তিতলীর চিঠি

তিতলীর চিঠি

রাত প্রায় দুইটার কাছাকাছি।
ছোট্ট একটা রুমে দু’টি প্রাণী খাটের দুই দিকে মুখ ঘুড়িয়ে শুয়ে আছে। একজন আমি, আরেকজন তিতলী। আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা কোলবালিশ রাখা। কেউ কোনো কথা বলছি না। কেউ আবার ঘুমাতেও পারছি না। আমি বাধ্য হয়ে চুপ করে আছি, কারণ অনেকবার কথা বলতে চেয়েও কোনো সারা পাইনি। অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে আছি, সেটাও বাধ্য হয়ে। কারণ আমার চোখে চোখ পড়লেই তিতলী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়!

একটা বিশেষ কারণে তিতলী আমার উপর অভিমান করে বসে আছে। আমি সেটা বুঝতে পেরেও এমন একটা ভাব ধরে আছি যেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যার ফলে তিতলীর অভিমান আরও বেড়ে যাচ্ছে। বাড়তে বাড়তে সেটা রাগে পরিণত হয়ে গেছে। রাগের পরিমাণ এত বেশি যে, সে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে!

রাত তখন তিনটার কাছাকাছি।
তখনও কারও চোখে ঘুম নেই। কথাও নেই। আমি নীরবতা ভেঙে দুষ্টুমির ছলে নীচু গলায় বললাম, “ইয়ে, আজ কিছু হবে না?
সে তবুও চুপ।

আমি খানিকবাদে তিতলীর পিঠে হাত রাখলাম। রেখে আবার বললাম, “এ্যাই, রাত তো অনেক হলো। কিছুই হবে না আজ?”

তিতলী এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, “খবরদার আমাকে টাচ করবা না। বিরক্তিকর যত্তসব!”
বলেই সে আরও দূরে সরে গিয়ে ঘুমানোর ভান ধরলো।

আমি অসহায়েরর মত গুটিয়ে গিয়ে বউকে না পেয়ে মাঝখানে রাখা কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরলাম। এমনভাবে মমতা দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছি যেন, এটা কোলবালিশ নয়, রক্তে মাংসে গড়া কোনো রমণী!

তিতলী এই দৃশ্য বাঁকা চোখে একবার তাকিয়ে দেখল। রাগে যে তার চোখ লাল হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না আমার।

আমি এবার কায়দা করে কোলবালিশের মাথার কাছে নাক ঘষতে শুরু করলাম। অন্যান্য দিন যেভাবে তিতলীর গলায় নাক ঘষি। শুধু এটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হলাম না, কোলবালিশটাকে রীতিমত দুই পায়ের চিপায় আটকে ধরে রাখলাম। তিতলী প্রচন্ড রাগে হিংসায় জ্বলে পুড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত দেখানোর মত অবস্থা। যেকোনো সময় বিপদজনক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানতে পারে! আমি মজা পেয়ে কোলবালিশটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছি। এভাবে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারিনি।

সকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই দেখি পুরো খাট জুড়ে তুলোর ছড়াছড়ি! আমার শরীর উপর যেন তুলোর স্তুপ জমে আছে! এত তুলো আসলে কোথা থেকে? খাট থেকে নিচে তাকাতেই দেখি তিতলী কিচেন থেকে মাছ কাটার দা এনে কোলবালিশের কভারটাকে কুটি কুটি করে কাটছে। মাঝেমাঝে এক হাত দিয়ে চোখ-নাক মুছছে। তিতলীর নাক ঘামছে। বুঝতে বাকি রইলো না এগুলো সব কোলবালিশের তুলো।

আমি ধড়ফড় করে উঠে গিয়ে বললাম, কী হয়েছে তিতলী? ঘটনা কী? কাঁদছো কেন?
আমার কথা শুনে তিতলী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, খবরদার আমার কাছে আসবা না! তোমাকেও কিন্তু কেটে টুকরো টুকরো করব!

আমি খাটে এসে বসে পড়লাম। বুঝলাম তিতলী ড্রয়িংরুমে এখনো ঢোকেনি। ঢুকলে রাগের তীব্রতা এতবেশি থাকতো না। কোলবালিশের কভার কাটা শেষ করেই তিতলী হনহন করে ড্রয়িংরুমের দিকে চলে গেল। আমি ড্রয়িংরুমের দরজায় চুপিচুপি দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে থেকে যেটা দেখছি, সেটা হলো-

তিতলী অবাক হয়ে ড্রয়িংরুমের ছোট্ট টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের উপর বড় একটা কেক রাখা। কেকের উপর লেখা “Happy Anniversary”
হ্যাঁ, আজ আমাদের ফার্স্ট এনিভার্সারি।

কেকের পাশেই ছোট একটা চিঠি রাখা আছে। তিতলী ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলল। চিঠিটা আমার লেখা।

“প্রিয় তিতলী,
জানি তুমি খুব রেগে আছো। তুমি হয়ত ভেবেই নিয়েছিলে আমাদের প্রথম এনিভার্সারির ডেট হয়ত আমি ভুলে বসে আছি! কায়দা করে গতকাল রাতেই আমি ড্রয়িংরুমে কেক সাজিয়ে রেখেছি। সকালে তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলে। সেই সাথে তোমাকে রাগি রাগি চেহারায় দেখব বলে।

জানো, মেয়েদের অনেকভাবেই কিউট লাগে। কেউ সাজুগুজু করলে কিউট লাগে, কেউ নিজ হাতে রান্না করে তার স্বামীকে খাওয়াতে বসলে কিউট লাগে, আরও অনেক ভাবেই লাগে। কিন্তু তোমাকে কেন জানি রাগলে বেশি কিউট লাগে। আর তাই তো তোমাকে রাগিয়ে কিউট কিউট রাগি মুখটা দেখতে আমার এত আয়োজন।

আজ রাতে তোমার জায়গায় কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আমারও মেজাজ খারাপ হয়েছিল। কিন্তু কী করব বলো। বালিশটাকে ওভাবে না জড়িয়ে ধরলে হয়ত সকালে ছেঁড়া বালিশটার তুলো ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকতে দেখতাম না। কিউট একটা দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হতাম। ভাবছ এগুলো আমি আগে থেকেই কীভাবে জানি? হাহাহা… তোমার কী মনে পড়ে, তুমি প্রায়ই বলতে, তোমার সামনে আমি অন্যকোনো মেয়ের দিকে তাকালে তার মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলবে? সেখান থেকেই ধারণা করে নিয়েছি কোলবালিশটার কপালে আজ খারাবি আছে! যদিও কোলবালিশ কোনো মানুষ না, তবুও।

আমি চাই আমাদের প্রতিটা দিনই যেন তোমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকে। আশা করি আমাদের এই প্রথম এনিভার্সারির কথাও তোমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। থাকবে না, বলো? আমাদের আগামী এনিভার্সারিটাও আমি যেকোনভাবে স্মরণীয় করে রাখব। কিন্তু কীভাবে করব, সেটা এখন আমি তোমাকে বলব না। তবে সেখানে কোনো কোলবালিশ থাকবে না, এটা নিশ্চিত! হা-হা-হা”

তিতলীর চিঠিটা পড়তে পড়তে পিছনে তাকালো। পিছনে তাকাতেই আমার চোখে চোখ পড়ে গেল। মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে। চোখের পানি গুলো মুক্তোর দানার মত চিকচিক করছে। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপছে। তার কাঁপাকাঁপা ঠোঁট আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। সেটা বুঝতে পেরেই কি না তিতলী আমাকে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ধরল। লক্ষ্মী বউয়ের মত আমার ঘাড় আঁকড়ে ধরে নিজের ঠোঁটজোড়া এগিয়ে দিল।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত