৷ তারপর ধোঁয়াগুলো ছেড়ে দিয়ে বলল,
“লান্ঞ্চের বিরিয়ানীতে লবণ কম হয়েছে সেটা জানিস হতভাগা? আমার পাশের ডেস্কের সবিতা ভাবী কি পঁচাটাই না পঁচালো আমাকে৷
অফিসের সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে,
তার স্বামী নাকি বিরিয়ানী রান্নাতে সেরা৷ শুধু বিরিয়ানী না৷ সবকিছুতেই তার স্বামী সেরা৷ তার স্বামীর হাতে বানানো আলুবর্তা নাকি তোর হাতের বিরিয়ানীর চেয়েও মজাদার!”
তুই আমাকে আর কত জ্বালাবি হতভাগা৷ তোরমতো একটা রান্না না পারা ছেলেকে কিভাবে আমার মা-বাবা পছন্দ করেছে সেটা আমার মাথায় আসে না!
বাবাকে কত করে বলেছিলাম,
-বাবা সবে চাকরীটা পেয়েছি৷ আমি জীবনটা কিছুদিন উপভোগ করতে চাই!
কিন্তু বাবা আমার কথার পাত্তা দেয়নি৷ তোর মতো ছেলেকে আমার ঘাঁড়ে ছাপিয়ে দিয়েছে৷”
বৌ এর ঝাড়িগুলো মাথা নিচু করে শুনি আমি৷ আমার প্রচন্ড মন খারাপ হয়৷ এই মূহূর্তে আমার কি করা উচিত৷
বৌ আবার সিগারেট টানায় মনোযোগ দিল৷
আমি মিনমিন করে বলি,
-চা আনবো?
আমার কথা শুনে বৌ হো হো করে হেসে বলল,
-দুপুরের বিরিয়ানী খাইয়ে মাথা নষ্ট করেছিস আমার৷ এখন চা খাইয়ে মারারা ধান্দা করছিস নাকি?
তোর বাবা যদি ১কোটি টাকা কাবিন না দিয়ে বিয়ে দিতো৷ তাইলে অনেক আগেই ঘাড় ধরে বের করে দিতাম তৌকে৷”
বৌ এর কথাশুনে আমি আস্তে করে রুম থেকে বেরিয়ে পরি৷ তারপর রান্নাটা শেষ করে রুম বেঁধে কান্না শুরু করে দিলাম৷ কান্নাটা ঠিকমতো জমছে না৷
বাবার বাড়ি থেকে দেয়া কোলবালিশটা বের করে সেটা জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলাম৷
কাঁদতে কাঁদতে কবে ঘুমিয়েছি খেয়াল ছিল না৷ ঘুম ভাঙল রুমের দরজায় ঠুকঠাক আওয়াজে৷
ভালোমতো হুশ ফিরতেই ভয় ঝেঁকে ধরে আমাকে৷ বৌ আমাকে কতক্ষণ ধরে ডাকছে আল্লায় জানে৷ অসময়ে ঘুমিয়েছি জানলে খুন করে ফেলবে৷
ধুরুধুরু বুকে দরজাটা খুললাম৷ আমাকে অবাক করে দিয়ে বৌ একটা হাসি দিল৷
আমার মনটা হুট করে ভালো হয়ে গেল৷ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি বৌ আমার খাবার টেবিলে বসে আছে৷
আমি গিয়ে ভাত তুলে দিই প্লেটে৷ সাথে বৌ এর পছন্দের তরকারীগুলো৷
ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে বৌ আমার দিকে হাসি মুখে তাকালো৷ আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠে তখন৷
অবশেষে বৌ কে খুশি করতে পেরেছি রান্না খাইয়ে৷
বৌ আমার রান্না খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল,
-তুমিও খেয়ে নাও৷ তারপর টিভির রুমে আসো৷ নাটক দেখবো৷
খুশিমনে আমিও খেতে বসে পরি৷ ভাতের প্রথম লুকমাটা খেয়েই বুঝলাম,
কপালে আমার খারাপি আছে৷ লবণ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, মরিচটা একটু বেশি হয়েছে৷ মাঝে মাঝে হলুদের গন্ধও লাগছে৷ সব মিলিয়ে বিদঘুটে একটা রান্না৷
তারপরও নিজের রান্না বলে খেয়ে নিলাম৷
খাওয়া শেষে টিভির রুমে যেতে ভয় লাগে আমার৷ পরক্ষণেই মনকে বুঝায়,
-আমাকে ভালোবাসে বলেই হয়তো বৌ আমার সবকিছু হাসি মুখে খেয়ে নিয়েছে৷
রুমে ঢুকতেই বৌ হাসিমুখে তার কাছে ডাকলো৷
একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো৷ আরেকহাতে কফির মগ৷
অর্ধেক খাওয়া কফিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল৷ আমি হাসিমুখে খেয়ে নিলাম৷ বৌ এর ভালোবাসা মাখানো কফি বলে কথা৷
খেয়েই মাথাটা ধরে আসলো৷ চোখ দু’টো টুপ করে বন্ধ হয়ে ঘুম ঝেকে বসে আমার মাথায়৷
ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার হাত-পা রশিতে বাঁধা৷ একদম শক্ত বাঁধন৷
বৌ তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বিদঘুটে হাসি দেয় একটা৷
তারপর বলল,
-আমাকে ছাঁইপাশ খাইয়ে মারতে চাস তুই৷ আজ তোর মজা বের করবো৷ বৌ তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেট আমার মুখে কাছে আনে৷
আমার বুঝতে বাকি রইলোনা আমার মুখেই ছ্যাকা দিবে৷
আমি নাাাা অঅঅঅঅঅঅঅঅঅ….
বলে চিৎকার দিয়েই লাফিয়ে উঠি৷
নাহ৷ আশেপাশে কেউ নেই৷ এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলাম আমি! মাথার পাশে রাখা গ্লাসের পানিগুলো ঢকঢক করে গিলে ফেললাম৷
সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে আছে৷
স্বপ্নের দুনিয়ায় ছিলাম এতক্ষন৷
রুমের দরজা খুলে আমি গুটি গুটি পায়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালাম৷
লাইট জ্বালিয়ে রান্না ঘরের ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে অবনী৷ মেয়েটা আমার বিয়ে করা বৌ৷ বছরখানেক আগে মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করেছিলাম৷
মেয়েটাকে আমার সহ্য হয়না কেন জানি৷ রান্না বান্না পারেনা বললেই চলে৷ তারপরও আমার জন্য চেষ্টা করে৷ কতবার হাত পুঁড়েছে তার হিসেব নেই৷ কতবার সিগারেট দিয়ে গায়ে ছ্যাক দিয়েছি৷ তারপরও চেষ্টার কমতি নেই৷ তারপরও আমার মন গলাতে পারেনি৷ আজ রাতে ঘুমানোর আগেও বকেছিলাম৷ থাপ্পর দিয়ে গাল লাল করে ফেলেছিলাম৷
ভালোভাবে লক্ষ করলাম,
গোলগাল চেহারার মেয়েটার মুখে মায়া মায়া ভাব আছে একটা৷ যা এতোদিন চোখের আড়ালে ছিল আমার৷ এই মূহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে৷
আমি আলতো করে অবনীর গালে হাত রাখি৷ ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটা অস্পষ্ঠভাবে চোখ মেলে তাকালো একবার৷ আবার ঘুমিয়ে পরে৷
পরক্ষণে আবার তাকিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে৷
চোখ দু’টো বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা৷
তার হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না৷
আলতো করে অবনীর কপালে চুমু খাই একটা৷ অবাক চোখ আর লজ্জা রাঙা মুখ মিলিয়ে অন্যরকম দেখাচ্ছে মেয়েটাকে৷
অবনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-মাফ করে দাও মেয়ে৷ আজ থেকে বুকে থাকবে৷ জীবনের শেষদিনটা পর্যন্ত ভালোবেসে যাবো৷ লবনবিহীন মরিচরাঙা তরকারীর সাথে ভালোবাসা মাখিয়ে খাবো আমরা৷ রাজিতো?
-হুম ১০০বার রাজি!
অমায়িক হাসি দিয়ে বলল অবনী৷
একটা মানুষকে আঘাত করার আগে ভেবে দেখুন, ঐ আঘাতটা আপনি সইতে পারবেন তো? উপরে একজন আছেন৷
যিনি বরাবরের মতই হিসাব মিলিয়ে দিবেন৷