অঙ্ক ও তার উত্তর

অঙ্ক ও তার উত্তর

অঙ্ক আমার কোনদিনই পছন্দের বিষয় নয় ৷ অথচ দুর্ভাগ্য এই যে খাতায় অঙ্কের হিসেবগুলো ঠিক মিলে যেত এবং পরীক্ষা নামক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কখনই আমাকে “অঙ্কে কাঁচা” বলে অভিহিত করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি ৷

আমার পছন্দের বিষয় ছিল সাহিত্য, কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্তীয় শিক্ষামনস্কতায় সেই ছেলেকে তখনই সাহিত্য নিয়ে পড়তে অনুমতি দেওয়া হয় যখন প্রমানিত হয় যে তার দ্বারা অঙ্ক বিষয়টি করায়ত্ত করা অসম্ভব এবং যতক্ষণ না পরীক্ষার নম্বর সেই ধারনায় সরকারী সিলমোহর বসাচ্ছে ৷ কতজনকে বলতে শুনেছি, “ছেলেটা না অঙ্কে কাঁচা, তাই ওকে আর্টসেই দিলাম বুঝলি?” কিম্বা “ওরে বাবা, ওসব অঙ্ক টঙ্ক আমার দ্বারা হবে না, আমার বাবা আর্টসই ভালো” ৷ অবশ্য শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কচকচানি করতে বসি নি , ওসব নিয়ে অনেক নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়ে গেছে, অনেক গুরুগম্ভীর সেমিনার আয়োজিত হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি ৷ আমি অঙ্ক নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলব ৷

পরমেশ্বরণ নামে এক দক্ষিন ভারতীয় ভদ্রলোক আমাদের অঙ্ক পড়াতেন, আড়ালে আমরা তাকে বাঘ বলে ডাকতাম৷ ভদ্রলোক এককালে সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন, মেজাজটা ছিল একবারে মিলিটারীয় এবং ক্লাসে ছিলেন সাক্ষাত যম ৷ আমার অবশ্য কোনদিনই পরমেশ্বরণকে পছন্দ ছিল না, কারণ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের সাথে ঐরকম ব্যাঘ্রসুলভ আচরণে কি বাহাদুরি ছিল আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি না ৷ যাইহোক, পরমেশ্বরনের অঙ্ক শেখানোর মন্ত্র ছিল নিয়মানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতা ৷ আমরা তখন অঙ্ক কষতাম চৌকো খোপের সেইসব খাতায়, একেকটা খোপে একেকটা সংখ্যা নিয়ে কারবার , তারপর তাকে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করে অবশেষে সেই কাঙ্খিত ম্যাজিক সংখ্যায় পৌছনো, যেটাকে বলা হত রেজাল্ট ৷ মাঝপথে কোনো ভুল হলে একটা সংখ্যায় পৌছনো যেত বটে, তবে তা কাঙ্খিত রেজাল্ট নয়, অতএব ভুল ৷ অবশ্য অঙ্কের এটাই নিয়ম, একই অঙ্কের কখনো দুটো উত্তর হতে পারে না ৷ পরমেশ্বরণ এই নিয়মের ব্যতিক্রম নন, তার কঠোর নির্দেশ ছিল পরীক্ষার খাতা যেন ঝকঝকে হয়, প্রত্যেকটা সংখ্যা এবং চিহ্ন যেন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ফলো করে, এর অন্যথা হলে ঠিক উত্তরেও নম্বর কাটা যাবে ৷ এবং এতসব পরেও যদি উত্তরটা শেষ লগ্নে গিয়ে ভুল হয়, তাহলে নম্বরের খোপে বসবে এক শুন্য ৷

স্যার রয় ছিলেন আমাদের অঙ্কের রবীন্দ্রনাথ ৷ “সায়েন্সের ছেলে” হবার দরুন বহুদিন অঙ্ক নিয়ে নাড়াঘাটা করতে হয়েছে, অনেকের ক্লাস করেছি, সবার প্রতি যথার্থ সন্মান রেখেই বলছি, ওনার কাছে যদি আরো কিছুদিন নাড়া বাঁধার সুযোগ হত, বিষয়টাকে হয়ত আরেকটু বেশি ভালবাসতে পারতাম ৷ স্যার রয়ের কোনো ধরাবাঁধা নিয়মের বিষয়ে ছুতমার্গ নেই , অঙ্কের নিয়ম মেনে উত্তরে পৌছতে পারলেই তিনি খুশি ৷ তদুপরি নিয়ম মেনেও যদি শেষবেলায় সামান্য হিসেবের ভুলে উত্তরটা বেঠিক হয়, তিনি সেই ভুলটা লালকালি দিয়ে সংশোধন করে পুরো নম্বর বসাতেও দ্বিধাবোধ করেন নি ৷

বহুদিন পর জীবনের খাতায় কিছু অঙ্কের হিসেব মেলাতে গিয়ে কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ৷ কোনটা আসল, উত্তরটা পৌছনোর পথ, নাকি উত্তরটা? শেষ লগ্নে যদি সামান্য হিসেবের ভুলে উত্তরটা ভুল হয়ে যায়, তাহলে নম্বর কত পাব স্যার ? ফুল মার্কস, নাকি শুন্য ?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত