​ক্যাকফনি

​ক্যাকফনি

সেবার বীরভূম বেড়াতে গেছিলাম । শান্তিনিকেতনে যাওয়ার উৎসাহ কোনদিন-ও ছিল না (মা কে বলি নি যদিও) , যাওয়ার কারণ ছিল মূলত দুটো ।প্রথমত , সেই নদীটার পারে প্রাণের গান শোনা যেত , এবং দ্বিতীয়ত ভারত সেবাশ্রমে থাকা । দ্বিতীয়টায় অবাক হচ্ছেন জানি , কিন্তু ওইটাই মূল আকর্ষণ । আমি শত্রুর ভাত খেয়ে, শত্রুর মুখ চিনতে গেছিলাম ।আমার চারআনা পড়াশুনা শিখিয়েছিল , শত্রুকে মারতে হলে , তার মুখ চিনতে হয় । জায়গাটা ঠিক শান্তিনিকেতনে নয় , পরে জেনেছিলাম জায়গাটার নাম মুলুক ।

তা ভারত সেবাশ্রমের তৎকালীন ‘ ভারতীয় কাল্‌চার ‘ জানা সর্বেসর্বা তার ব্রহ্মচর্যের আগে যাদবপুরে থাকতেন । তা তিনি , জাগতিক আনন্দ থেকে সম্পূর্ণ বিমূখ তিনি , তৃতীয় স্বর্গে সপ্তম মেঘে যার বাস তিনি , আমার বাড়ির পথ চিনতে বি.দাশগুপ্তকে ল্যান্ডমার্ক ধরলেন । যাদবপুরিইয় বা তদসম-তদ্ভব অঞ্চলের বাইরের মানুষদের সুবিধার্থে জানাই , বি দাশগুপ্ত অঞ্চলের সর্বশ্রেষ্ঠ মদের দোকান । দশমি,কালীপূজোর এবং ভোটের আগের দিন মোটামুটি সেলিম্পুর থেকে ঢাকুরিয়া অব্দি লাইন পরে । ব্রহ্মচারী উনি , ওইটাই ঠিকঠাক ল্যান্ডমার্ক ধরেছিলেন ।

সে যাই হোক , দুপুর বেলায় হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছে ছাওয়া ধু ধু জমি দেখতে পাই আশ্রমের থেকে ঠিক দু মিনিট দূরে । স্বভাবসুলভ জানার তাড়নায় , জমিটায় ঢোকার মুখেই একটি বাচ্চা ছেলে পথ আটকে দাঁড়ায় । ” এখানে আমার বাপ-দাদা শুয়ে আছে ,এটা বেড়ানোর জায়গা নয়” , গম্ভীর কিশোর কণ্ঠ পিছিয়ে আসতে বাধ্য করে ।

ভাগ্যিস হাতে শহুরে ক্যামেরা ছিল । ছোপ ছোপ গাল ,নাকে শিকনি, ফোকলা দাঁতের দু-তিন ফুটরা জুটে যায় । সক্কলের মুখের হাসি একরকমের , হাঁসিতে ধর্ম আলাদা করা মুশকিল । একমাত্র জল চাইলাম যখন , তখন একজন পানি আর একজন জল আনতে তাদের ঘর ছুটলেই বুঝে ছিলাম , হাসি বাঁ উচ্চতা এক হলেও আশ্রমের চোখে এরা আলাদা।

সমস্ত খেলার মধ্যে , টেবিল টেনিস আর ভলিবলটা আমি মোটামুটি খেলে দিতে পারি । বিকেল বেলা সেবাশ্রমে ফিরে দেখলাম , মাঠে ভলি খেলা হচ্ছে । তো আমি আর আমার বন্ধু খেলতে শুরু করলাম । মিথ্যে বলব না ,দুজনে বেশ ভালোই খেলেছিলাম । নীল বেশ লম্বা , নেটে ভালোই খেলে, আর আমি থার্ড কোর্ট(পাড়ায়)…উলু বনে মিডল ম্যান( ডাইভ ভালো মারতাম , যে কোন বিষয় ) ।

খেলার সময় একটা ১২-১৩ বছরের বাচ্চা বার বার চোখ টানছিল । খেলতে একদম জানে না, কিন্তু ঠিক বলের কাছে পৌঁছে গিয়ে বল তুলে দিচ্ছিল । দারুণ ফিটনেস । খেলার পর, টিউবওয়েলে পা ধুতে গেলাম যখন , ছেলেটা কল টিপছিল । নাম জোসেফ । বন্ধুত্ব করে ফেললাম । বললাম তোর গ্রামটা দেখা । ও বলল “আগে ভজনটা হয়ে যাক , নইলে খেতে পাব না ”

সন্ধ্যা নেমছে । ওই অঞ্চলে আশ্রমে গোটা দশেক টিউব এবং আশে পাশের গ্রাম গুলোতে গোটা ৫এক ৬০ ওয়াটের বাল্ব ছাড়া কিস্যু জ্বলত না । সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় নিকষ অন্ধকার , একটা তেলেভাজার দোকানের সামনে বসে , গ্রামের বুড়োদের গল্প শুনছিলাম । বয়স্ক মানুষদের নিজেদের মধ্যে গল্প, তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শুনতে বেশ লাগে । তা হঠাতি ভজনের আওয়াজ শোনা গেল । আশ্রমের ভিতরে ঢুকে দেখি , মা সহ সব ভক্তরাই ভক্তি ভরে গান শুনছে । কনকনে শীতে , গায়ে চাদর জড়িয়ে গান গাইছে ,শাওতালি বাচ্চারা। বয়স ৭ থেকে ১৩ , বেশীর ভাগ আশেপাশে খোঁচাখুচি করছে, খরগোশের মতো সাদা সাদা দাঁত বের করে, কালো মুখে এক একটি পোট্রেট হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে । আমাদের জোসেফ ( ১৩ বছরের ভলি মাঠের বন্ধু) , তাদেরি মধ্যে একটি মুখ । বার বার ,মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ,অদ্ভুত সারল্যে হেসেই যাচ্ছে। সাধারণত নাগরিক আমরা এতো সহজে হাসতে পারি না , অবশ্য নাগরিক আমার এই ধারনাটা আমার-ই এক কমরেড অক্লেশে ভেঙ্গেছেন বেশ কিছুমাস হল…অবশ্যি তিনি কলকাতার নন ,তবে নাগরিক বটে । বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে অবিরাম আরতি করে যাচ্ছে , আর বাকিরা বিরিবির ,এভাবেই ভজন শেষ হল । তারপর খাবার ঘরে একটা লম্বা লাইন । আমি বাইরে এসে গোল্ডফ্লেক ধরালাম । হঠাত হাতে একটা নরম হাতের ছোঁয়া । এক হাতে শালপাতায় মোড়া খাওয়ার ,জোসেফ আমার হাত টানছে ।

জোসেফের বাড়িটা গ্রামের একদম মাঝখানে । পাতকুয়া থেকে পুকুর অব্দি সব দেখিয়ে , এ গলি ও গলি ঘুড়িয়ে যখন বাড়ি নিয়ে এলো, ততক্ষনে আমি দেখে নিয়েছি প্রতিটাবাড়ির দরজায় ক্রস ঝোলানো । সন্ধ্যায় , বুড়োদের আড্ডায় বসে জেনেছিলাম, পাকা রাস্তা থেকে লাল রাস্তায় ঢোকার মুখে প্রথম গ্রামটা হিন্দু,ডানদিকেরটা মুসলমান এবং সেবাস্রমের পাশের দুটো সাওতালি গা ক্রিশ্চান । বুঝতে অসুবিধে হল না , কেন ঠিক এখানেই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ ।

তা আমি আর নীল বাড়িতে ঢুকলে , জোসেফের দাদু আমাদের মহা সমাদরে বসতে দিলেন তার খাটিয়ায় । জোসেফের মা কোলের বাচ্চাটকে কোনক্রমে ওর দিদির কোলে দিয়ে দৌরে ভেতরে চলে গেলেন । দাদু জিজ্ঞেস করলেন ” একটু চা খেয়ে যাবেন, আমাদের বাড়ি ?” কোন ভেজাল ছিল না , নাতির অসম বয়িসী বন্ধু ,’ভিনদেশী’ নাগরিকদের প্রতি অকৃত্রিম আতিথেয়তাও বলতেই পারি । জোসেফের মা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে জোসেফের হাতে কিছু একটা দিলেন । জোসেফ-ও হুট বলতেই ছুটে পালাল । ওদের বাড়িতে চিনি ছিল না । দাদু জানালেন, সবাশ্রম সাঁওতাল বাচ্চাদের ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়ায় , তারপর ধর্মান্তরের চেষ্টা করে। যারা হিন্দু হয় না , তাদের তাড়িয়ে দেয় । যারা ধর্মান্তরিত হয়, তারা খাওয়া পড়া পায় । জোসেফের দাদু জানিয়েছিলেন , জোসেফ ধর্মান্তরিত হবে না । জোসেফ জানিয়েছিল , ও অঙ্কতে ভালো ,ইংরিজিটা তেমন পারে না ।

তারপর যা হয়ে থাকে । নীল জোসেফের বোনকে কোলে নিল । আমি ছবি তুললাম । চিনি এলো । চা খেলাম । বেড়িয়েও এলাম । ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটছি , হঠাতি কানে এলো বাঁদিকের গ্রামটা থেকে সন্ধ্যের শঙ্খের আওয়াজ , প্রায় একি সাথে ডানদিকের গ্রামটা থেকে আজান ভেসে আসতে শুরু করল । রুপকথায় এমন হয় বোধহয় , সাঁওতাল গ্রামটায় বহু বহু দূরে দ্রিম দ্রিম শব্দে ধামসা বাজল । যে সেদিন ঐ নিকষ কালো রাতে ,অসংখ্য তারার নীচে,লাল কাঁকড়ে দাঁড়িয়ে ওই অদ্ভুত ক্যাকফনি শোনেনি, তাদের প্রত্যেকের জন্য খারাপ লাগে । সন্ধ্যে ভালো লাগলেই নাগরিক আমি ,নাগরিক কবিয়ালের “সন্ধ্যে হল,সন্ধ্যে হল ” গানেই অভ্যস্ত। এই অদ্ভুত সুরটা অচেনা হলেও ‘ছোঁয়াচ’ লাগে । প্রতিটা আলাদা সুর , প্রতিটা আলাদা তাল , কিন্তু কেউ কাউকে কাটছে না-কেউ কাউকে ছাপিয়ে যাচ্ছে না। হয়ত আমার কানটাই গণ্ডগোলের ,কিন্তু সেদিন আমি কোন সুর কে কাউকে ছাপাতে শুনিনি , একটি অন্যটিকে আরও বেশী ভরাট করে তুলেছিল বোধহয়।

পরদিন সকালে (আগন্তুক আমি) জোসেফকে বলেছিলাম , ” তোদের কোন পরব আছে নাকি রে ? কাল আওয়াজ শুনলাম” ।

“না দাদা কাল রাতে বস্তিতে একজন মারা যায় , তাই শুনেছ”

“তোদের নাচ হয় না ? কবে হয় ”

“হয় তো পরবে।”

মাস খানেক পর ,অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি ,তখনো শিত ভালোই । হঠাত মোবাইল বেজে উঠল । অপিরিচিত নাম্বার। তুললাম । ওদিক থেকে বলছে ” দাদা পরশু পরব আছে , লাচ্‌ হবে , আসবে ?”

“তুই…”

“আমি জোসেফ । চিনতে পাড়ছ না ?”

” হ্যা পাড়ছি,তুই আমার নম্বর মনে রেখেছিস?”

“ও মা, দাদু লিখে রাখল যে আসবে ?”

“কি করে আসব … আমার তো অনেক কাজ। মন দিয়ে অঙ্ক করছিস্‌ তো ।”

“হ্যা , একদিন কলকেতা যাব… তুমি বলেছিলে আমায় শহর দেখাবে। আমি কিন্তু গ্রাম দেখিয়েছিলাম ”

“নিশ্চয়ই । তুই এলেই দেখাবো চিড়িয়াখানা, ভিক্টরিয়া সব।

শেষের কথা গুলো আর মনে নেই । আমার কানে তখন সেই নিকষ কালো রাত্রের মিউজিকটা বাজছে । সরল সুন্দর একে অপরকে না ছাপিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গিত ।মানুষ এভাবেও মনে রাখে ?

মোবাইল হারিয়েছিল কয়েকমাস পর । জোসেফ নামটা , নামের জন্য দেওয়া । নাম হারিয়েছি শহরের ভিড়ে । কিন্তু ছেলেটার মুখটা , সোজা সরল বাঁচার লড়াইটা, আর সেদিনের রাতের সুর আমায় কোনদিন-ও ছেড়ে যাবে না । আজকেও , যে কোন অন্ধকার রাতে ,যখন আলো দেখতে পাই না , তখন ওই মানুষের সুর-ই বাঁচিয়ে রাখে ।

সরি জোসেফ , চিড়িয়াখানা দেখানো হল না ।​

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত