দিনটা ভারী বিশ্রী।সেই কখন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই । থামবে কি- থামবে না বলাটা খুব মুশকিল । ফোটা ফোটা বৃষ্টির জল একনাগাড়ে পড়ছে ।মেঘাচন্ন আকাশ । চারদিক পুরো অন্ধকার।ম্লান পৃথিবী দেখে মনে হয় যেন মৃতের মত । ভাবলাম আনওয়ারের ওখানে গিয়ে সন্ধাটা কোনমতে কাটাতে পারলে বাঁচলাম।ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছে না।কেমন দমটা বন্ধ হয়ে আসচে ।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে চোখে পড়ল সাহিম,হুছাইনকে।
এবার একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। গল্প গুজবে বিকেলটা বেশ ভাল করে কাটাতে পারব ।
কিন্তু আনওয়ার আজ যেন কেমন হয়ে আছে।
সাহিম, হুছাইন হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে সন্দেহের চাপ। আমি কোনকথা না বলে চকির এক কোনে বসে পড়লাম। কেউ কোনো কথা বলছে না ।আমি তাদের মৌনতা ভাংবার জন্য একটা মিছা ঘটনা তুলে ধরলাম।
কেউ তাতে কোনো কৌতুহল প্রকাশ করল না।যেমন বসেছিল তেমনি উদাসীন ভাবেই মাতাটা নিচের দিকে ঝোকে বসে থাকল। আর সব কিছু স্তব্ধ। কোনো এক অজানা ব্যাথা তাদের মনের উপর চেপে বসে আছ।
কিছু একটা করে এই নিস্তব্ধতা ভাংতে হবে আমাকে ।
আজ আবিদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল রাস্তায় ।দেখতে অনেকটা হেভি লাগছিল। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর। একদম ফাটাফাটি।বিয়ে করে নেয় না ।
হুচাইন হা করে তাকিয়ে আছে । দেখে মনে হয় কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছে। আমি খুশি হয়ে আরও সুন্দর করে সাঁজিয়ে বলতে লাগলাম।
এতক্কন ধরে আমার কথাগুলো আনওয়ার মোটেই শুনেছে বলে মনে হয়না । এভাবে একা একা কতক্কন বানিয়ে গল্প বলা যায়। একটু বিরক্তের শুরে বললাম-” কি হয়েছে তোমাদের বলো তো ? মিছিমিছিই আমি একলা বকে মরছি ? ”
সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সাহিম একটু নড়েচড়ে বসল।
“মিছা বলার আর জাগা পাছ নানি । সেই কখন থেকে ….” – সাহিমের কথাটা শুনে আমার সব কথা গলায় আটকা পড়ল।
“কখন থেকে মিছা. . . আমার কানটা একেবারে ঝালা হয়ে গেছে ” – হুছাইন বলে উটল ।
এই মরলাম রে । এত সুন্দর করে একটা গল্প বলার পরও ওরা কিভাবে বুঝল আমি মিথে বলছি আমি ভেবে হয়রান ।
সাহিম এবার একটু নড়ে বসে বলল ” তুই কি জানিস না ও পালিয়ে গেছে ? ”
কে ? -আমি জিঙ্গেস করলাম ।
আবিদা – উত্তর শুনে আমার চোখ দুটো চানাবড়া হয়ে গেল ।
আমি অবিশ্বাস মাখা চোখে জিঙ্গেস করলাম ” কে বলেছে ?”
“কে আবার বলবে সবাই এ কথা জানে শুধু ব্যাতীক্রমি তুই । ” – সাহিম বলল ।
“ও জানবে কিভাবে,সারাদিন ঘরে বসে থাকে !”-হুছাইন বলল ।
এবার আমি আনওয়ারের সাটে খামচে ধরে বললাম, “থাক আর দুঃখ করে কাজ নেই।
কিন্তু খবরটা যে সাংঘাতিক, আমার ত বিশ্বাস হচ্ছে না। এমন আজগুবি গল্প কে তোমাদের সাপ্লাই করে ?”
হুছাইন দার্শনিকের গলায় বলল-” জগতে অবিশাস্য় বলে কিছু নেই । বরং এসব ঘটনা বেশী ঘটে। ”
সে তো বুঝেছি । কিন্তু ইস,ভাবতে পারছি না । সব কিছু কেমন যেন হয়ে গেল । রাস্তায় দেখা হলে কথা বলা ত দুরের,একবার চোখ তুলে দেখত না শেষে সেই ভাগল ।
কার সাথে ভাগল রে কিছু জানিস? না রে ও ভাগেনি -আনওয়ার প্রতিবাদ করে উটল ।
ভাগেনি, ঠিক বুঝলাম না?
ওর বিয়ে হয়ে গেছে ।
কি যা তা বলছ তোমরা আমি ত কিছু বুজতে পারছি না?
হুছাইন একটু অলঙ্কার দিয়ে কথা বলতে ভালবাসে। সে আক্কেপের সুরে একটু গভীরতা মিশিয়ে বলল – ” বেচারা কপালটাই খারাপ নইলে এমনটা হওয়ার কথা নয় ।
বাদ দে এসব কথা। সাহিম তুই ঠিক শুনেছিস। মানে খবরটা ভুল বাল নয়তো?
আরে আমরা কোনো ভুল খবর পরিবেশন করিনা । আর বুঝতেই ত পারছিস বেছারার মুখের দিকে চেয়ে ।
হে ,আমার ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে।
আহারে , কি সুন্দর নাম ছিল আ-বি-দা “- হুছাইন বলে উটল।
এখন কি করবে ? – আমি জিঙ্গেস করলাম ।
কি আর করব যা হবার তো হয়েই গেছে ।শুধু এই টুকু করা যাবে- ওর বাড়ীতে গিয়ে খবরা খবর জেনে আসা যাক।
আক্কেপ হতাশা , বিস্ময় আনওয়ারের লাভ স্টরি যেন কিছুতেই ফুরাতে চায়না ।
মাস ছ’য়েক হবে।আবিদার সাথে আনওয়ারের প্রথম পরিচয় হয় ।স্কুলে যাওয়া-আসার সময় আনওয়ার দাড়িয়ে থাকত রাস্তার পাশে । প্রিয়তমাকে এক পলক দেখার আসায় ।
কত দিন কত রাত নিরবে বসে ভেবেছে প্রিয়তমার কথা তার কোনো হিসেব সে রাখে নি ।
অনেক চেষ্টা করে বলতে পারেনি তার ভালবাসার কথা !
সেদিন গিয়েছিল সাহস করে । কিন্তু মনের কথা আর বলা হল না । মেয়েটি আগে থেকেই দাদা বলে ডাক দিয়েছিল । আকাশ পড়ে গিয়েছিল তার মাথার উপর । কোনমতে নিজেকে সামলে ছুটে এসেছিল ।
সেদিন থেকে আড়ালে লুকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি সে ।
মেয়েটি তার দিকে তাকাত না এমন নয় । দেখে মনে হত সে ও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। তার মনে বোধহয় কিছুটা প্রেম জেগে উটেছিল । মেয়েটি তার চোখের সামনে দিয়ে বারবার ঘুরে বেড়াত। কিছু একটা বলার চেষ্টা করত । তার চোখে মুখে ছিল একটা আতঙ্কের চাপ । দেখে মনে হত কোনো এক অজানা ব্যাথা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ।
” চলো চা খেয়ে আসা যাক”- হুছাইন প্রস্তাব রাখল ।
বাইরে বেরিয়ে দেখি সাব্বির । সাব্বিরের চোখ মুখ লাল । বিন্দু বিন্দু জলের ফোটা তার মুখে ।সাব্বির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। বলল – যা শুনলাম তা কি সত্যি ?
কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না । ঘর থেকে বের হয়ে বড় রাস্তা ধরে পূব দিকে হাঁটা ধরলাম । খানিক্কন হাটার পর একটি চায়ের দোকান পেলাম। জমির চা – র চায়ের দোকান ।
হুছাইন চায়ের অর্ডার দিল ।
মিনিট পাঁচেক পর চা আসল । আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত নয়টা। অনেক রাত হয়ে গেছে । বাড়ী ফিরতে হবে। আমি চায়ের কাপ টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হঠাত বিয়ের বাজনা শুনতে পেলাম । অনেকে হয়তঃ.বাজনার তালে তালে নাচছে । কিন্তু কে জানে হয়তঃ এই বাজনার তালে তালে হারিয়ে যাচ্ছে দুটি হৃদয়ের লুকানো অনেকগুলো কথা । পেছনে ফিরে দেখলাম আনওয়ার ধীরে ধীরে অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ।