“ বাবা তোমার কী মন খারাপ? ”
ছোট্ট মেয়ের কথা শুনে গম্ভীরতা ভাঙলো উদয়ের। মেয়ের টুসটুসে গাল দুটো ধরে জবাব দিলো— না তো মামণি। এমনিই ভাবছিলাম।
কেয়া বাবার চোখের দিকে তাকালো।
“ কী ভাবছো বাবা? ”
— ভাবছি কালকে তো শুক্রবার। তুমি আর আমি ঘুরতে গেলে কেমন হয়?
কেয়ার চোখে হঠাৎ খুশির ঝলকানি বয়ে গেলেও নিমিষেই বর্ষা নেমে এলো। মনটা খারাপ করে বললো— শুধু তুমি আর আমি কেনো? আম্মি যাবে না? আম্মির কি ঘুরতে ইচ্ছে হয় না?
উদয় চুপ হয়ে গেলো। প্রশ্নের উত্তরটা সে জানে না। জেলায় জেলায়, বিভাগে বিভাগে যে গান গেয়ে বেড়ায়, তাঁর কী ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা হয়? হয়তো হয়, হয়তো হয় না!
“ তোমার আম্মি তো বাসায় আসবে না কাল। কক্সবাজার যাচ্ছে। ওখানে অনুষ্ঠান আছে। গান গাইবে, টিভিতে দেখাবে আম্মিকে। ”
নিজের মাথার চুলগুলো ধরলো কেয়া।
“ জানো বাবা। আম্মিকে টিভিতে দেখতে আমার ভালো লাগে না। আম্মি সেই গত সপ্তাহে বলেছিলো আমার মাথায় বেনি করে দিবে। আজও আম্মি দিলো না। ”
উদয় হাতে করে একটা তেলের বোতল এনে বললো— আমি করে দিলে হবে না?
কেয়া মুখ চেপে হাসলো। হাসলে মেয়েটাকে অপরূপ লাগে। এই হাসি হাজারো রোগের ঔষধ উদয়ের কাছে।
“ হাসছো কেনো মামণি? ”
— এটা আম্মির লোশন, লোশন দিয়ে চুলের বেনি করে না! হেহে তুমি কতো বোকা।
তাড়াহুড়ো করে উদয় হাতে করে কী আনলো সে খেয়াল করেনি!
চুলের বেনি করে দিলো উদয়। যদিও কেয়ার আম্মির মতো করে পারেনি। তাতে কী? মেয়েটা তো শান্ত হয়েছে। তা কম কীসে?
সকাল সকাল মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেছে। বাবার কলার ধরে টেনে তুললো।
“ বাবা, তুমি হিসাব মনে রাখো কী করে? ব্রাশটাই খুঁজে পাওনা। ”
উদয় মুচকি হেসে বললো— আমার মামণি আছে না খুঁজে দেয়ার জন্য?
“ আমি কী সারাজীবন থাকবো? ”
উদয় আর কথা বললো না।
কালো একটা জামা পড়েছে কেয়া। উদয়ের কালো রং পছন্দ। উৎসব আছে একটা৷ নগরদোলায় উঠবে কেয়া। কেয়াকে একাই উঠতে বললো উদয়।
— তুমি উঠবে না কেনো বাবা?
“ আমি নদরদোলা ভয় পাই। ”
— তুমি এতো ভীতু বাবা? আম্মি ভয় পায় না। আম্মিকে ছাড়া আসতে ভালো লাগে না।
“ আচ্ছা, পরেরবার আম্মিকে নিয়েই উঠবে তাহলে। আজকে চলো যাই। ”
কেয়া মেনে নিলো।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। পিয়াকে টিভিতে দেখায়নি। বারবার টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করে স্বস্তি পাচ্ছে না কেয়া।
সন্ধার পরে গোসল করা উদয়ের অভ্যাস। এসে কেয়ার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে নিলো উদয়৷
“ টিভিতে আজকে আম্মিকে দেখাবে না। ”
— কেনো?
“ ওখানে কোনো ক্যামেরা নাই। ”
কেয়া বিশ্বাস করে নিলো।
মাঝ রাতে খেয়াল হয় উদয়ের। কেয়া বসে আছে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো— মামণি বসে আছো কেনো? খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ?
— না, আমি আম্মির সাথে কথা বলবো।
উদয় উঠে রুমের বাতিটা জ্বালালো।
“ আম্মি ঘুমাচ্ছে। ”
— তবুও তুমি ফোন দাও।
উদয় ফোন দিলো। রিং হচ্ছে। ধরছে না পিয়া। কয়েকবার ফোন দেয়ার পরেও ধরলো না। মন খারাপ করে শুয়ে পড়লো কেয়া। তার পরেই পিয়া ফোন দেয়।
“ কী ব্যাপার? আপনার সাথে আমার সব কিছু শেষ। কেনো ফোন দিচ্ছেন রাত্রিবেলা? ”
— কেয়া কথা বলতে চাচ্ছিলো।
“ কেয়াকে বলে দিবেন তাঁর মা মরে গেছে। রাখছি, এক মায়ের সন্তান হলে আর ফোন দিবেন না। ”
— বলছি, এক মিনিট কথা বললে মেয়েটা খুশি হতো।
“ দেখুন, আমি আমার পুরনো ভালোবাসা ফিরে পেয়েছি। আপনার সাথে আমাকে জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়েছিলো৷ আপনি ভুলে যাননি বোধহয়। সে এখন চাকরী পেয়েছে। আমরা বিয়ে করেছি কালকে। দয়া করে আমাদের আর বিরক্ত করবেন না। যতটুকু জানি আপনি ভদ্রলোক। ”
— মেয়েটা কাঁদছিলো!
“ আপনার মেয়ে আপনি সামলান। ”
বলেই টুঁট করে কেটে দিলো পিয়া। গান গেয়ে গেয়ে সে তাঁর পুরনো প্রেমিককে খুঁজে পেয়েছে। তাঁর সাথে সুখে থাকবে। উদয়ের কপালটাই এমন। ছোটবেলা থেকেই যা সে চায়। তা পায় না। পেলেও স্থায়ী হয় না।
আলমারির ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাক বের করলো উদয়। কেয়ার কথা ভেবে সে সিগারেট ধরায় না। কিন্তু আজ ধরালো। সারাটা রাত্তির সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে মক্ত করলো।
কেয়ার পরীক্ষার ফলাফল দিবে আজকে।
তৃতীয় শ্রেণীতে উঠবে।
কখনো সে প্রথম হতে পারে না। যার রোল সবসময় এক থাকে। সুমন, ছেলেটা দারুণ মেধাবী। সব বিষয়ে পাকা।
স্কুলের গেট পেরোতেই একজন শিক্ষিকা এগিয়ে আসলো।
“ কেয়ার আম্মু আসেনি আজকে? ”
উদয় জবাব দিলো— কক্সবাজার গেছে। ফাংশান আছে। কেয়ার খবর কী?
— সঙ্গে করে মিষ্টি নিয়ে আসা উচিৎ ছিলো। কেয়া এবার প্রথম হয়েছে। ওর আম্মু জিতে গেলো।
কেয়া প্রথম হওয়ার খবরটা শুনে একদম খুশি হয়নি। আম্মি পাশে থাকলে মনে হয় খুশি থাকতো। হাসতো, ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরতো। উদয়ও কম চেষ্টা করলো না।
তবুও মেয়ের মন ভালো করতে পারলো না।
পিয়া যেভাবে পায়েস রান্না করতো। উদয় তো তা পারে না।
মেয়েটা ছবি এঁকেছে। বাবাকে বানিয়েছে ভীতু পেঁচা! আম্মিকে শিকারী দোয়েল। আর কেয়া নিজে একটা চড়ুইপাখি।
উদয় ছবিটা হাত থেকে নিয়ে ভাবলো। এরকম একটা মেয়েকে কীভাবে কোনো মা ভুলে থাকে? তাঁর বুঝে ধরে না।
এরই মাঝে দারোয়ান আসলো। উদয়ের ফোনও বেজে উঠলো। দারোয়ান কেয়ার হাতে পেপারটা দিয়ে চলে গেলো। কেয়া পেপারটা হাতে নিয়ে দেখলো তাঁর মায়ের ছবি! বধূ বেশে! খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আম্মিকে।
“ বাবা, কই গেলে? ”
উদয় ফোনের কথা শেষ করে এসে বললো— এইতো মামণি।
“ দেখো আম্মিকে কত সুন্দর লাগছে। আম্মি বিয়েতে গেছে কারো না? ”
উদয় খপ করে কেয়ার হাত থেকে পেপারটা নিয়ে নিলো। কেয়া শুধু ছবিটাই লক্ষ করেছে, শিরোনাম লক্ষ করলে হয়তো অন্য প্রশ্ন করতো। “ হ্যাঁ, আম্মির বান্ধবীর বিয়েতে। ”
মন খারাপ করে সোফায় বসে পড়লো কেয়া। বাবার দিকে চেয়ে আছে।
“ বাবা, আম্মি আমাকে বিয়েতে নিলো না কেনো? আমি কী এতই পঁচা? ”
উদয়, উত্তর খুঁজছে…!